সোফি- এ লিটল ম্যাজাই
প্রতি শনিবার আমি বাচ্চাদের একটা জগতে কাজ করি। এই জগতটা সাধারণ বাচ্চাদের মত নয়। এই জগতের সব বাচ্চারা শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী। এই বাচ্চাদের জন্য এখানে বেশ কিছু স্কুল আছে। প্রতি শনিবার আমি একটা স্কুলে যাই। ওখানে বাচ্চারা আসে। আমার দায়িত্ব হলো দিনের ৫টা ঘন্টা আমার দায়িত্বে থাকা বাচ্চাগুলোর দেখাশোনা করা। ওদের খাওয়া-দাওয়া থেকে শুরু করে টয়লেট সব কিছুর দায়িত্ব থাকে আমার এবং আমার মত আরো যারা কাজ করে তাদের উপর। এই ৫টা ঘন্টা আমরাও ওদের মত ছোট বাচ্চা হয়ে যাই। জীবনের জটিল সমীকরণ গুলো ওরা বোঝে না। ওরা চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলায় খুব সাধারণভাবে। ওদের মত করে। আমি যে অর্গানাইজেশনের হয়ে কাজ করি ওদের তালিকাভুক্ত বাচ্চার সংখ্যা প্রায় ১০০। এই বাচ্চাদের মধ্যে ২ জনকে নিয়ে আমার এই লেখা। একজন ছেলে। নাম রবার্ট। অন্যজন একটা মেয়ে। ওর নাম সোফি। রবার্টের বয়স ১৩। সোফির ১২। দুজনই শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী। রবার্টের একটা হাত ও পায়ে সমস্যা। সে হুইল চেয়ারে চলাফেরা করে। মাঝে মাঝে একপায়ে লাফিয়ে হাটার চেষ্টা করে। যে হাতে সমস্যা সেই হাতে সে কিছু ধরতে পারেনা। সোফির সমস্যা হলো ওর লার্নিং ডিফিকাল্টিস। এই দুজনের কথা বলছি কারণ আমাদের সবার কাছে এরা খুব পছন্দের। রবার্ট ও সোফি দুজন দুজনকে খুব পছন্দ করে। সোফি রবার্টকে সবার কাছে নিজের বয় ফ্রেন্ড বলে পরিচয় করিয়ে দেয়। প্রতি শনিবার সোফি আমাকে একটা কথা অনেকবার বলে। কথাটা হলো, রবার্ট তার বয়ফ্রেন্ড তাই তার সাথে যেনো আমি দুষ্টামি না করি। রবার্টের উপর অধিকার তার। আমরা জানি না ভালোবাসা নামের অনুভূতিটার সাথে তার কতটুকু পরিচয় আছে। কিন্তু ওর এই মজার কথা গুলো আমাদের অনেক আনন্দ দেয়। আমরা প্রতি শনিবার লাঞ্চের সময়টা খুব উপভোগ করি। ওরা পাশাপাশি বসে। নিজেদের খাবার বের করে প্রথমে একসাথে রাখে। তারপর ভাগ করে। রবার্ট একটূ বেশী দুষ্টূ। সে নিজের কিছু খাবার লুকিয়ে রাখে। তারপর ভাগাভাগি করে খাওয়া শেষে নিজের খাবার একা একা খায়। সোফি এই চালাকি ধরতে পারেনা। রবার্টের সাথে থাকাটাই তার কাছে অনেক আনন্দের।
অন্যসব শনিবারের মত আজো আমার কাজ ছিল। যে কথাটা বলার জন্য এত ভূমিকা টানলাম সেই ঘটনাটা আজ ঘটেছে। এমনিতেই এখন ইংল্যান্ডের আবহাওয়া খুব খারাপ। তার উপর সকাল থেকে বৃষ্টি। ১০ টা বাচ্চা আসার কথা থাকলেও এসেছে ৬টা। নিয়ম হলো সকাল ১০টায় ওরা আসবে। দুপুর ৩টা পর্যন্ত আমাদের সাথে থাকবে। আজ সকালে ঠিক ১০টায় সোফি এসেছে। আসার পরে প্রতিদিনের মত আজো আমাদেরকে একই কথা বলেছে। সব কিছু ঠিক মতই চলছে। বাচ্চা কম আসায় আমরাও একটু আরামে আছি। ঠিক সাড়ে ১০টার দিকে সোফি আমার কাছে এসে বলছে, “রবার্ট কোথায়??” আমি বললাম, “আজ তো বৃষ্টি তাই রবার্ট আসেনি।” সোফি কিছু না বলে চুপচাপ চলে গেছে। আজ ও আমার দায়িত্বে ছিলো না। আমিও আর ওর ব্যাপারে মাথা ঘামাচ্ছি না। আমি ব্যস্ত আমার মত। বেশ কিছুক্ষন পর সোফি আবার আসলো আমার কাছে। এবার সে আমার হাত ধরে নিয়ে আমাকে টেনে নিয়ে গেলো স্কুলের ছবির বোর্ডের কাছে। সেখানে রবার্টের একটা ছবি আছে। ছবিটাতে হাত রেখে সে আমাকে বলছে, ” I miss him”. আমি ওর মন খারাপ করা শুকনো মুখের দিকে বেশ কিছুক্ষন তাকিয়ে থেকে বললাম, “আজ তুমি আমাদের সাথে খেলো এরপরের শনিবারে ও আসবে”। সোফি এটা শুনে আবার চলে গেলো। আমি এবার একটু অবাক হলাম। ওর মধ্যে ভালোবাসা ব্যাপারটা কিভাবে কাজ করছে ভাবতে থাকলাম। কিছুক্ষন পর আমি আবার সোফির কথা ভুলে গেলাম। লাঞ্চের সময় হয়ে গেলে আমি কেন যেনো সেই ছবির বোর্ডটার দিকে তাকালাম। অবাক হয়ে দেখলাম সোফি বোর্ডের সামনে দাঁড়িয়ে একভাবে রবার্টের ছবির দিকে তাকিয়ে আছে। ওর কাছে যেয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখ ভিজে গেলো। ওর চোখের করুন দৃষ্টিতে শুদ্ধ ভালোবাসার অদ্ভুত কষ্ট মেশানো এক আঁধারের ছায়া। আমার তখন কেবল একটা কথাই মনে হলো, এভাবে ভালোবাসতে আমরা মানসিক ভাবে সুস্থ্যতা দাবী করা মানুষগুলো কেন পারিনা??
পরিশিষ্টঃ আমাদের অনেক চেষ্টা স্বত্তেও আমরা আজ সোফিকে ওর লাঞ্চের অর্ধেকও শেষ করাতে পারিনি।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua