ভ্যালেন্টাইন উপহার
১
রাত ১ টা। প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে ডক্টরস ক্যান্টিনের চেয়ার টেনে বসে রাতুল। মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে ওর। ২ টা কারণে। ২ টার কোনটাই ওর নিজের তৈরী নয়। সমস্যা গুলো অন্যের আর তার জন্য কষ্ট ও করছে ভাবতেই মনটা আরও তিরিক্ষি হয়ে যায়। হটাৎ টেবিলে জোরে একটা ঘুষি মেরে বলে ওঠে ‘ধূর শালা’। আচমকা শব্দে কেঁপে ওঠে শূন্য ক্যান্টিন। দেয়ালের ওপাশ থেকে ভীত চোখে তাকিয়ে থাকে আবুল মিয়া। হটাৎ রাতুল দেখে ক্যান্টিনে সে একা নয়। মেডিসিনের মেডিকেল অফিসার জুয়েল ও আছে। নিজেকে একটু সামলে নেয় সে। জুয়েল তার ব্যাচ মেট।
পাশে এসে বলে – ‘ কিরে? হটাৎ কি হল?’
– ‘আর বলিস না, এই শীতে ভাল লাগে বল এইসব?’
– ‘কেন? ডিউটি কার? তোর নাকি বসের?’
– ‘বসের’ – চোখে মুখে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে বলে রাতুল।
– ‘সেদিন না উনার ২৪ ঘন্টা করলি। আজও নাইট দিসে তোকে?’
– ‘হুমম। শীতের রাতে কে কষ্ট করতে চায় বল? তার উপর ঘরে যদি নতুন বউ আর ডিপারটমেন্টে আমার মত বলদ থাকে’।
– ‘বুঝলাম’। বিজ্ঞের মত বলে জুয়েল। ‘তা ঘটনা কি শুধুই এইটা নাকি?’ –
– ‘হুমম আরও আছে’। গম্ভীর উত্তর রাতুলের। ‘ঝগড়া হইছে একটু আগে’।
– ‘অ্ আচ্ছা!!! কাহিনী তাহলে এখানে প্যাঁচ খাইছে?’ হাসতে হাসতে বলে জুয়েল।
ওর হাসি দেখে রাগে পিত্তি জ্বলে রাতুলের। যদিও জুয়েল ওর ভালো বন্ধু। তারপরও মনে মনে এখন সে খুব বিরক্ত ওর এই কথায়।
-‘আবুল মামা ২ টা চা দাও’। জুয়েলের কথায় নিজেকে ফিরে পায় রাতুল।
চা আসে। চুমুক দিয়ে রাতুল কে সহজ করার জন্য ওর কাঁধে হাত রেখে বলে – ‘এইটা কোনও ব্যাপার না। এরকম ঝগড়া তো হবেই। ঝগড়া না থাকলে তো সব কিছুই নিরামিষ। কাল কথা বলে সব কিছু ঠিক করে নিস’।
-‘এইবার ঝগড়ার ব্যাপারটা সিরিয়াস রে’। যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসে রাতুলের কন্ঠ। ‘ওর ফ্যামিলি চাচ্ছে বিয়েটা এখনি হয়ে যাক। আমি সেটা এখনি চাচ্ছি না’। কেমন যেন অসহায় দেখায় ওকে।
-‘কেন চাচ্ছিস না?’
-‘আচ্ছা তুই ই বল মাত্র ২ মাস এই অজপাড়া গায়ে এসে জুটলাম। দল ক্ষমতায় বলে এডহক এ নিয়োগ টা পেলাম। বস তো বলেই দিলেন ২ বছর এখান থেকে নড়া যাবেনা। তাহলে এই জংলা এলাকায় ওকে এনে রাখবো কিভাবে? আমি ছেলে মানুষ হয়ে নিজেই এখানে থাকতে ভয় পাই আর ওর কথা তো বলাই বাহুল্য’।
-‘তো ওকে তুই বুঝিয়ে বল’।
-‘আরে সেটা বুঝাতে গিয়েই তো মেজাজ খারাপ করে ঝগড়াটা হল’।
-‘তাহলে আর কি? কাল না হয়’ – কথা শেষ হয়না জুয়েলের। হটাৎ দরজায় ওয়ার্ড বয় মকবুল কে দেখা যায়। আমতা আমতা করে বলে – ‘স্যার সার্জারি কেস আইছে ১ টা। পেটে খুব ব্যাথা। বমি করতাছে’।
-‘ওই মিয়া তোমারে কে বললো সার্জারি কেস? পেটে ব্যাথা হলেই সার্জারি? যাও গাইনি ম্যাডাম রে গিয়া বল’। – ধমক দেয় রাতুল।
-‘স্যার রোগী তো পুরুষ। মকবুল মুচকি হাসে’।
কথা শুনে জুয়েল ও ফিক্ করে হেসে ফেলে। আর রাতুলের চেহারা টা হয় দেখার মতো।
-‘আসলে মকবুল ভাই এই ঠান্ডায় নতুন রোগী নিয়ে কে ঝামেলা করতে চায় বল? তুমি একটু ম্যানেজ কর। ব্যাথার ইঞ্জেকশন দাও। সকালে বস দেখে ব্যবস্থা করবেন’।
-‘স্যার রোগীটা পাশের গেরামের। অনেকক্ষন আসছে। ব্যাথার ইঞ্জেকশন দিছিলাম। কাজ হয় নাই। এই জন্যই রাতুল স্যার রে খুঁজতে খুঁজতে এখানে আইছি’।
-‘চল রাতুল আমি তোর সাথে যাচ্ছি। জুয়েল বুঝে রাতুল স্বাভাবিক হয়নি এখনো। একবার দেখেই আসি। বসের নাইট। কিছু হয়ে গেলে পরে বিপদে পরবো’।
নিতান্ত অনিচ্ছা স্বত্তেও রাতুল পা বাড়ায়। মনে মনে বসকে ১০১ টা গালি দেয় ও।
২
ওয়ার্ড এ তখন বেশ মানুষের জটলা। অনেকেই ভীড় করেছে ৪ নাম্বার বেডের কাছে। একটা মহিলার কান্না মাখা কন্ঠ শোনা যাচ্ছে।
-‘ও বাজান, ইট্টু ভালো লাগেনি বাজান? বাজান রে ব্যাথাটা কমছে নি? ও আল্লাহ্ ভালো কইরা দাও, ভালো কইরা দাও’।
-‘এই দেখি সরেন সব। নিজের রোগীর কাছে যান’। ধমক দেয় মকবুল। জুয়েল আর রাতুল আসে রোগীর কাছে।
১৮ বছর হবে ১ টা ছেলে। বিছানার কিনারায় বাম কাত হয়ে কুন্ডলী পাকিয়ে শুয়ে আছে। ঘামে ভিজে গেছে পুরো শরীর। চোখ টকটকে লাল।
ঠোঁটের কোনায় বমি মিশ্রিত লালা। পেটের ডান পাশে হাত চেপে ঘনঘন শ্বাস নিচ্ছে। মাথার কাছে আনুমানিক ৪০ বছরের একজন মহিলা পাখা হাতে বাতাস করছেন আর প্রাণপণে দোয়া করে যাচ্ছেন। চোখের দৃষ্টি উদ্ভ্রান্তের মতো। একটু দূরে ছোট্ট ১ টা পুতুল হাতে অল্প বয়সী একটা মেয়ে ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে ছেলেটার দিকে। হয়তো বোন হবে। ভাবে রাতুল। এইসব দেখতে দেখতে হঠাৎ জুয়েলের কথা কানে আসে ওর।
-‘তাহলে ব্যাথা গত ২ দিন ধরে। আর জ্বর ৩ দিন, তাইত মা’? জুয়েল রোগীর মায়ের সাথে কথা বলছে।
-‘হ ২ দিন ধইরা বাড়ছে। এর ২ মাস আগেও এরকম হইছিল। ৩ দিন আছিল। তারপর গেছিল গা। তয় এইবার কেমুন জানি খালি বাড়তাছে’।
-‘রাতুল! এই রাতুল!! আরে কি ভাবছিস তুই? এটা অ্যাপেন্ডিসাইটিস’।
-‘হুম। পুরানো হিস্ট্রি আছে ব্যাথার। আবার নতুন করে শুরু হয়েছে’। নিজের মনেই বলে যায় রাতুল। তারপর জুয়েলের দিকে তাকিয়ে বলে ‘সকাল এর আগে কিছুই করার নেই। বস সকালে যা করার করবে। এখন ডাবল ডোজ ডাইক্লফেনাক আই এম দিয়ে দেন মকবুল ভাই’। তারপর মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে- ‘আপনার ছেলের অপারেশন লাগবে। সকালের আগে হবেনা’।
কথাটা শুনে মহিলা কেমন যেন চুপশে যায়। শুধু করুন চোখে একবার রাতুলের দিকে আর একবার ছেলের দিকে তাকায়।
-‘দেখি ইনজেকশন দিয়ে কি হয়। আপনি সরে যান। ইনজেকশন দিতে দেন’। এই কথা বলে রোগীর পেটে হাত রাখে রাতুল। কেমন যেন কাঠের মতো শক্ত অনুভূত হয়। আনমনে কি একটা ভাবে সে। কিছু যেন বুঝার চেষ্টা করে। হারিয়ে যায় অতীতে। কবে যেন এমন কেস এর কথা ক্লাশ এ বলেছিলেন সাঈদ স্যার। মনে করতে পারে না সে।
কেন যে সে সময় ক্লাশ গুলো বাদ দিতো আড্ডা, মিটিং আর মিছিলে ভাবে রাতুল। প্রাক্টিক্যাল জ্ঞানের অভাব বাস্তব জীবনে হাড়ে হাড়ে বুঝতে পারে সে প্রতিনিয়ত। সামান্য অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশনের ঝুকিটুকুও সে এখন নিতে পারছেনা। অথচ ১০০ বেডের এই থানা হাসপাতালের সার্জারি বিভাগের দায়িত্বে আছে সে। সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মকবুল ইনজেকশন দেয়া শেষ করে। রাতুল দেখে ইশারা করে জুয়েল তাকে ডাকছে বারান্দায়।
-‘দোস্ত একবার মনে হয় ট্রাই করা দরকার’। জুয়েলের কন্ঠে উৎকন্ঠা।
-‘না। সাহস পাচ্ছিনা রে’।
-‘তাহলে বাদ দে। ওর কপালে যা আছে তাই হবে। চল। রাত ২ টা বাজে। কোয়ার্টারে ফিরে যাই। সকালে দেখা যাবে’।
আনমনে রাতুল পা বাড়ায় জুয়েলের সাথে। কি মনে করে পিছনে ফিরে দেখে পুতুল হাতে ছোট্ট মেয়েটা বোবা চোখে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। আবার নিজের অসহায়ত্ব বুঝতে পারে সে। ডাক্তারি যে দল করে, ক্ষমতার জোরে হয়না সেটা উপলব্ধি করে। হয়তো পাস করা যায় কিন্তু কালের বাস্তবতায় মানুষের জীবন বাচানো যায়না। ছিনিমিনি খেলা যায় মাত্র। ভোঁতা একটা অনুভূতি গ্রাস করে ওকে। নিজের রুমে এসে এপ্রন টা খুলে চেয়ারে ছুড়ে ফেলে। সাথে সাথে একটা ঘটনা ওর মনে পড়ে যায়। বেশিদিন আগের কথা নয়। যেদিন ওর ফাইনাল প্রফের রেজাল্ট দিলো সেদিন খুশিতে এপ্রন পরে ও গিয়েছিলো অপরাজিতার সাথে দেখা করতে। চলে আসার আগে অপরাজিতা ওর এপ্রন এর কোনা ধরে বলেছিল – ‘এর মর্যাদা রাখতে পারবে তো?’
আচমকা নিজের উপরে রাগ হয় ওর। অপরাজিতার কথা মনে পড়লো কেন ওর? এখন না ঝগড়া চলছে। কাপড় পালটে শুয়ে পড়ে সে। নাইট ডিউটি চুলায় যাক। ভাবে রাতুল।
৩
রাতুল ওটি তে যাচ্ছে। কেন যাচ্ছে তা সে নিজেও জানে না। শুধু এক অদ্ভুত আকর্ষনে ও এখন ওটির ভিতরে। অপারেশন টেবিল। একজন রোগী শুয়ে আছে। মাথার উপরে অসংখ্য লাইট। জুয়েল ব্যস্ত হাতে গ্লাভস পড়ছে। নার্স মিনা আর মকবুল ভাই ও আছে। রাতুল বুঝে পায়না জুয়েল এখানে কি করছে? আর ওই বা কেন এই সময়ে ওটি তে। অপারেশনটাই বা কার? দেখার জন্য রোগীর দিকে তাকায় ও। হটাৎ ওর সমস্ত অস্তিত্ব কেঁপে ওঠে চেহারাটা দেখে। একবার ঝাকুনি খায় ও। রোগী আর কেও না ওর অপরাজিতা। কিন্তু কিছুতেই ও ভেবে পায়না অপরাজিতা এখানে কেন? অপারেশন টেবিলেই বা কেন? ও কিছুই ভেবে পায়না। ভাবতে ভাবতেই ও যা দেখে তাতে ও দিশেহারা হয়ে যায়। জুয়েল অপারেশন শুরু করেছে। এইতো ও মাত্র পেটে গ্রীড আয়রন ইনশিসন দিলো। এরপর যেন কি করবে? রাতুল দেখে জুয়েল ইতস্তত করছে। এই ব্যাটা এইবার মাসল টা রিফ্লেক্ট কর। তাড়া দেয় রাতুল। কিন্তু জুয়েল ওর কোন কথা শুনছে বলে মনে হয় না। জুয়েল বিপি ব্লেড দিয়ে মাসল কাটা শুরু করে। রাতুল আতঙ্ক নিয়ে দেখে জুয়েল মাসল কেটে বড় একটা আর্টারি ও কেটে ফেলেছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে পুরো অপারেশন এরিয়া। মিনা প্রাণপণে গজ দিয়ে রক্ত মুছে যাচ্ছে। মকবুল ভাই পাগলের মতো আর্টারি ফরসেপ খুজে যাচ্ছেন। জুয়েলের হাত থরথর করে কাঁপছে। রক্ত এখন অপারেশন টেবিল বেয়ে নিচে পড়ছে। ফোঁটা ফোঁটা রক্ত দেখে রাতুলের কান্না পায়। এটা ওর অপরাজিতার রক্ত। যার প্রতিটা বিন্দুকে সে অসম্ভব ভালবাসে। রাতুল হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। জুয়েল আর্টারি ফরসেপ দিয়েও রক্ত বন্ধ করতে পারছেনা। রাতুল প্রাণপণে মনে করার চেষ্টা করে আন কন্ট্রোল ব্লিডিং হলে কি করতে হবে। না ওর কিছুই মনে পড়ছে না। হঠাৎ মনিটরে বিপ বিপ শব্দ বেড়ে যায়। রাতুল দেখে অপরাজিতার প্রেসার কমে যাচ্ছে। ১২০, ১০০, ৯০, ৮০। আর বেড়ে যাচ্ছে হার্টবিট। ১২০,১৪০,১৫০। রাতুল পাগলের মতো জুয়েল কে ধাক্কা দেয়। -‘দোস্ত ও আমার অপরাজিতা। জুয়েল কিছু কর ভাই’। কান্নায় ভেংগে পড়ে রাতুল। জুয়েল কিছুই করতে পারে না। বিপি এখন ৬০, হার্টবিট ১৮০। মনিটরে চোখ বুলিয়েই রাতুল চোখে অন্ধকার দেখে। মাথাটা ঘুরে ওঠে ওর। চোখে ভাসে অপরাজিতার হাসিমাখা মুখ আর কানে আসে ওর সেই কথাটা – ‘এপ্রন এর মর্যাদা রাখতে পারবে তো?’ শেষ বারের মতো রাতুল চিৎকার করে ওঠে – ‘জুয়েল কিছু একটা কর’।
৪
হঠাৎ রাতুল শোনে জুয়েল ওকে ডাকছে। ‘এ্যাই রাতুল! রাতুল!! কি হইছে? চিৎকার করছিস কেন?’
-‘হুমম – না – কিছু একটা কর’ বলেই চোখ মেলে রাতুল।
-‘বাজে স্বপ্ন দেখছিলি না?’ রাতের আবছা আলোয় জুয়েলের মুখটা চোখে পরে ওর। সাথে সাথে মনে পড়ে সবকিছু। স্বপ্ন দেখছিল ও। খুব বাজে স্বপ্ন।
নিজেকে সামলে নিয়ে জুয়েল কে বলে- ‘সরি দোস্ত – তোর ঘুম নষ্ট করলাম। যা ঘুমাতে যা। আমি ঠিক আছি। বাজে স্বপ্ন ছিল একটা’।
-‘হুমম বুঝলাম। কিন্তু আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গেছিলাম তোর চিৎকার শুনে। আবার ঘুমানোর চেষ্টা কর’। উঠে যায় জুয়েল।
বাথরুমে যেয়ে চোখে মুখে পানি দেয় রাতুল। বাইরে আবছা আলোয় অন্ধকার আরও গাঢ় দেখায়। রুমে এসে বিছানায় বসতেই শুনতে পায় ঘুন পোকার কাঠ কাটার আওয়াজ। কাঠের কথা মনে হতেই বিদুৎ চমকের মতো ওর মনে পড়ে যা সে ওয়ার্ডে মনে করতে পারেনি। হ্যাঁ আরে এমনই তো ছিল সেই রোগীর অবস্থা। বমি, জ্বর, প্রচন্ড পেটে ব্যাথা আর আর কাঠের মতো শক্ত পেট। তারমানে ইন্টেস্টাইনাল পারফোরেশন। হুম এরও তাই হয়েছে। পেটের নাড়ী ফুটো হয়ে গেছে অ্যাপেন্ডিক্স এর কারণে। তারমানে অপারেশন এখন আর অপশণ নয়, ইজ এ মাস্ট। আর কিছু ভাবতে পারে না সে। ঝটপট উঠে দাঁড়ায়। মোবাইলে দেখে ৩.৩০। অনেক সময় চলে গেছে। খুব দ্রুত রেডি হয়ে এপ্রন হাতে নেয়। মনে মনে ভাবে হ্যাঁ অপরাজিতা এই এপ্রন এর মর্যাদা আমি রাখবো। জুয়েল কে ডাকতে যেয়েও থেমে যায়। আজ অনেক বিরক্ত করা হয়েছে ওকে। নিজের কর্তব্য ঠিক করে নেয় সে। না অপারেশন সে নিজে করবে না। কিন্তু দ্রুত অপারেশন এর ব্যবস্থা সে করবে। খুব তাড়াতাড়ি মকবুল কে খুজে বের করে।
-‘মকবুল ভাই ৪ নং বেডের ছেলেটাকে সদরে নিতে হবে’।
-‘স্যার এইডা কি কন? এই শীতের রাতে ৪০ মাইল দূরের সদরে কে নিবো ওরে? ক্যামনে নিবো? কিসে কইরা নিবো???’
-‘হুমম সেটাই তো ভাবছি। আচ্ছা এই গ্রামে না একজনের ১টা মাইক্রোবাস আছে। ভাড়ায় চালায়’।
-‘হ আছে। কিন্তুক এত রাইতে সেতো যাইবো না। আর যদি যাইতে চায় ও তাও ম্যালা টাকা চাইবো। হাজার দুই এর কম না। কেডা দিবো এত ট্যাকা? ওগো কাছে তো ৫০০ ট্যাকাও নাই’।
-‘হুমম। বুঝলাম। তুমি এক কাজ কর, রোগীর কথা বলে আর আমার কথা বলে মাইক্রোওয়ালারে এখনই আমার কাছে নিয়ে আসো। পরেরটা পরে’।
মকবুল কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে রাতুলের দিকে। তারপর চুপচাপ চলে যায়। রাতুল জানে মকবুল ড্রাইভার আর মাইক্রো নিয়ে ফিরবে। কিন্তু টাকা? রাতুল এবার ওয়ার্ডের দিকে পা বাড়ায়। কাছে আসতেই বমির শব্দ শুনতে পায়। দরজাতে চোখে পরে সেই বাচ্চা মেয়েটা পুতুল টাকে খুব শক্ত করে বুকের কাছে আঁকড়ে ধরে আছে। যেন পুতুলটা কোথাও হারিয়ে না যায়। রাতের বুক চিরে কয়েকটা কুকুরের সম্মিলিত কান্নার শব্দ যেন খুব অশুভ কোনো বাণী নিয়ে আসছে। রাতুল অপেক্ষা করে মকবুলের।
মকবুল ড্রাইভার কে নিয়ে এসেছে। ড্রাইভারের সাথে কথা বলে রাতুল। কি কথা হয় জানে না মকবুল। শুধু আজকের রাতুল কে দেখে সে বেশ অবাক হয়। গত ২ মাসে কোনো রোগী নিয়ে তো এত বিচলিত দেখায়নি তাকে। মকবুলের চিন্তা বাঁধা পরে রাতুলের ডাকে।
-‘মকবুল ভাই ছেলেটাকে পিছনে আড়াআড়ি শুইয়ে দাও। তুমি সামনে বসো। আমি পিছনে আছি’।
সবাই ওঠার পর রাতুল মনে মনে বলে ‘আল্লাহ্ আর ২০ টা মিনিট সময় দাও’। মুখে বলে –‘মা আপনি আপনার ছেলের হায়াতের জন্য দোয়া করেন। মায়ের দোয়া বৃথা যায় না’।
মা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।
৫
সদর হাসপাতালে নেবার পর দলের পরিচয় আর বসের পরিচয় এ বাকি কাজ খুব সহজেই করে রাতুল। এই প্রথম সদর হাসপাতালের সবাই অবাক হয়ে দেখে এই শীতের রাতে এপ্রন পরা একজন ডাক্তার নিজে রোগী নিয়ে আসছে এক অজপাড়াগা থেকে। রোগীকে ওটি তে দিয়ে রাতুল যখন ফিরছে তখন ভোরের আলো দেখা যাচ্ছে দূর দিগন্তে। এক অপার্থিব ভালোলাগায় আছন্ন হয় ওর মন। মনে এক অজানা অকৃত্রিম প্রশান্তি। রুমে এসে পুরানো মানিব্যাগ থেকে বের করে জমানো ২০০০ টাকা। তিনদিন পর তার ঢাকা যাবার কথা। টাকাটা রাখা ছিলো আসছে ভ্যালেন্টাইন’স ডে তে অপরাজিতাকে গিফ্ট দেবার জন্য। আনমনে হেসে টাকাটা ড্রাইভারকে দেয় সে। মোবাইলটা নিয়ে অপরাজিতাকে মেসেজ পাঠায়।
‘এতদিন পর আমি আজ একটু হলেও আমার এপ্রন এর মর্যাদা রাখতে পেরেছি। বদলে যাওয়া এই আমি আর জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলাদের দলে নেই’।
৩ দিন পর ঢাকায় অপরাজিতার সামনে দাঁড়ায় সে একগুচ্ছ লাল গোলাপ হাতে। রাতুলের চোখে পরিবর্তনের ছোয়া দেখে অপরাজিতা। রাতুলের হাতটা নিজের হাতে নিয়ে শুধু একটি কথায় বলে – ‘এটাই আমার সবথেকে বড় ভ্যালেন্টাইন উপহার’।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua