ব্যর্থ মানুষের অব্যক্ত কষ্ট

Published On: May 7, 2012By Tags: , Views: 20

জীবনে অসংখ্যবার লিখেছি। অনেক গল্প আর কবিতার ভারে আমার লেখার খাতাটা ভরে আছে। কিন্তু ওখানে একটা অপূর্ণতা সবসময় ছিল। জীবনের সব থেকে বড়, পবিত্র আর মধুর সম্পর্কটা নিয়েই কখনো কিছু লেখা হয়নি। হ্যাঁ, আমি তোমার কথাই বলছি মা। তোমাকে নিয়ে কোনদিন লেখা হয়নি আমার। সবসময় তোমাকে পেয়েছি বলেই হয়তো বুঝিনি তোমার অভাব। মানুষ এমনই। তার সব থেকে প্রিয় আর মূল্যবান সম্পদের ব্যাপারে হয়তো সে সবসময় বেখেয়ালে থাকে। যখন সেই অসম্ভব প্রিয় সান্নিধ্য থেকে সে দূরে চলে যায় তখনি সে তার অভাব বুঝতে পারে। মা, তুমি ভাবছো আমি এসব কেন লিখছি। তুমি তো মরে যাওনি। তুমি বেঁচে আছো। ভালো আছো। কিন্তু তুমি কি জানো মা, এখন তোমার আমার দূরত্ব এত যে আমার মনে হচ্ছে আমি হারিয়ে ফেলেছি তোমাকে। আমি হারিয়ে ফেলেছি আমার সবকিছু।

তোমার সাথে প্রতিদিন কথা হয়। তুমি বেশিক্ষন কথা বলতে চাওনা। কারন যদি আমার খরচ আবার বেশী হয়। জীবনের শেষ প্রান্তে এসেও তুমি আমাকে নিয়ে সেই ভাবেই শংকিত হও, সেভাবেই আমার মঙ্গল কামনা কর যেভাবে চিন্তা করতে আমার জীবনের সূচনা লগ্নে।

মঙ্গল চিন্তার কথা বলছিলাম। হ্যাঁ মা, আমার জীবনের প্রতিটি কষ্টের সময়ে তুমি ঠিক আমার পাশে দাড়িয়েছো বিশাল একটা ছায়া হয়ে। সেই ছোটবেলা থেকে আজ পর্যন্ত কখনো আমাকে বুঝতে দাওনি আমি একা। যত ঝড় এসেছে আমার জীবনে, নিজের বুক পেতে মমতার আঁচলে ঢেকে রেখেছো আমাকে । আজও যখন আমার কন্ঠটা একটু বিচলিত শোনায় তুমি ঠিকই ধরে ফেলো। আমার দরকারের কথা জিজ্ঞেস করো। সকালে না খেয়ে ল্যাবে গেলে আগের মত করেই বকা দাও। সুন্দর করে বুঝাও। কিন্তু তারপরও আমি শূন্যতার মাঝে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে অঝোরে কাঁদি। আমার বারবার তোমার কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছা হয়। আবার তোমার হাতে মাখানো ভাত খেতে ইচ্ছা করে। তোমার রান্না চেখে তোমাকে বলতে ইচ্ছা করে, ‘মা, তুমি এত ভালো কিভাবে রাঁধো?’ আমি পারিনা কেন মা? আমি কবে যাবো তোমার কাছে? আমি আবার কবে তোমার পাশে শান্তিতে ঘুমাবো? আমি ভালো নেই মা। একদম ভালো নেই। আমার কানে বাজে তোমার পায়ের আওয়াজ। আমার চোখে ভাসে তোমার কাজ করার মুহুর্ত। আমার মনে পড়ে তোমার শাসন আর স্নেহের মিষ্টি হাসি। আবার কবে ফিরে পাবো সব? কবে মা???

তোমাদের ইচ্ছা ছিল আমি অনেক বড় হবো, অনেক প্রতিষ্ঠিত হবো। তোমাদের স্বপ্ন পূরনের জন্য আমি এসেছি তোমাদের ছেড়ে। কিন্তু তোমাদের স্বপ্নগুলোও যে আমারই সুখের জন্য, আমার সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য। এতটা ত্যাগ স্বীকার আর কেউ কি করতে পারে পৃথিবীতে?? আমি জানি পারেনা। আমি চেষ্টা করছি মা। অনেক কষ্ট করছি তোমাদের স্বপ্নগুলোকে সুন্দর বাস্তবে রূপ দিতে। ল্যাবে, কাজে সবখানে কষ্ট করছি। কিন্তু আমার এইসব কষ্ট কখনও গায়ে লাগেনা। আমার তখনি খুব খারাপ লাগে যখন রুমে ফিরে আমি শুনতে পাইনা তোমার সেই কথাটা যেটা আমি বাইরে থেকে আসলে তুমি বলতে। তুমি বলতে, ‘কি রে মুখটা এত শুকনা লাগছে কেন? সারাদিন খাসনি?’ এখন আমার মুখ যতই শুকনা দেখাক কেউ বলার নেই মা। এখন আমার মন খারাপ থাকলেও কেউ বলে না, ‘কি হয়েছে? মনে হচ্ছে কিছু নিয়ে অনেক চিন্তায় আছিস’। এখন আমার অনেক চিন্তা হলেও কেউ সেই চিন্তার অংশীদার হতে পারেনা তোমার মত করে।

ভাগ্যের কি খেলা দেখো মা! তোমাদের থেকে দূরে থাকবোনা, তোমাদের ছেড়ে যাবনা বলেই তো সবাই আমাকে ছেড়ে চলে গেলো। জীবনের সেই কঠিনতম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েও আমি এতটুকু ভেঙে পড়িনি সে সময়। তাওতো তোমার জন্যই। আমাকে সেই দুঃসহ যন্ত্রণাময় দিনগুলোতে একমাত্র তুমিই আগলে রেখেছিলে সব কষ্টের আঁচ থেকে।  বিছিন্নতার কষ্ট এতটুকু বুঝতে দাওনি। সমাজ, সংসার সব কিছুর বাঁকা দৃষ্টি থেকে আমাকে আপন ছায়ায় ঢেকে রেখেছিলে। কিন্তু আজ আমার জন্যই তোমাদেরকে ছেড়ে এত দূরে আসতে হলো। আজ আর পিছনে ফেরার সময় নেই। ভবিষ্যতের সফলতার পিছনে ছুটতে ছুটতে আমি হারিয়ে ফেলেছি মায়া আর আদরে জড়ানো বর্তমান। এটাই মনে হয় জগতের নিয়ম। স্বপ্নের মগডালে উঠতে গিয়ে বাস্তবতার শিকড় থেকে আমরা অনেক দূরে সরে যাই। মাঝামাঝি গিয়ে যখন ফিরে তাকাই তখন বুকের ভিতরটা মোচড় দিয়ে ওঠে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে চোখের জলের এখন বড়ই মাখামাখি মা।

কষ্টের কথা বলছিলাম, মা। মানসিক কষ্ট। তোমাদের থেকে দূরে থাকার কষ্ট। কিন্তু আমি জানি আমার থেকে তোমাদের কষ্ট বেশি। অনেক বেশি। কিন্তু প্রতিটি দিনই তোমরা বলো যে তোমরা ভালো আছো। হাসিমুখেই বলো। মোবাইলে কথা হলে বুঝতে পারি কন্ঠ শুনে। যখন স্কাইপে দেখি তখন তোমার চোখের দিকে তাকালেই বুঝতে পারি। তবুও আমার শান্তির কথা চিন্তা করেই তোমরা সব কষ্ট গুলোকে চাপা দিয়ে রাখো বুকের অতলে। চোখে পানি আসলে কাজের কথা বলে পিসির সামনে থেকে উঠে যাও। আমাকে একনজর দেখার জন্য আব্বু অনেক কষ্ট করে বিছানায় উঠে বসে। নিজে ঘুরে বসতে পারেন না। ঘাড় ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে যখন ভালো হাতটা নাড়ে তখন কষ্টে আমার বুকটা ফেটে যায়। মনে হয় ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরি হাতটা। আমাকে ক্ষমা করো বাবা আমি বড় হতে এসে মানুষ হতে পারলাম না। আমাকে ক্ষমা করো আম্মু। আমি তোমার কষ্টের সামান্য অংশও ভাগ করে নিতে পারলাম না। ছেলে হিসাবে এটা আমার সবথেকে বড় ব্যর্থতা।

আমি একজন ব্যর্থ মানুষ।

latest video

news via inbox

Nulla turp dis cursus. Integer liberos  euismod pretium faucibua

Leave A Comment