অসমাপ্ত গল্প – ডাক্তার বাড়ি – 2
বছর দুয়েক আগের কথা। কিউরিসের টিম নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ফ্রি হেলথ ক্যাম্প করে বেড়াই। অসহায়, দুঃস্থ, ছিন্নমূল শিশুদের দেখি। প্রেস্ক্রিপশন লিখি আর ভাবি – এই ছেলেটার এই টেস্টটা করা খুবই জরুরী, এই মেয়েটার একটা আলট্রাসনোগ্রাম না হলে আসলে ঠিক ডায়াগনসিস হচ্ছে না। যেসব অর্গানাইজেশনের স্কুলগুলোতে যাই তাদের বলি, “ভাইয়া এই টেস্টটা লাগবে”। বলেই বুঝতে পারি আমাদের মত একই পথের পথিক এই অর্গানাইজেশনগুলোর সামর্থ্যও আমাদেরই মত। সাধ থাকলেও সাধ্য নাই। হতাশ হয়ে ফিরে আসি। মনে মনে ভাবি – একদিন হয়তো অনেক টাকা হবে। একদিন হয়তো পারবো। একদিন হয়তো এই চোখের জল আশার অশ্রু হয়ে জ্বল-জ্বল করে জ্বলবে।
স্পার্কে গিয়েছিলাম কিউরিসকে অবলম্বন করে। সোশ্যাল বিজনেস কী সেটার সম্পর্কে না ছিল কোন ধারণা না ছিল কোন পড়াশোনা। আমাকে ৬ দিনে ঘষে-মেজে কিছু একটা মাথায় ঢুকিয়ে স্পার্ক যখন ছাড়লো তখন আমি পুরোই ঘোরের মধ্যে। সেই ঘোরে কোনকিছুই আর অসম্ভব মনে হয় না। মনে হয় চোখের জলের সেই হতাশা এবার কাটবেই। আমার ঘোর সংক্রমিত হয় আরও কিছু মানুষের মধ্যে। তারাও মনে করে চেষ্টা থাকলে সবই সম্ভব। আমাদের সবার সেই ঘোরের নাম “ডাক্তার বাড়ি”।
আমরা বেশী কিছু করছি না। একটা ২০০০ স্কয়ার ফিটের জায়গা ভাড়া করেছি। একটা ল্যাব দেবার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। প্রতিদিন এটা-সেটা করেই যাচ্ছি। আপাতত বায়োকেমিস্ট্রি আর সেরোলোজির টেস্টগুলো করার মত অবস্থায় এসেছি। এই অবস্থানে এসেই সামনে দেখতে পাচ্ছি বিশাল অন্ধকার। এই মাসের ভাড়া দিয়েছি নিজের সেভিংস থেকে। সামনের মাসের খরচ কীভাবে মেটাবো সেই চিন্তায় এখন আমার চোখে সর্ষেফুল দেখার কথা। আমি সেটা দেখছি না। আমি দেখছি মজার একটা ছবি।
মাঝবয়সী এক লোক তার স্ত্রীকে নিয়ে এসেছে। মুখ গম্ভীর। কথা-বার্তায় বোঝা যাচ্ছে মহিলা প্রেগনেন্ট। ডাক্তার বেশ কিছু টেস্ট দিয়েছে। কিন্তু এই রাতের বেলায় সরকারী হাসপাতালে পরীক্ষা হবে না। ওদিকে স্ত্রীও নাছোড় বান্দা। টেস্ট তাকে আজকেই করাতে হবে। প্রথম বাচ্চা বলে কথা। সে খুব টেনশন করছে। ভদ্রলোক বেশ দ্বিধা নিয়ে প্রেস্ক্রিপশনটা এগিয়ে দিলেন। চোখে-মুখে রাজ্যের হতাশা। আমাদের রিসিপসনিস্ট সামান্তা হিসাব করছে সব টেস্ট মিলে কত খরচ পড়বে। মহিলা বেশ উৎসুক হয়ে জানতে চাচ্ছেন খরচ বেশী হয়ে যাচ্ছে কি না। হিসাব শেষে সামান্তা বললো, “আপনাদের এসেছে ১২৪০ টাকা”। আমি দেখছি ভদ্রলোকের ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে। তিনি অস্থির হয়ে বললেন,”আপা সব টেস্ট মিলায়ে বলেন।” এবার সামান্তা ভ্রু কুঁচকে বললো, “তাই তো বললাম। আপনাদের এই ৫টা টেস্ট মিলে আসছে ১২৪০ টাকা”। এবার ভদ্রলোক চোখ বড়-বড় করে অবিশ্বাসের সাথে বললো,”এত কম কীভাবে?” এবার ক্যাশে বসা রুশো উত্তর দিল “ভাই আমরা সরকারী হাসপাতালের সমান রেটে টেস্ট করি।”
বাকি ছবিটা আমি আর দেখতে পারছি না। আমার চোখ পানিতে ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। ঝাপসা চোখে শুধু এটকু দেখলাম যে নিম্ন মধ্যবিত্ত একটা পরিবারের স্ত্রী হাসিমুখে স্যাম্পল কালেকশন রুমের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। সেই হাসি আনন্দের, নির্ভরতার আর খরচ একেবারেই কমে যাওয়ার স্বস্তির।
উপরের এই ছবিটাই হচ্ছে আমাদের ডাক্তার বাড়ি। আপনিও আমন্ত্রিত। অসহায় আর দরিদ্র মানুষের জন্য সরকারী খরচে ডায়াগনস্টিক সেবা – এটাই আমাদের লক্ষ্য।
আলো আসবেই। হাসি ফুটবেই তাদের মুখে যাদের রক্ত-ঘামের উপর দাঁড়িয়ে আছি আমরা, আমাদের আভিজাত্য।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua