দায়িত্ব

Published On: March 1, 2012By Tags: , Views: 27

০২/০২/১২

অনেকদিন পর আজ ডায়রি নিয়ে বসলাম। যদিও খুব ক্লান্ত লাগছে তারপরও লিখবো ঠিক করেছি। সারাদিনে আজ অনেক ধকল গেলো। ইন্টার্নি জীবনে এসে আজকে প্রথম অনেক বেশী থ্রিল অনুভব করছি। আজ থেকে আমার ডিউটি পরেছে মানসিক রোগ বহিঃবিভাগে। এজন্য অবশ্য মনটা বেশ খারাপ ও ছিলো। কামালউদ্দিন স্যার কে খুব মিস করছিলাম যখন সকালে ডিউটি করতে যাই। আজ মাত্র ৩ জন রোগীর সিরিয়াল দেখে ভাবছিলাম যাক ছুটিটা তাড়াতাড়িই পাব। প্রথম ২ জন রোগী আমাদের নতুন ম্যাডাম বেশ দ্রুতই দেখলেন। ৩য় রোগী যখন ঢুকলো তখনও ভাবিনি কি অপেক্ষা করছে আমার জন্য। হালকা-পাতলা গড়নের একটা ছেলে। কার্ডে দেখলাম বয়স ২২ বছর। চুপচাপ শান্ত ভাবে মায়ের সাথে রুমে ঢুকলো। চলাফেরায় কোন জড়তা দেখলাম না। কিন্তু একটু পরে চোখের দিকে তাকিয়ে একটা ধাক্কার মত খেলাম। প্রচন্ড হতাশা মাখা গাড় বিষাদময় শুন্য দৃষ্টি। ম্যাডামের একটা ফোন আসায় উনি আমাকে রোগীর ইতিহাস নিতে বলে ভিতরে গেলেন। আমি আসলে কিভাবে শুরু করবো বুঝতে পারছিলাম না। মনে পড়লো কামাল স্যার এর কথা। ‘আমরা যখন মানসিক রোগের ইতিহাস নিবো তখন কখনো জিজ্ঞাসা করবো না আপনার সমস্যা কি? প্রথমেই তার মানসিক অবস্থা বোঝার চেষ্টা করবো’। স্যার এর কথা অনুসরণ করে একটু গুছিয়ে শুরু করতে যাব দেখি শামীমের ফোন। লাইন কেটে দিলাম। আবারো ফোন। এবার ফোন অফ করেই শুরু করলাম।

-‘আপনার নাম?’

-‘শাওন’

-‘বয়স?’

-‘২২ বছর’।

-‘হুমম। কেমন আছেন?’

প্রশ্নের উত্তরে ছেলেটা কিছু না বলে শুধু হাসলো। প্রানহীণ হাসি।

আমি আবারো জিজ্ঞাসা করলাম – ‘শাওন সাহেব কেমন আছেন?’

আবার চুপ।

-‘লেখাপড়া কেমন চলছে?’

আবারো সেই বিষন্ন হাসি। বুঝতে পারলাম সে নিজে থেকে তেমন কিছুই বলবে না। এদিকে ছেলের মা-ও আমার উপর খুব একটা ভরসা পাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছেনা। উনি শেষ পর্যন্ত বলেই বসলেন- ‘কিছু মনে করবেন না আমরা একটু ম্যাডাম এর সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম। আসলে ও বেশ অসুস্থ’।

উনার কথার মাঝখানেই ম্যাডাম চলে আসলেন।

ম্যাডামঃ ‘কি অর্না ইতিহাস নেওয়া শেষ?’

আমি কি বলব খুঁজে পেলাম না। আজ মাত্র প্রথম দিন। আজকেই যদি ম্যাডাম মনে করেন আমি ফাঁকিবাজ তাহলে বাকি দিন গুলো খুব ভাল যাবেনা। আমতা আমতা করছি এমন সময় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেই হয়তো মহিলা বলে উঠলেন – ‘উনি জানতে চাচ্ছিলেন কিন্তু আমরা কিছু বলিনি। আসলে আমি একান্তই প্রথমে আপনার সাথে কথা বলতে চাচ্ছিলাম’।

ম্যাডামঃ ‘ওহ আচ্ছা। ঠিক আছে। কোন সমস্যা নেই। তাহলে আসুন আমরা ভিতরে যাই। অর্না তুমি ওর সাথে থাকো’।

ম্যাডাম মহিলাকে নিয়ে ভিতরের রুমে চলে গেলেন। এদিকে আমারতো অস্বস্তি লাগছে। একটু একটু ভয় না বেশ ভয় লাগছে। একটা পাগলের পাশে বসে আছি ভাবতেই খারাপ লাগছে। একথা মনে হবার সাথে সাথেই নিজেকে কষে একটা ধমক লাগালাম। এসব কি ভাবছি আমি। আমি না ডাক্তার।

‘মানসিক রোগী কে কখনো পাগল বলে অবহেলা করবে না। তুচ্ছ করবে না। আমরা সবাই কমবেশি মানসিক সমস্যায় ভুগে থাকি। অন্যসব অসুখের মত এটাও একধরনের রোগ। তবে একজন ডাক্তার এর জন্য এটা অনেক চ্যালেঞ্জিং। কারণ অনেক অসুখ চোখে দেখা যায় কিন্তু এটা যায় না’- কামাল স্যার এর কথা গুলো ভাবতে ভাবতেই ম্যাডাম চলে আসলেন। এসেই বললেন-‘অর্না, শাওন কে আমরা কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি রাখবো। তুমি একটা এডমিশন অর্ডার লিখো। ওর সম্পূর্ন ইতিহাস নেবার আর ফলো আপ এর দায়িত্ব তোমার। তুমি আগামী পরশু আমাকে ওর রোগের সম্পূর্ন ইতিহাস দেখাবে। ওকে ভি আই পি-৪ এ ভর্তি করো। আমি যাবার সময় অর্ডার দিয়ে যাবো। এরপর মহিলার দিকে তাকিয়ে বললেন অর্না, ইন্টার্নি ডাক্তার হলেও যথেষ্ট সিরিয়াস। ওকে সাহায্য করবেন আশা করি’।

ম্যাডাম চলে গেলে রুম থেকে বের হয়ে এসে ফোন অন করলাম। সাথে সাথেই একটা মেসেজ আসলো। শামীম লিখেছে- ‘কি ব্যাপার ফোন অফ করলে যে? বেশী বিরক্ত করছি? আচ্ছা আর বিরক্ত করবো না। শুধু একবার এসে ঘুরে যেয়ো। অনুরোধ’। সাথে সাথে মনে পরলো আজ ‘বন্ধু’-র উদ্যোগে রক্তদান কর্মসূচি চলছে। আজ ৫ বছর ধরে শামীম আমাকে এর সদস্য হতে বলছে। কিন্তু আমার ভাল লাগেনা। কেন জানি ডাক্তার হবার পরও এই রক্তদেবার অনুভূতি, ভালোলাগা আমাকে স্পর্শ করেনা। ঠিক যেভাবে স্পর্শ করেনা শামীম এর ভালোবাসা। ছেলেটা অনেক ভালো। সেই সেকেন্ড ইয়ার থেকে আমার সাথে আছে। সব ব্যাপারেই ওর সাহায্য পাই। তারপরও ওর আহ্বানে সাড়া দেয়নি আজও। ওকে বলতে গেলে একরকম অবহেলাই করি আমি। আর সেজন্যই আজ আর ওদিকে যাইনি। সোজা চলে আসলাম বাসায়। উফফ কত্ত লিখে ফেলেছি। খুব ঘুম পাচ্ছে। আজ তবে ৬০+২০ = ৮০। হি হি হি।

 

০৩/০২/১২

মেজাজটা এখনো ঠিক হয়নি বুঝতে পারছি। সকাল থেকেই মন মেজাজ খারাপ আজকে। গাধাটা আজ এমন সিন ক্রিয়েট করলো কেন? হ্যাঁ, শামীমের কথায় বলছি। সকাল থেকেই চাপাচাপি শুরু করেছে রক্ত দিতে হবে। আরে যতবার না করি ততবার অনুরোধ করে। শেষে না পেরে কিছু কড়া কথা বলতেই হল। আমি বুঝি না দেশে রক্তদাতার কি অভাব পড়েছে? ওর কথা শুনে মনে হচ্ছিলো আমি ছাড়া ব্লাডব্যাংক অচল। শেষে যখন খুব বাজে ভাবে বললাম- ‘যাও মশা ধরে ধরে পেট চিপে রক্ত বের করে ব্যাগে ভরো’ তখন আর কোনো কথা বলেনি। চুপচাপ সামনে থেকে চলে গেলো। মুখ দেখে বুঝলাম খুব কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু মেজাজ এত খারাপ ছিল যে স্যরি টাও বলিনি।

এদিকে মিঃ শাওন কে নিয়ে পড়েছি বিপদে। ম্যাডাম আমাকে ২ দিনের সময় দিয়েছেন। কিন্তু আমার তো মনে হচ্ছে ২০০ বছর দিলেও কিছু হবেনা। আমার পক্ষে সম্ভব না তার রোগের ইতিহাস বের করা। আজ যখন আমি কথা বলতে গেলাম তখন তার মা-ও ছিল। সে চুপচাপ শুয়ে ছিল বিছানায়। আমার সাথে তার কথাবার্তাটা হল এরকম-

-‘এই যে শাওন সাহেব কেমন আছেন?’ যথেষ্ট আন্তরিকতা নিয়ে বলার চেষ্টা করলাম।

-‘ভালো’। কিন্তু আমার দিকে তাকালো না পর্যন্ত।

-‘এখন কি একটু ভালো লাগছে?’ বলেই হেসে দিলাম। প্রশ্নটা করেই বুঝলাম বোকার মত প্রশ্ন করেছি। মানসিক রোগী এক দিনেই কিভাবে ভালো অনুভব করবে।

এবার সে আমার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকালো। অপলক তাকিয়ে থাকলো। আবার আমার অস্বস্তি লাগা শুরু হয়েছে। কোনোমতে বললাম – ‘ওষুধ খাচ্ছেন তো?’ আমাকে প্রচন্ড অবাক করে সে সম্পূর্ণ অপ্রাসংগিক একটা প্রশ্ন করে বসলো।

-‘কাউকে ভালোবাসেন? খুব বেশী? যতটা ভালোবাসলে চোখের পানি শুকিয়ে মানুষ অশ্রু শূন্য হয়ে যায়?’

এই প্রথম সে এত লম্বা একটা কথা বললো আমার সাথে । তবে আমি পুরো বোকার মত তাকিয়ে থাকলাম। তখন মনে পড়ছিল স্যার এর বলা কথা – ‘যখন প্রচন্ড মানসিক কষ্টে কেউ অসুস্থ হয়ে যায় তখন তার ব্যাপারে ধৈর্য্য-ই হল তোমার মেডিসিন। তাকে বুঝার জন্য সময় নাও’। কিন্তু আমি সেখানে থাকতে পারিনি। ঐ শূন্য দৃষ্টির সামনে অনেক অসহায় লাগছিল। পালিয়ে এলাম আজকে। মনটা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে শাওন নামের ছেলেটার অনেক বড় কোন কষ্ট আছে। আচ্ছা এত দুঃখ কেন মানুষের? যাই। কিছু ভালো লাগছে না।

০৪/০২/১২

আজ আমার শুধুই অবাক হবার দিন। আজকে মনে হয় প্রতি ঘন্টায় একবার করে অবাক হয়েছি। সকালে উঠে প্রথম অবাক হয়ে দেখলাম ভাইয়া নাস্তার টেবিলে। এত অদ্ভুত লাগলো ব্যাপারটা যে একটা চিৎকার দিয়ে ফেললাম। ‘তুমি? তুমি এত সকালে নাস্তার টেবিলে?’ ভাইয়া শুধু একটা মুচকি হাসি দিলো। হাসপাতালে এসে আরেক দফা অবাক হলাম। আজ শামীম আসেনি। সাধারণত কোনোদিন ও না আসলে আমাকে ফোন বা মেসেজ দেয়। আজ তাও দেয়নি। এখন ওর আত্নার সংগঠন ‘বন্ধু’-র কার্যক্রম চলছে। ওর এ সময়টা না আসা বিস্ময়কর। এরপরের ঘটনা আমার জন্য মজার। ম্যাডাম আসেননি। আউটডোর হবেনা। তারমানে আমার ছুটি। কিন্তু তখনি মনে পড়ে গেলো আজ আমার রোগীর ইতিহাস নেবার শেষ দিন। তাই সোজা ভি আই পি কেবিনে চলে গেলাম। সবসময় রোগীর রুমে যাবার আগে তার ফাইল দেখা আমার অভ্যাস। এতে অন্তত রোগী বা তার আত্নীয় স্বজনের প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ হয়। শাওনের ফাইলে চোখ বুলাতে বুলাতে বেশ অবাক হলাম। ওর রক্তে বিলিরুবিন বেশ বেশী। ঝট করে ফাইলের উপরে দেখলাম। স্পষ্ট করে মার্কার দিয়ে সাদা টেপের উপর লেখা HVB +ve (হেপাটাইটিস বি পজেটিভ)। খুব মনটা খারাপ হলো। এত অল্প বয়সে? কিভাবে? মন খারাপ করেই শাওনের কেবিনে গেলাম। আরেকবার অবাক হলাম এটা দেখে যে ওর আম্মু যাকে আমি খুব শক্ত মনের মনে করেছিলাম উনি আঁচলে মুখ ঢেকে আছেন। শাওন ঘুমাচ্ছে। আমি মনে মনে ভাবলাম আমার তো ইতিহাস নেবার বারোটা বাজলো। তখনো আমার অবাক হবার বাকি ছিল। শাওনের মা আমাকে বসতে বললেন। আমি বাইরের রুমে এসে বসলাম। উনি এসে আমার সাথে বেশ আন্তরিক ভাবেই কথা বলা শুরু করলেন।

-‘তোমার নাম অর্না তাই না মা?’

-‘জ্বি। আমি অর্না’।

-‘তুমি করে বললাম কিছু মনে করনিতো? আমার মেয়েটা তোমার চেয়ে একটু ছোট। মেডিকেলে ফাইনাল ইয়ার এ পড়ে’।

-‘জ্বি না। আমি কিছু মনে করিনি। আমাকে তুমি করেই বলবেন’।

এরপর আবার নিরবতা। শেষে আমিই জিজ্ঞাসা করলাম- ‘আচ্ছা আন্টি শাওন তো মনে হয় কিছু বলবে না। আসলে আমি জানতে চাচ্ছিলাম ওর সমস্যাটার শুরু কিভাবে?’

আন্টি আবার আঁচলে মুখ ঢাকলেন। আমি এবার আরও অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কিছুক্ষন পর আন্টি শাওনের রুমে গেলেন। আমি বাইরে থেকে দেখলাম উনি শাওনের বালিশের নিচ থেকে একটা সুন্দর নীল ডায়রি বের করলেন। বুঝলাম হয়তো ডায়রির সাথে আমার চাওয়া তথ্যের কোন সম্পর্ক আছে। আন্টি এসে বললেন – ‘এই ডায়রিতে ওর রোগ সম্পর্কে তুমি অনেক কিছুই জানতে পারবে। আমি আজ তোমাকে এটা দিবো না। শাওন যদি ঘুম থেকে উঠে ডায়রির খোঁজ করে তাহলে সমস্যা হবে। ডায়রি না পেলে ও খুব অস্থির হয়ে পড়ে। মাঝে মাঝে ওকে যখন ঘুমের ওষুধ দেয়া হয় তখন ১-২ দিন ও এটার কথা ভুলে থাকে। আজ যদি ঘুম থেকে উঠে ডায়রি না চায় তাহলে তুমি কাল এসো। ভালো হয় যদি তুমি পড়ে সেদিনই ফেরত দিতে পারো। তুমি আমার মেয়ের প্রায় সমবয়সী। আমি জানি ওর ইতিহাস না নিতে পারলে ম্যাডাম এর কাছে তুমি বকা খাবে। আর রোগীর প্রতি তোমার আগ্রহ দেখে আমার খুব ভালো লেগেছে। এজন্যই তোমাকে ডায়রির কথাটা বললাম’। আমি খুব আগ্রহ নিয়ে তাকিয়ে থাকলাম ডায়রির দিকে।

কেবিন থেকে বের হয়ে শামীমকে ফোন দিলাম। আজকের দিনের শেষ চমকটা তখন পেলাম। শামীমকে ফোন করলে ও কখনো নিজে থেকে রাখেনা। বকবক করতেই থাকে। আজ ফোন করলাম ১ম বার ধরলো না। ২য় বার ধরে ‘আমি দেশে’ এটুকু বলেই ফোন রেখে দিলো। কিছুই বুঝলাম না। যাই হোক আর লিখবোনা আজ। আল্লাহ্‌ কাল যেনো ডায়রিটা পাই।

 

০৫/০২/১২

আচ্ছা মানুষের কষ্টের তো একটা সীমা বা মাত্রা থাকে তাই না? এই ছেলেটার কষ্টের মনে হয় কোন সীমা নেই। আজ ওর ডায়রিটা আমি পড়েছি। ফেরত ও দিয়ে এসেছি। শুধু ওর ডায়রি থেকে একটা অংশ আমি কাগজে লিখে রেখেছি। যে অংশটুকু আমাকে নতুন এক জীবনের স্বাদ দিয়েছে। আগে শাওনের কথা শেষ করি। পরে আমার কথা।

হ্যাঁ, শাওনের কথা। এক প্রচন্ড অভাগা ছেলের কথা। যার জীবনের গল্পে এখন শুধুই বিদায়ের গান। কিন্তু তার জীবনটা ছিল অসম্ভব আনন্দে ভরা। গান, আড্ডা, ভার্সিটির খেলার মাঠ, ক্যান্টিন, বন্ধু এসব কিছুতো ছিলই। আর সাথে ছিল রিমি। ওর একমাত্র ভালোবাসা। ওদের ভালোবাসার গভীরতা বর্ণনা দেবার ভাষা ও ক্ষমতা কোনটাই আমার নেই। ২ বছর ৩ মাস ১০ দিনের যে ভালোবাসার পরিচয় ডায়রিটা তে আছে তার তুলনা আমি কিছুতেই দিতে পারবোনা। শুধু রিমির লেখা ১ টা চিঠি ওদের ভালোবাসার গভীরতা বুঝার জন্য লিখে রেখেছি।

 

রিমির চিঠি

আমার লক্ষ্মী টোনা,

এই যে মিঃ টোনা, কেমন আছেন আপনি? জানি ভাল নেই। আমাকে ছাড়া আপনি ভাল থাকবেন কিভাবে বলেন? ওহ হো আপনি তো দেখি আমার পরিচয়ই ভুলে গেছেন। আমি মিস টুনি ওরফে হবু মিসেস টোনা। কি এবার চিনেছেন তো? জানো বাবু আমি না সত্যিই এভাবে আমার পরিচয় হারিয়ে ফেলি। নিজেকে তোমার মাঝে বিলীন মনে হয়। আচ্ছা সত্যি করে বলতো তুমি কি আমার উপর অনেক রাগ করেছো? আজ জ্বর নিয়েও কেন ভার্সিটিতে আসলাম বলে। কি করবো বলো, সকাল থেকেই খুব তোমাকে দেখতে ইচ্ছা করছিলো আর এই চিঠিটা দিতে মন চাচ্ছিলো। কেন যেন এখন তোমাকে সবসময় চোখের সামনে বসিয়ে রাখতে ইচ্ছা করে। আচ্ছা বাবু গত কয়দিন থেকে না আমার কিছুই ভালো লাগছে না। কেন এমন হচ্ছে বলোতো? কিছুতেই না শান্তি পাচ্ছিনা। মনে হচ্ছে অনেক কাজ বাকি থেকে যাবে আমার যা আর কখনো করা হবেনা। আচ্ছা আমি যদি না থাকি তাহলে তোমার অনেক কষ্ট হবে তাই না? ছাই হবে। তুমি তো খুশিই হবে। বোটানির ঐ যে শান্তা নাকি পান্তা ওর সাথে হাকিম চত্তরে বসে বাদাম খাবে। তা বাদাম না হয় খেয়ো। কিন্তু বাবুটা চটপটি তে খবরদার ঝাল বেশি খেয়ো না। তোমার গ্যাস্ট্রিক কিন্তু বাড়বে। জানি না এসব কথা কেন লিখছি। কিন্তু মনে হচ্ছে আমি যদি আর কখনো তোমাকে এসব কথা বলার সুযোগ না পাই। আচ্ছা তখন কে তোমাকে সকালে জোর করে ঘুম থেকে উঠাবে? কে ঠিক করে দেবে তুমি কোন ড্রেসটা পরে আসবে। তখন কি তুমি শার্টের ২ টা বোতাম খুলে হিরো সেজে ক্লাশে যাবে বাবু? যখন ক্লাশের ফাঁকে মোবাইলে আর কোন মেসেজ দেখবে না তখন কি নিজের অজান্তেই ভুরুটা কুঁচকে উঠবে তোমার, অনেক অভিমানে? সাড়ে ১২ টায় টিউটোরিয়াল শেষে যখন আমার খোঁজে সেই জারুল গাছটার কাছে আসবে তখন যদি আমায় না পাও?? কি করবে বাবু?? না খবরদার সিগারেট ধরাবে না। তোমার মত স্মার্ট ছেলের ঠোঁটে ওসব ছাই মানায় না তো জান।

আচ্ছা তোমার কি পড়তে খারাপ লাগছে? আমার এই চিঠিটা আমার মনের মত হচ্ছেনা। সব কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। তুমি রাগ করোনা কেমন। তুমি রাগ করলে আমার অনেক কষ্ট হয় যে। আমি চেয়েছিলাম তোমার সাথে জীবনের পূর্ণতা। আজ চাচ্ছি তোমার মাঝে আমার স্বপ্নের পূর্ণতা। কথা দুটোর অর্থ কি এক বাবু? এইতো মেজাজ খারাপ হয়ে গেল না? ভাষার উপর তোমার দক্ষতার প্রমাণ নিচ্ছি বলে। এবার বুঝেছো তো কেমন লাগে যখন তুমি আমার ফুটবল জ্ঞানের পরীক্ষা নাও। আচ্ছা আর্জেন্টিনা হারলে যদি তোমাকে ক্ষেপানোর কেউ না থাকে তখন অনেক শান্তি পাবে তাইনা? কিন্তু জান এত রাত জেগে মাছি থুক্কু মেসি-র সব খেলা দেখা কি ঠিক? শরীর খারাপ হচ্ছে যে। হয়তো আর কখনো তোমার খেলা দেখার বিঘ্ন ঘটবে না আমার জন্য।

তোমায় নিয়ে স্বপ্ন ছিল আকাশ ছুয়ে দেখার। মেঠো পথে দূর অজানায় হারিয়ে যাবার। ঝুম বৃষ্টিতে ছাদে উঠে বৃষ্টি বিলাসী হবার। আমার স্বপ্ন যদি থমকেও যায় তুমি থেমে যেয়ো না। তুমি আকাশ ছুয়ো আপন কর্মের গৌরবে। তুমি হারিয়ে যেয়ো গ্রামের পথের অপার সৌন্দর্যে। তুমি ঘন বরষায় পথে নেমো মনের তৃষ্ণায়। বৃষ্টি হলে যে ফোঁটাটা পরবে তোমার গালে সেটাই ছিলো আমার দেখা স্বপ্ন কোন কালে।

আমাদের সব স্বপ্ন পূরণের দায় যে এখন একা তোমার। স্বার্থপরের মত আমি ছুটি নিলাম নাকি জীবন আমাকে ছুটি দিল আমি জানি না। শুধু জানি অনন্ত ভালোবাসার আধার হয়েও আমি হয়তবা সার্থকতা লাভ করতে পারব না। এ দায় একান্তই আমার।

তোমার টুনি

বিঃদ্রঃ চিঠি টা পড়ে তোমার মন অনেক খারাপ হবে। আচ্ছা যাও আগামী পরশু আবার যখন দেখা হবে তখন অনেক আদর দিয়ে মন ভালো করে দিবো। কি খুশিতো বাবুটা? ততদিন কষ্ট কর। হি হি হি।

 

এটাই ছিল শাওন কে লেখা ওর শেষ চিঠি। এরপরে শাওনের ডায়রিতেও আর কিছু লেখা নেই। আমি বাকিটুকু জেনেছি আন্টির কাছ থেকে ডায়রি ফেরত দিয়ে আসার সময়। রিমি, শাওনের বাবার বন্ধুর মেয়ে। ছোটবেলা থেকেই একসাথে ওরা বড় হয়েছে। তাই ওদের মাঝে সম্পর্কটাও দুই পরিবার হাসি মুখে মেনে নিয়েছিল। বাঁধাহীন ভালোবাসা বলতে যা বোঝায় তাই ছিল ওদের জীবন। প্রচন্ড সুখের আর অসম্ভব সুন্দর কিছু স্বপ্নের মায়াবী বুননে বোনা হচ্ছিল জীবনের নকশি কাঁথা। কিন্তু এত সুখ তো মানুষের প্রাপ্য নয়। এটাই মনে হয় বিধাতার লেখা বিঁধান। শেষ চিঠিটা রিমি কেন এভাবে লিখেছিল আমি জানি না। তাহলে মেয়েটা কি বুঝতে পেরেছিল ওর নিয়তি? সেজন্যই কি সে নিজে হারিয়ে গেলেও তাকে মনে রাখার সব আয়োজন সম্পূর্ণ করে গিয়েছিলো? আমি জানি না। চিঠিটা শাওনকে দিয়ে বাসায় যাবার পর জরুরী কাজে সে রাতেই পরিবারের সাথে ও যাচ্ছিল গাজীপুর। সড়ক দূর্ঘটনার খবর যখন শাওনের কাছে পৌঁছায় তখন রাত ২ টা। ওরা সবাই তখন ছুটে যায় রিমিদের কাছে। না রিমি সাথে সাথেই মারা যায়নি। রিমি বেঁচে ছিল। শাওনকে যে ওর আরও কষ্ট দেবার তখনো বাকি। ইন্টারনাল ব্লিডিং খুব খারাপ একটা জিনিস। কোথা থেকে যে রক্তগুলো নিঃশব্দে হারিয়ে যায় বোঝা যায়না। ডাক্তারাও বোঝেনি। ওকে হাসপাতাল থেকে সরিয়ে ঢাকাতেও আনা যাচ্ছিল না ব্লিডিং এর জন্য। শাওন আর ওর গ্রুপ এক ছিল। ডাক্তারকে অনেক ভাবে বুঝিয়ে ও ২ ব্যাগ দিয়েছিল। আরও যোগাড় হয়েছিল ৬ ব্যাগ। কিন্তু এত রক্ত দেবার পরও কেন যেন মেয়েটার অভাব পূরণ হল না। এত জনের রক্তের বাঁধন ও ওকে ধরে রাখতে পারলো না। ও হারিয়ে গেলো দূরে, বহুদূরে। ও যত দূরে হারিয়ে গেলো এই বাচ্চা ছেলেটাকে তত বেশী মাত্রার কষ্ট উপহার দিয়ে গেল। সেই থেকে শাওন চুপ। একদম চুপ। শুধু যখন সে টিভি তে বা পত্রিকায় রক্ত চাই বিজ্ঞাপন দেখতো তখনি ছুটে যেত। বাঁধা দিয়েও লাভ হয়নি। এটুকুই ছিল ওর পাগলামি। কিন্তু সমস্যা শুরু হল একদিন। একবার রক্ত দিতে যেয়ে স্ক্রিন টেষ্টে ও HVB +ve (হেপাটাইটিস বি পজেটিভ) ধরা পরলো। কেউ বোঝেনি কিভাবে? হয়তো কোন ব্লাড ব্যাংক নামধারী রক্ত ব্যবসায়ীদের সেন্টারে রক্ত দিতে গিয়ে নিজের অজান্তেই সে বহন করে এনেছে বিষাক্ত জীবানু। এরপর থেকে আর কখনও রক্ত দেয়নি ও। তারপর ধীরে ধীরে ও আরও অবিন্যস্ত হয়ে যেতে থাকে। মাঝে মাঝে এভাবে হাসপাতালে এনে রাখতে হয় কিছুদিন।

এত কিছু শোনার পর আমি আর কিছুই ভাবতে পারছিলাম না। প্রচন্ড কষ্ট নিয়ে ইন্টার্নি রুমে চলে এসেছিলাম। কেন যেন শামীম কে খুব মনে পরছিল। খুব রাগ ও হচ্ছিল ওর উপর। গাধাটা কেন দেশে গেল? ফোন দিলাম ওকে। ধরলো না। মেসেজ পাঠালাম- ‘আজই চলে এসো’। ঠিক ১০ মিনিট পর দরজায় নক। দরজা খুলে খুবই অবাক হয়ে দেখলাম শামীম দাঁড়িয়ে আছে। মুখে লাজুক হাসি। লাজুক না ছাই। চুরি করে ধরা পরা চোরের মত লাগছিল ওকে। বুঝলাম সেদিন মিথ্যা বলেছিল বলেই ঝট করে ফোন রেখে দিয়েছিল।

ওর হাতটা ধরে টানতে টানতে নিয়ে গেলাম কলেজ ক্যাম্পাসে। সেখানে বন্ধু-র রক্তদান কর্মসূচী চলছে। ও খুবই অবাক হয়ে বললো

-‘কি ব্যাপার? এখানে হঠাৎ?’

-‘কেন তুমি কি ভেবেছিলে তোমাকে নিয়ে রমনা পার্কে যাব?’

-‘না মানে এখানে তুমি তো আসোনা। তাই’।

-‘কিছু না। একজনের প্রক্সি দিতে আসলাম’।

-‘মানে?? কার প্রক্সি?’

-‘আমার এক ছোট ভাইয়ের। সে এখন আর রক্ত দিতে পারে না’।

ও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো আমার দিকে। এবার গাধাটার হাত ধরে বললাম – ‘রক্ত দিতে পারি এক শর্তে’।

-‘কি শর্ত?’

-‘কোনদিন আমার হাতটা ছাড়তে পারবে না- এটা প্রতিজ্ঞা করতে হবে’।

শামীমের শ্যামলা মুখটা তখন লাল আভায় ভরে উঠেছে। ওর চোখে তখন সব কিছু জয় করার আনন্দ। হ্যাঁ আজ আমি প্রথম বারের মত রক্ত দিয়েছি। আজ থেকে শাওন নামে আমার ছোট ভাইটির পালন করতে না পারা দায়িত্ব আমি কাঁধে তুলে নিলাম।

latest video

news via inbox

Nulla turp dis cursus. Integer liberos  euismod pretium faucibua

Leave A Comment