Amour (ভালোবাসা)

Published On: December 28, 2012By Tags: , , Views: 66

মে, ১৭৭৯ এর মধ্য বিকেল। ব্রেইন এর নামী মিলিটারি প্রশিক্ষন স্কুলের ক্লাশরুমে সদ্য কৈশোরে পা রাখা এক ছাত্রের ভীষণ মন খারাপ। তার সহপাঠিরা তাকে আজ যথেষ্ট বিরক্ত করেছে। বিরক্ত করার কারণ আর কিছু না- তার কর্সিকান টানে ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ। সে চিন্তা করেও নিজের কোন দোষ খুঁজে পাচ্ছেনা। আর পাবেই বা কীভাবে। কর্সিকান শহর তার জন্মের মাত্র ১ বছর আগে মানে ১৭৬৮ সালে জেনোয়া প্রজাতন্ত্র থেকে বের হয়ে ফ্রান্সের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এত অল্প সময়ে কর্সিকান-রা কীভাবে খাঁটি ফ্রেঞ্চ উচ্চারণ রপ্ত করবে?? নিজের সহপাঠিদের উপর একগাদা রাগ নিয়ে সে লাইব্রেরীতে বসে বসে মানচিত্র দেখছে। আচ্ছা, আটলান্টিকের ওপারে যেতে হলে কি করতে হবে?? সে এতদিনে জেনেছে যে আটলান্টিকে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করছে ইংলিশ রয়্যাল নেভি। তার খুব ইচ্ছা সে বড় হয়ে রয়্যাল নেভিতে যোগ দেবে। তার কানে বাজছে কয়েকদিন আগে বলা তার একজন শিক্ষকের কথা। “তুমি তো অংকে, ভূগোলে আর ইতিহাসে ভালো। তুমি ভালো নাবিক হতে পারবে”। সন্ধ্যার একটু পরে রাতের খাবার খেয়ে একাডেমির নিময়মত যখন সে বিছানায় গেলো তখনো তার চোখে আটলান্টিকের ঢেউ এর লাগাম টেনে দিগ্বিজয়ী হবার স্বপ্ন। তখনো সে জানতো না অনাগত ভবিষ্যত তার জন্য কী চমক নিয়ে অপেক্ষা করছে।

১৭৮৪ সালের এক বিকেলে নাবিক হবার স্বপ্ন ছেড়ে দিয়ে সে এসে যোগ দিলো ইকোল মিলিটারি একাডেমিতে। তাকে এখন শিখতে হচ্ছে আর্টিলারির কলা-কৌশল। সাগরের নোনা বাতাসের পরিবর্তে বারুদের ধোঁয়া আর কামানের গোলা এখন তার নিত্যসঙ্গী। মন ভেঙে গেলেও হেরে যাওয়ার মানসিকতা তার মধ্যে নেই। তাই সে এখন খুব মনোযোগের সাথে ব্যবহারিক জ্ঞান অর্জন করছে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। সেনাবাহিনীতে থাকাই তার উজ্জ্বল ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। কিন্তু হঠাৎ করেই তার জন্য পরিস্থিতি কঠিন হয়ে উঠলো। বাবা মারা যাওয়ায় দুই বছরের কোর্স তাকে একবছরে শেষ করতে হচ্ছে। তার উপর এদের এখানে পাস করাটাও একটা কঠিন কাজ। ল্যাপলাস (ফিজিক্সের অনেক সূত্রের জনক) সাহেবের মত বিজ্ঞানীর হাত থেকে পাস মার্ক পাওয়াটাও যে ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু ঐ যে অদম্য ইচ্ছা শক্তি – যার জন্য সে রাতে দিনে মাত্র ৪ ঘন্টা ঘুমানোর অভ্যাস করে দুই বছরের কোর্স একবছরে শেষ করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে, সেই ইচ্ছা শক্তিকে তো আর ল্যাপলাস আটকাতে পারবেন না। সুতরাং সে পাস করে গেলো অনায়াসেই। ছোট বেলা থেকেই এই ইচ্ছা শক্তি আর মনের জোরে হালকা পাতলা গড়নের কিশোর ১৭৮৫ এর সেপ্টেম্বরে মাত্র ১৬ বছর বয়সে হয়ে গেলো ‘লা ফেরে’ আর্টিলারি রেজিমেন্টের সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট। শুরু হলো অসাধারণ কিন্তু সংগ্রামী, সাফল্যমন্ডিত আবার হতাশার এক অনবদ্য জীবনের রোলার কোস্টার। শুরু হলো ফরাসী বিপ্লবের শিশু ‘নেপোলিয়ন বোনাপার্ট’ এর যুগ।

ফরাসী বিপ্লবের কিছু সময় পরের কথা। তরুণ নেপোলিয়ন তখন পরিবার সহ প্যারিসে চলে আসতে বাধ্য হয়েছেন। বিপ্লবের পরিণতি হিসাবে অসংখ্যবার ক্ষমতার পালাবদলে বিপ্লবের সমর্থক শক্তি এখন ক্ষমতায়। এই সময়ে বিপ্লবে নেপোলিয়নের ভূমিকার জন্য তাকে ‘তুলন শহর’ দখলে পাঠানো সামরিক বাহিনীর আর্টিলারি বিভাগের প্রধান করা হয়েছে। ঠিক এই সুযোগের অপেক্ষাতেই ছিলেন নেপোলিয়ন। ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে হলে তাকে এখন এই যুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। কিন্তু কিভাবে?? ‘তুলন’ শহর এখনো বিদ্রোহীদের দখলে। গোদের উপর বিষফোঁড়া হিসাবে তাদেরকে মদদ দিচ্ছে ব্রিটিশ বাহিনী। একসময় যে দেশের নৌবাহিনীতে যোগ দেবার স্বপ্ন দেখতেন আজ সেই তাদের বিরুদ্ধেই তাকে কামান দাগতে হবে। কিন্তু নিজের উচ্চাশা বলেও কথা। আর তাছাড়া ব্রিটিশ জাতটাই বা কেমন? এটা ফ্রান্সের নিজেদের মামলা। তোমরা বাপু ঘরের খেয়ে এত দূরে মোষ তাড়াতে কেন এসেছো?? নিজেদের দেশে কি তোমাদের মোষের অভাব পরেছে?? এত কিছু ভাবতে ভাবতে হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো শহরের ঠিক আগে একটা পাহাড়ের উপর। বিদ্যুত চমকের মত মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে গেলো নেপোলিয়নের। এই পাহাড় দখল করে এখান থেকে কামানের গোলায় সে খুব সহজেই বিদ্রোহীদের ঘাঁটি আর ব্রিটিশ জাহাজ উড়িয়ে দিতে পারবে। কিন্তু তার আগে পাহাড়টাতো দখল করতে হবে। ওদিকে যে আবার কিছু শত্রু সৈন্য দেখা যাচ্ছে পাহাড়ের আশেপাশে। কিন্তু জিততে হলে তাকে এখন ঝুঁকি নিতেই হবে। সহজাত এই যুদ্ধ বুদ্ধির কারণেই নেপোলিয়ন খুব অল্প কিছু সৈন্য নিয়ে নিজেই পাহাড় দখল করতে গেলো। কারণ সে বুঝতে পেরেছিলো পুরো বাহিনী নিয়ে যেতে যে পরিমাণ সময় লাগবে ততক্ষনে শত্রু পক্ষ নিজেদের প্রস্তুত করার সুযোগ পেয়ে যাবে। ঝুঁকি কাজে দিলো কিন্তু নিজের উরুতে আঘাতের বিনিময়ে। তাতে কি? পাহাড়ের মাথায় কামানতো বসানো গেছে। চূড়ায় উঠে নেপোলিয়ন নিজেই আপন মনে হেসে উঠলো। বাছাধনেরা এবার যাবে কোথায়?? নেপোলিয়নের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলায় ব্রিটিশ রয়্যাল নেভি পিছু হটতে বাধ্য হলো। বিদ্রোহীদের ঘাঁটি ধ্বংস করে যতক্ষনে নেপোলিয়ন বেশ খোশ মেজাজেই পায়ের যত্ন নিতে বসলেন ততক্ষনে প্যারিসে এই বীরত্বের কাহিনী পৌছে গেছে। মাত্র ২৪ বছর বয়সে নেপোলিয়ন বোনাপার্ট হয়ে গেলেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

সবই ঠিক আছে। কিন্তু কী যেন থেকেও নেই। কোথায় যেনো একটা শূণ্যতা। সাথে আরো উপরে ওঠার তাড়না। সবমিলে খুব অস্থির কাটছে তার সময়। এই অস্থিরতা নজর এড়ালো না বড় ভাই জোসেফের। বুঝতে পারলেন ছোট ভাইকে জীবনে সুস্থির করা দরকার। হাতের কাছেই মেয়ে ছিলো। সুন্দরী, সাথে সম্ভ্রান্ত এবং সবথেকে বড় কথা ধনী প্রভাবশালী পরিবারের মেয়ে। তার উপর আবার তার শালী। এতো সোনায় সোহাগা। ড্রেসেরি ক্লারি-কে পরিচয় করিয়ে দেয়া হলো নেপোলিয়নের সাথে। নেপোলিয়ন সবদিক বিচার করে দেখলেন, না, মন্দ হয়না। তাছাড়া এর মধ্যে ক্ষমতায় আবার পরিবর্তন এসেছে। তাকে সুনজরে দেখা রবসপিয়েরস এখন ক্ষমতার বাইরে। তাকে অর্টিলারির ব্রিগেডিয়ার থেকে ডিমোশন দিয়ে পদাতিক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার করা হয়েছে। কাজেই এখন এই প্রভাবশালী পরিবারের সাথে সম্পর্ক তার পায়ের নিচে মাটি শক্ত করবে। নেপোলিয়ন বাগদান সেরে ফেললেন। যদিও এটা কতটা তাকে মানসিক শান্তি দিয়েছিলো তা তর্ক সাপেক্ষ। কিন্তু এত কিছু ভাবার সময় কোথায় তার? তাকে ‘ভ্যান্ডি’-র যুদ্ধে যাবার আদেশ দেয়া হয়েছে। কিন্তু নেপোলিয়নকে যেতে হবে তার জন্য অমর্যাদাকর পদাতিক বাহিনীর কমান্ডার হিসাবে। প্রবল আত্নমর্যাদার অধিকারী মানুষটা বেকে বসলো। সোজা না করতে না পেরে একটু ঘুরিয়ে না করে দিলো। কারণ হিসাবে শারিরীক অসুস্থতাকে উল্লেখ করে চিঠি লিখে বসে থাকলো। এই অসম্ভব ব্যস্ত জীবনে পাওয়া অবসর সে কাজে লাগালো রোমান্টিক উপন্যাস লিখে। নায়ক একজন সৈনিক আর নায়িকা এক ধনীর দুলালী। ক্লারি খুবই খুশি। এ যে তার আর নেপোলিয়নেরই কাহিনী। নেপোলিয়নের জীবনে প্রেমের বাতাসের আনাগোনা এই শুরু। সেই বাতাস প্রবাহিত হয়েছিলো তার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত।

হঠাৎ বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত যুদ্ধে যাবার আদেশ পালন না করায় নেপোলিয়নকে সামরিক বাহিনীর জেনারেলদের তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দিলো শাসক গোষ্ঠী। দিনটি ছিলো ১৫ই সেপ্টেম্বর ১৭৯৫। কিন্তু এবার নেপোলিয়ন ভাগ্যের সহায়তা পেলো অদ্ভুত ভাবে। ঠিক তার আঠারো দিনের মাথায় বিরুদ্ধে বিপ্লবের কারণে ক্ষমতাচ্যুত রাজতন্ত্রের সমর্থকরা শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করলো। ফ্রান্সের আকাশে আবার অস্থিরতার বাতাস। শাসনের কেন্দ্রবিন্দু ‘তুলেরিস প্রাসাদ’ হুমকির মুখে। ন্যাশনাল কনভেনশন (শাসক গোষ্ঠী) এর প্রভাবশালী নেতা ‘পল ব্যারাস’ চিন্তিত মুখে বারান্দায় পায়চারী করছেন। তার মাথায় নানা শংকা ঘুরপাক খাচ্ছে। পদাতিক বাহিনীর মাধ্যমে প্রাসাদ রক্ষার চিন্তা তার কাছে ফলপ্রসূ মনে হচ্ছেনা। কিন্তু বিকল্প কোথায়?? গোলন্দাজ বাহিনীর নেতৃত্ব দেবার মত কেউ তো নেই। হঠাৎ তার মনে হলো নেই মানে?? হাতের কাছেই তো একজন আছে। কিন্তু তাকে কি ঠিক বিশ্বাস করা যায়??? না করেই বা উপায় কি। সে এই কাজের জন্য সবথেকে দক্ষ। ‘তুলন’ যুদ্ধের কথা কি ভোলা যায়?? নাহ! ডাকতেই হচ্ছে ছোকড়াকে। সুতরাং খবর গেলো নেপোলিয়নের কাছে। জরুরী তলব। দেশ রক্ষায় তাকে আবার তার পছন্দের গোলন্দাজ বাহিনীর একটা অংশের কমান্ড দেয়া হচ্ছে।

নেপোলিয়ন এই অপেক্ষাতেই ছিলেন। সাথে সাথে সব ভুলে বেড়িয়ে পরলেন। সবার আগে তার দরকার একজন দক্ষ কিন্তু তরুণ অফিসার। যাকে দিয়ে সে তার গোলন্দাজ বাহিনীকে আবার বিন্যস্ত করবেন। পেয়েও গেলেন একজনকে। ‘জোয়াকিম মুরাত’-কে (পরবর্তীতে তিনি নেপোলিয়নের এক বোনকে বিয়ে করেন এবং নেপোলিয়নের শাসন আমলে একজন কমান্ডার হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন) দিয়ে আবার সব ঢেলে সাজালেন। ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু ‘তুলেরিস’ প্রাসাদের ভিতরে যখন নেপোলিয়ন পা দিলেন তখন তার দুচোখে ঘোর বিষ্ময়। তুলেরিস প্রাসাদ তাকে দুহাত বাড়িয়ে স্বাগত জানালো। কে জানতো এই প্রাসাদে আগমন নেপোলিয়নের জীবন পালটে দেবে। কে ভেবেছিলো এর প্রতিটি ইট-পাথরে কান পাতলে আজো শোনা যাবে নেপোলিয়ন-জোসেফাইনের বাঁধ ভাঙ্গা হাসির প্রতিধ্বনি। ৫ই অক্টোবর, ১৭৯৫। ‘তুলেরিস প্রাসাদ’ আক্রান্ত হলো। যুদ্ধ করছেন নেপোলিয়ন। যে যুদ্ধ সম্পর্কে কার্লাইল লিখেছেন, “সে এমন ভাবে যুদ্ধ করলো যেনো মনে হলো একটা বাচ্চা ছেলে একমুঠো আঙ্গুরের আঘাতে একদল দুষ্টু বালককে পরাজিত করলো। নেপোলিয়ন গোলন্দাজ বাহিনীর এক ধাক্কায় বিদ্রোহীদের দখল করার ইচ্ছা চিরতরে ধ্বংস করে দিলেন। কিন্তু নিজে চিরতরে বাঁধা পরলেন এক অদ্ভুত মায়ার জালে। এই তুলেরিস প্রাসাদে, ১৭৯৫ এর অক্টোবরে।

2

প্যারিসের আকাশে এখনো সূর্য্য ডোবেনি। শেষ বিকেলের রোদে অলস মেঘের দল ভেসে যাচ্ছে দূর দিগন্তে। শহরের অভিজাত এলাকার এক ছিমছাম বাংলোর বারান্দায় বসে আছে ৩২ বছরের এক মধ্যবয়স্কা নারী। আকাশে মেঘের খেলা দেখতে দেখতে সে ভাবছে তার অনাগত ভবিষ্যত নিয়ে, ভাবছে তার সন্তান্দের জীবন নিয়ে। আজকের এই নির্ভার জীবন, এই বিলাস, চাকর-বাকর, সম্মান, আভিজাত্য এসব কিছু যখন থাকবেনা তখন সে কী করবে?? না থাকার কারণ তার এসব কিছুর উৎস সে নয়। প্যারিসের সমাজে তার যে পরিচয় আর তার যে অবস্থান সেটাও তার নিজের অর্জন নয়। সে বুঝতে পারছে পল ব্যারাস তার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সে এখন বেশী ব্যস্ত কমবয়সী সুন্দরী টেরেস কে নিয়ে। ইদানিং এখানে সে তেমন একটা আসেনা। যদিও ব্যারাস এখন নিজের গদি সামলাতেই বেশী ব্যস্ত। শোনা যাচ্ছে রয়ালিস্টরা নাকি আবার ক্ষমতা দখল করার জন্য ‘তুলেরিস’ আক্রমন করবে। কী যে শুরু হচ্ছে চারিদিকে। সবকিছুতো ঠিক মতই চলছিলো। মেঘের ফাঁকে এখন আর সূর্য্য দেখা যাচ্ছেনা। পশ্চিম আকাশের লাল আভা জানিয়ে যাচ্ছে কিছুক্ষন আগেও সূর্য্য ছিলো। যেভাবে তার মুখের কয়েকটা বলিরেখা তাকে বলে যাচ্ছে ‘তোমার যৌবন ছিলো’। কথাটা মনে হতেই একরাশ হতাশা এসে ভর করে তার মনে। আজকের প্যারিসে তার মূল্য এখনো আছে। কিন্তু সেই মূল্যের কারিগর তার যৌবন আর পল ব্যারাস। সেখানে ৩২ বছর বয়সের ২ বাচ্চার মা বিধবা মারি জোসেফ রোজ বোয়ানে-র নিজস্বতার কোন ভূমিকা নেই। আটলান্টিকের হীম হীম বাতসে অক্টোবরের এই ঠান্ডায় বারান্দায় বসে থাকা রোজ বোয়ানে বুঝতে পারছে তার হাতে সময় বেশী নেই। পল ব্যারাসের সাথে তাকে কথা বলতেই হবে। বাড়ি রঙ করার বিলটা সে এখনো কেন পরিশোধ করেনি সেটা জানা দরকার। ছেলের ডাকে ঘরে চলে যায় রোজ।

“দেখো পল, আমি বুঝতে পারছি তুমি আর আগের মত আমার প্রতি আকর্ষনবোধ কর না”। গলায় সবটুকু আকুতি নিয়ে কথা বলছে রোজ।

“রোজ, ব্যাপারটা সেরকম নয়। আমি নিজেই খুব সমস্যায় আছি। তুমিতো জানোই আবার কি শুরু হয়েছে”। পল ব্যারাস অসহিঞ্চু এবং কিছুটা বিরক্ত।

“তুমি কি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে পল। তোমার কম বয়সী বান্ধবী টেরেসের কাছে?”

“আরে নাহ। টেরেস কম বয়সী ঠিক কিন্তু বিছানায় তোমার মত সে কখনো হতে পারবে না। আমি আসবো। ঝামেলাটা মিটে গেলেই আমি তোমার বাসায় ডিনার করতে আসবো ডিয়ার”।

“কথা দিচ্ছো?? আমি তোমার জন্য তোমার সবথেকে প্রিয় খাবার রান্না করবো পল”।

“রোজ, আমার সবথেকে প্রিয় খাবারতো তোমার চুমু। হা হা হা”।

পল ব্যারাসের এই কৃত্রিম হাসিই রোজকে আবার মনে করিয়ে দেয় সময় শেষ হয়ে আসছে। যে কথা বলার জন্য এই তুলেরিস প্রাসাদে ছুটে আসা সেকথা না বলেই বাড়ির পথ ধরে রোজ। আজকের সকালটা এমন গুমোট কেন?? বাতাসে বারুদের গন্ধ। অক্টোবরের এই প্রথম সপ্তাহে অন্যসময় হলে রাস্তা-ঘাটে মানুষ গিজগিজ করতো। আর কিছুদিন পরেই ক্রিসমাস। কিন্তু সবকিছু কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা। দুই ঘোড়ায় টানা গাড়িতে বসে পর্দা সরিয়ে প্যারিসের রাস্তার দৃশ্য দেখতে দেখতে যাচ্ছে রোজ বোয়ানে। হঠাৎ তার চোখে পড়লো একটা বাড়ির সামনে দুটো বোন গোল হয়ে বসে হাড়ি পাতিল সাজিয়ে খেলা করছে। হতাশার চাঁদরে ঢাকা জীবনে এই সামান্য দৃশ্য তার কাছে অসামান্য আনন্দের বলে মনে হচ্ছে। সে হারিয়ে গেলো তার অতীতে। তার ছেলে বেলায়। তার প্রিয় মার্টিনিক দ্বীপে।

ক্যারাবিয়ান সাগরের কোল ঘেষে থাকা ওয়েস্ট ইন্ডিজের এক ছোট্ট দ্বীপ মার্টিনিক। ব্রিটিশ শাসনে থাকলেও কেন যেন ফরাসি প্রভাব সেখানে অনেক বেশি। বাবা-মা আর তাদের তিন বোনের সেই ছেলেবেলার জীবন অনেক সুখের ছিল। প্রাচুর্য্য কোন কালেও ছিলো না কিন্তু খেয়ে পড়ে তাদের বেশ চলে যেতো। সমস্যা শুরু হলো একটা হারিকেনের পর থেকে। অন্যসবার মত সেই হারিকেন তাদের জীবনকেও লন্ডভন্ড করে দিয়ে গেলো। মার্টিনিক তখন ধবংসস্তূপ। খাবার নেই, বেঁচে থাকার অবলম্বন নেই। জীবন চালানো বড় দায়। ছোট্টবেলার সেই চরম দূরাবস্থার জন্য বুঝতে শেখার পর থেকে দারিদ্যকে চরম ঘৃণা করে এসেছে সে। কিন্তু তার পক্ষে দারিদ্র্যকে জয় করা সম্ভব হতনা কোনোদিন যদি ভাগ্য তাকে সুযোগটা না দিতো। হ্যাঁ সুযোগইতো। কী হবার কথা ছিলো আর কি হলো। তার মনে পড়ছে সেই দিনটার কথা। যেদিনে চরম শোকের মাঝেও তাকে বউ সাজতে হয়েছিলো। মাত্র ১২ বছর বয়সে তাকে চলে আসতে হয়েছিলো প্যারিসে। তার স্বামীর হাত ধরে। যে হতে পারতো তার মেজো বোনের স্বামী। তার দুলাভাই।

তার বড়বোন এমি আসলেই খুব বুদ্ধিমতী। অসাধারণ সৌন্দর্য্য ছাড়া, বড় অংকের যৌতুক দেবার ক্ষমতা না থাকা স্বত্তেও কীভাবে করে সে প্যারিসের প্রভাবশালী ফ্রাংকো ডি বোয়ানের মিস্ট্রেস হয়েছিলো তা আজও তার কাছে এক বিষ্ময়। পরের ঘটনাতো ইতিহাস। এমির কারণেই তার পরিবার ফিরে পেয়েছে স্বচ্ছলতা। কোন রকমে বেঁচে থাকার অবলম্বন। ক্যাথিরিনের বিয়ে ঠিক করেছিলো এমি নিজেই। ফ্রাংকোর ছেলে আলেকজান্ডার বোয়ানের সাথে। বাবার কথা শুনে আলেকজান্ডার আর না করেনি। কিন্তু নিয়তি যে তা চায়নি। তাইতো বিয়ের মাত্র দুদিন আগে ক্যাথিরিন মারা গেলো কিছু বুঝে ওঠার আগেই। প্রচন্ড শোকে রোজ তখন দিশেহারা। খবর গেলো প্যারিসে। ক্যাথিরিন নেই। বিয়ে হচ্ছে না। এবারো সেই এমিই হাল ধরলো। বোয়ানে পরিবারকে কিছুই জানতে দিলো না সে। মার্টিনিকের মানুষ দেখলো এক অদ্ভুত দৃশ্য। বোনের শেষকৃত্য অনুষ্ঠান শেষ করেই এক মেয়ে বিয়ের সাঁজ সাঁজতে বসেছে। চোখের পানিতে ধুয়ে যাচ্ছে তার মুখের রঙ। কিন্তু তবুও সে নিরুপায়। তাকে যে সাজতেই হবে। আর কিছুক্ষন পরেই তাকে প্যারিসে যেতে হবে এমির সাথে। পারিস, তার স্বপ্নের প্যারিসের এক চার্চে বিয়ের সাজে রোজ অপেক্ষা করছে আলেকজান্ডারের জন্য। আলেকজান্ডার এলো। মেয়েকে দেখে চমকে তাকালো। এতো ক্যাথিরিন নয়। এতো রোজ। ১২ বছরের রোজ। ক্যাথিরিন কোথায়?? এবারো সেই এমিই সামাল দিলো। বুড়ো ফ্রাংকোকে চোখের পানিতে ভিজিয়ে সে তাকে দিয়ে আলেকজান্ডারকে রাজি করালো। বাবার ভয়ে রাজি না নয়ে উপায় ছিলো না আলেকজান্ডারের। প্রচন্ড হতাশা আর একরাশ বিষাদ নিয়ে ১৭৭৯ সালে বিয়ে হলো রোজ আর আলেকজান্ডারের। সেদিন থেকে রোজ হয়ে গেলো রোজ বোয়ানে। নাম পরিবর্তনের সাথে সাথে এই ঘটনা বদলে দিলো তার মানসিকতা। সেদিন থেকে রোজ বুঝলো জগতে টাকা এমন একটা জিনিস যা বোনের মৃত্যু শোক কে বিয়ের আনন্দে পরিণত করার ক্ষমতা রাখে। ঠিক সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সে এই টাকার পূজা করে চলেছে।

স্বামীর সাথে তার সম্পর্ক কখনই ভালো ছিলো না। উচ্চাশা, বিলাস আর নেশার জীবনে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া রোজ তখন প্যারিসের অনেকের কাছেই আকাঙ্খিত সংগ। তখন তার যৌবনের নদীতে উপচে পড়া ঢেউ। সবাই সেই জলে নামতে চায়। কিন্তু সে সবাইকে সে সুযোগ দেয়নি। প্যারিসের প্রভাবশালী খুব অল্প কিছু মানুষের সেই সৌভাগ্য হয়েছিলো। আহা কি সুন্দর দিন গুলোই না ছিলো তখন। আলেকজান্ডারকে তখন আর খুব একটা দরকার হয়নি রোজের। উপরে ওঠার সিড়িটা সে ততদিনে খুঁজে পেয়ে গেছে। আলেকজান্ডার ছিলো সেই সিঁড়ি দেখিয়ে দেওয়া এক পথ প্রদর্শক মাত্র। যদিও বোয়ানে পরিবারকে সে খুব একটা নিরাশ করেনি। দুটো সন্তান সে আলেকজান্ডারকে উপহার দিয়েছে। সবকিছু তার মনের মতই চলছিলো। গোলমালটা বাধালো এই ফরাসি বিপ্লব। ১৭৮৯ এর সেই চরম বিভীষিকা মনে পরলে আজো তার গায়ে কাটা দেয়। রক্ত, আগুন, ধ্বংস আর অভিজাত পরিবারের মানুষদের মৃত্যুর সেই মিছিলে তো তারও যোগ দেবার কথা ছিলো। আলেকজান্ডারকে যেদিন গিলোটিনে নেয়া হলো সেদিন মানুষটার জন্য অনেক করুণার জন্ম হয়েছিলো তার মনে। বেচারা জীবনে তার ভালোবাসা পায়নি। কিন্তু খুব বেশীক্ষন সে আলেকজান্ডারকে নিয়ে ভাবার সুযোগ পায়নি। তার কিছুক্ষন পরেই তাকে গ্রেফতার করে আটকে রাখা হলো প্যারিসের এক জেলখানায়। কি অসম্ভব কষ্টের আর চরম আতঙ্কের দুটো সপ্তাহ পার করতে হয়েছে তাকে। প্রতিটি ক্ষনে তার মনে হয়েছে এবার তার পালা। প্রতিটি পায়ের শব্দ শুনে ভয়ে ভয়ে সে ভেবেছে এবার যমদূত বুঝি সত্যি সত্যিই এলো। মানসিক দূরাবস্থার একেবারে শেষ পর্যায়ে একরাতে এলো পল ব্যারাস। তখনো রোজ ভাবতে পারেনি তার জন্য মুক্তির ঘোষণা নিয়ে এসেছে বিপ্লবীদের প্রভাবশালী এই নেতা। পল ব্যারাস তাকে মুক্তি দিলো। তবে এক শর্তে। যে শর্ত না মানার মত বোকা ছিলো না রোজ। খুশি মনেই সে উঠে বসলো পল ব্যারাসের সুসজ্জিত ঘোড়ার গাড়িতে। সেদিন থেকে আজ পর্যন্ত সেই পল ব্যারাসের ঘোড়ার গাড়িতেই সে বসে আছে। রোজ পেয়েছে তার সেই আগের জীবন। উদ্দাম ফূর্তি শেষে বিছানায় যাওয়া, সমাজের উঁচু স্তরের মানুষদের সাথে উঠাবসা, বিলাসী জীবন আর প্রভাবশালীদের মাধ্যমে নিজের কাজ করে নেয়া। আর কিছুই তার চাওয়ার ছিলো না জীবনের কাছে। পল ব্যারাস তাকে ব্যবহার করেছে নিজের মত করে। মাঝে মাঝে অন্যদেরকেও সে এই অমৃত সুধার ভাগ দিয়েছে শুধু মাত্র তার নিজের স্বার্থে। রোজ না করেনি। কখনো কিছুই বলেনি। কারণ রোজের কাছে বাতি নেভানোর পরে সব পুরুষকেই একই রকম মনে হয়েছে। সবাইকে যেমন তার একই রকম লেগেছে তেমনিভাবে তার সম্পর্কে সবাই শুধু একটা কথাই বলেছে, ‘তুমি অসাধারণ রোজ। তোমার মত কেউ নেই এই প্যারিসে’। রোজ নিজেও জানে সে কথা। কিছুদিন আগ পর্যন্ত সে নিজেকে নিয়ে দুশ্চিন্তা করেনি। কিন্তু আজ ১৭৯৫ এর অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে প্যারিসের রাস্তায় চলতে চলতে তার মনে হচ্ছে মেঘে মেঘে অনেক বেলা হয়ে গেছে। ৩২ বসন্ত পার করা এই যৌবনের বাতাসে নতুন মাদকতার ছোঁয়া নেই বললেই চলে। রোজ চিন্তিত। গভীর ভাবে চিন্তিত।

ভাবনার জাল ছিড়ে গেলো গাড়িচালকের ডাকে। কোচ থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকেই সে দেখতে পেলো রঙের বিল হাতে মিস্ত্রি দাঁড়িয়ে আছে। রোজের মনেহচ্ছে পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে শুরু করেছে। এই সামান্য বিল দেবার মত টাকাও এখন তার কাছে নেই। পল বেশ কিছুদিন এখানে আসছেও না আর টাকার ব্যবস্থাও করছে না। এখন কী করবে রোজ??

তুলেরিস প্রাসাদের লাইব্রেরি। পল ব্যারাস চিন্তিত। তার চিন্তিত হবার কোন কারণ অবশ্য নেই। দুদিন আগেই নেপোলিয়ন বিদ্রোহীদের সমূলে উৎখাত করেছে। বর্তমান ফ্রান্সের শাসক গোষ্ঠীর মধ্যে সবথেকে ক্ষমতাবান ব্যক্তিটির নাম পল ব্যারাস। তবুও সে চিন্তিত। চুরুটে টান দিয়ে ভদকার গ্লাসটা ভরে সে তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। কী খোজার চেষ্টা করছে তা সে নিজেও জানে না। সে শুধু বুঝতে পারছে আপাতত নেপোলিয়ন আর রোজকে নিয়ে সে কিছুটা হলেও বিব্রত। ইতিমধ্যেই সাধারণ জনগনের কাছে নেপোলিয়ন জনপ্রিয় হতে শুরু করেছে। এটা একটু হলেও চিন্তার বিষয়। ওদিকে রোজের পিছনে প্রতিমাসে শুধু শুধু অনেকগুলো টাকা তাকে নষ্ট করতে হচ্ছে। প্লিজেন্ট রোডের বাড়িটার প্রতি এখন আর তেমন কোন আকর্ষন সে বোধ করেনা। কিন্তু রোজকে সে ছেড়েও দিতে পারছেনা। ইতিমধ্যে সেও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের কাছে বেশ পরিচিত একটি নাম। কী করা যাতে পারে ভাবতে ভাবতেই তার ব্যক্তিগত সহকারী এসে জানালো যে আগামী পরশুর পার্টির সমস্ত আয়োজন শেষ হয়েছে। দাওয়াত দেবার কাজও শেষ। রাতের শেষভাগে একটা ভালো খবর পেয়ে খুশি মনে বিছানায় গেলো বিপ্লব পরবর্তী ফ্রান্সের সবথেকে ক্ষমতাধর মানুষ পল ব্যারাস।

রোজ সেই দুপুর থেকে নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। অনেকদিন পর আজ আবার সে নিজের মধ্যে একটা উত্তেজনা অনুভব করছে। বিল্পবের ঝামেলার জন্য তো এতদিন ভালো কোন পার্টির আয়োজন হয়নি। তুলেরিসের এই পার্টি আবার তাকে পল ব্যারাসের কাছাকাছি পৌঁছে দেবে বলেই তার বিশ্বাস। ফ্রান্সের বিভিন্নস্তরের প্রভাবশালী লোকদের মুগ্ধ দৃষ্টি তাকে ছুঁয়ে যাবে এটা সে নিশ্চিত। পুরুষের চোখের সমস্ত ভাষা তার মুখস্ত হয়ে গেছে। আজ তার জন্য অনেক বড় একটা সুযোগ। সে জানে সে আহামরি সুন্দরী নয়। কিন্তু নিজেকে কীভাবে আকর্ষনীয় আর মোহনীয় করে তুলতে হয় তা তার ভালোই জানা আছে। রোজ অপেক্ষা করে আছে ঘোড়ার গাড়ির জন্য। সে আজ বেছে বেছে সাদা সিফনের হালকা কাজ করা পোশাক পড়েছে। অডি কোলনের শেষ ফোঁটা টুকু নিজের গায়ে ঢেলে দেবার ফাঁকে সে একবার নিজেকে আয়নায় দেখে নিল। নাহ, কে বলবে তার বয়স এখন ৩২। অভ্যস্ত হাতে সে খুব যত্ন করেই মুখের বলিরেখাগুলো ঢেকে দিয়েছে। কোচ আসার শব্দ শুনে দ্রুত উঠে দাড়ালো রোজ। আজ একদম ভুল করা যাবেনা। আজকের এই পার্টি তার কাছে খুব বেশী গুরুত্বপূর্ণ। বের হবার আগে আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে একবার ঈশ্বরকে ডেকে গাড়িতে উঠে বসলো সে। পশ্চিমের একটা ঝড়ো বাতাস বয়ে গেলো হঠাৎ করে। আজকের রাতে ভালোবাসার ঝড় উঠবে সে ব্যাপারে রোজ নিশ্চিত।

নেপোলিয়ন কিছুতেই নিশ্চিত হতে পারছেনা যে এই পোশাকে তাকে পার্টিতে মানাবে কিনা। জীবনের বেশীরভাগ সময় নিজের ভাগ্যের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা ২৬ বছরের জাতিতে কর্সিকান মননে ফ্রেঞ্চ তরুণ এধরনের বিলাসে অভ্যস্ত নয়। সকালে একবার ভেবেছিলো সে যাবেনা। দুপুরের দিকে তার মনে হলো ব্যাপারটা ঠিক হচ্ছেনা। নেপোলিয়ন বুঝতে পারছে সে উপরে উঠার সিঁড়ির খোঁজ পেতে চলেছে। প্যারিস, মার্শেই, লীলে সব জায়গায় তার নাম এখন সাধারণ মানুষের আলোচনার বিষয়। তুলনের সেই বিস্ময়কর বিজয়ের চেয়ে কিছুদিন আগের তুলেরিস রক্ষায় তার অভূতপূর্ব কৌশল মানুষকে অনেক বেশি প্রভাবিত করেছে। এ অবস্থায় তার এই পার্টিতে উপস্থিত থাকা অত্যন্ত জরুরী। এছাড়াও পল ব্যারাসের কাছে নিজের ইচ্ছার কথাটাও তো বলতে হবে। ইতালিতে ফ্রেঞ্চ বাহিনী যে অস্ট্রিয়ার সামান্য প্রতিরোধকে অতিক্রম করতে পারছেনা তার জন্য তো ঐ মাথামোটা জেনারেলরা দায়ী। তার একান্ত ইচ্ছা সে ইতালিতে ফরাসী বাহিনীর প্রধান হিসাবে নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু পল ব্যারাস আর তার সহযোগীদের নির্দেশ ছাড়া সেটা সম্ভবনা। নেপোলিয়ন ঠিক করলো সে পার্টিতে যাবে। শেষ বিকালের নরম রোদে মলিন পোশাক, কাঁদা মাখা বুট, আর মাথায় একটা চৌকোনা হ্যাট পড়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলো নিয়তির সন্তান- ফরাসি বিপ্লবের শিশু।

 

“রোজ, মাই ডার্লিং- আজ তোমাকে এত সুন্দর লাগছে কেন??” পল ব্যারাসের কন্ঠে কৌতুক।

“ওহ পল, আজকের দিনে আমার যা কিছু সব তো তোমার জন্য”।

কথাটা বলেই রোজ তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে থাকে পল ব্যারাসের চোখের দিকে। সে জানে তার প্রতি পলের যদি এখনো কোন আকর্ষন থেকে থাকে তাহলে তার চোখের তারা উজ্জ্বল হবেই। কিন্তু সেখানে সেরকম কিছুই দেখা গেলো না। রোজ বুঝলো আজকের দিনটা তার নাও হতে পারে। নিজেকে সামলে সে এগিয়ে গেল কোনার সোফার দিকে। পল ব্যস্ত অন্যদিকে।

পার্টি জমে উঠেছে। বেশিরভাগ পুরুষ আর মহিলা এখন নাচের ফ্লোরে। এমন একটা অবস্থায় হালকা পায়ে হলরুমে ঢুকলো নেপোলিয়ন। মাথার দুইপাশ দিয়ে এলিয়ে পড়া চুলগুলো একহাতে সড়িয়ে সে খুঁজতে শুরু করলো পল ব্যারাসকে। অনেকেই তার দিকে কেমন অদ্ভুতভাবে তাকাচ্ছে। নেপোলিয়ন এদের এভাবে তাকানোর কারণ বুঝতে পারছেনা। সে সোজা সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গেলো। সিঁড়ির মুখে একটা ছোট জটলা। ঐ তো পলকে দেখা যাচ্ছে। দ্রুত পায়ে পলের কাছে পৌঁছে সে দেখলো সে বেশ ব্যস্ত।

“আরে নেপোলিয়ন যে। এসো এসো”।

সাদর এই আমন্ত্রণে নেপোলিয়ন একটু ধাতস্থ হল। একগ্লাস কমলার জুস নিয়ে সে পল ব্যারাসের পাশে এসে দাঁড়ালো।

“কি ব্যাপার বোনেপার্ট, তুমি নাচের ফ্লোর ছেড়ে এই দোতলায়?? নিচে মনের মত কাউকে পাওনি বুঝি?? আরে নিচে চেয়ে দেখ প্যারিসের সব সুন্দরীদের মেলা বসেছে আজ তুলেরিসে। যাও। খাও, দাও আর ফুর্তি কর”।

নেপোলিয়ন বুঝলো পল এখন খুবই হালকা মেজাজে আছে। এখন কাজের কোন কথা বলে লাভ হবেনা। কিন্তু সে নিচে যেয়ে করবেটা কি?? সে তো নাচতে পারেনা। জীবনের এই দিকটি নিয়ে সে কখনো ভাবেনি। তার সময় কেটেছে যুদ্ধের পরিকল্পনা করে। নারীদের সম্পর্কে ভাবনা বলতে তার মাথায় শুধু ক্লারি নামটাই আসে। জীবনে অন্যকোন মেয়ে এখনো আসেনি। আর নারী ব্যাপারটা তার সাথে ঠিক যায় না। আনমনে নিজের সাথে কথা বলতে বলতে ইতস্তত হাঁটার মাঝখানে হঠাৎ পল ব্যারাসের ডাকে সে চমকে উঠলো। একদম কানের কাছে এসে পল বলছে,

“জেনারেল বোনাপার্ট, তোমার নিঃসঙ্গতা দূর করার জন্য দেখো কে এসেছে”। পল ব্যারাস তার পাশে দাঁড়ানো একজন রমনীর দিকে ইংগিত করতেই যন্ত্রচালিতের মত নেপোলিয়ন তার দিকে তাকালো। জমকালো ড্রেস পড়া আয়ত চোখ আর গোলগাল মুখের একজন রমনী। আহামরি সুন্দরী সে নয়। তবুও তার উপর থেকে চোখ সড়াতে পারছেনা কেন সে??

পল বলে যাচ্ছে, “জেনারেল বোনাপার্ট ইনি হলেন, মাদাম রোজ বোয়ানে। প্যারিসে তার তুলনা শুধু সেই”।

নেপোলিয়নের কানে কথা ঢুকছেনা। সে তাকিয়ে আছে রোজের চোখের দিকে। কেমন বিষন্ন একজোড়া চোখ। তার মুখে কষ্টের একটা গাঢ় ছায়া। কি বলতে চাই এই বিষন্ন চোখজোড়া?? গোলাপী ঠোঁটের কোনায় যে হালকা হাসি তার অর্থ কি?? সাধারনের মাঝেও কেমন যেন একটা আকর্ষন, কি যেন একটা মায়া। নেপোলিয়নের মনে হল এই মানবীর পুরোটা জুড়ে যে রহস্য তার অর্ধের রহস্যও যুদ্ধ ক্ষেত্রে নেই।

পল ব্যারাস তীক্ষ্ম চোখে তাকিয়ে আছে নেপোলিয়নের দিকে। ঘোর লাগা চোখের দৃষ্টি, চোখের মণির প্রসারণ, একটু একটু করে কেঁপে ওঠা ঠোঁট আর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম – এসব কিছুই তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে নেপোলিয়ন প্রথম দেখাতেই রোজের প্রতি মুগ্ধ হয়ে গেছে। হালকা একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেই মিলিয়ে গেলো পলের ঠোঁটে। মাথায় খেলে গেল খুব চমৎকার একটা বুদ্ধি। আজকের দিনের এই পার্টির সবথেকে বড় উপহার সে পেয়েছে এই মুহুর্তে। তার দুই সমস্যার সমাধান যে একবিন্দুতে এসে মিলবে তা সে ধারণা করেনি কখনো। উপরে তাকিয়ে মনে মনে ইশ্বরকে ধন্যবাদ দিয়ে সে ভাবছে এই সুযোগ খুব সতর্কতার সাথে কাজে লাগাতে হবে। এমন সুযোগ আর নাও পাওয়া যেতে পারে। নেপোলিয়নের এই মুগ্ধতা কাজে লাগিয়ে রোজকে নিজের কাঁধ থেকে সড়াতে হবে। দরকার হলে নেপোলিয়নকে লোভ দেখাতে হবে আর রোজকে ভয়।

“মাদাম রোজ বোয়ানে, ইনি জেনারেল বোনাপার্ট। বর্তমানে উনাকে নিয়ে প্যারিসে অনেক প্রশংসাসূচক কথা হচ্ছে। আপনি হয়ত শুনে থাকবেন। আপনারা কথা বলুন। আমি একটু পরেই আসছি”।

রোজ কি করবে বুঝতে পারছেনা। তার সামনে যে দাঁড়িয়ে আছে তাকে এই পার্টিতে একদম মানাচ্ছে না। কেমন ভাঁজ পড়ে যাওয়া একটা মলিন পোশাক পড়ে সে এখানে এসেছে। পায়ের বুটে যে ধুলো কাঁদার আস্তর সে তাও মনে হয় জানেনা। সবথেকে বড় কথা এই মানুষটার গায়ের রঙ হলদেটে আর সে সাধারনের তুলনায় অনেকটুকু বেঁটে – যে দুটো জিনিসকে রোজ সবথেকে বেশী অপছন্দ করে। কিন্তু এখন ভদ্রতা করে হলেও এর সাথেই তাকে কিছুটা সময় কাটাতে হবে। তবে একটা ব্যাপার বুঝতে পেরে সে বেশ পুলকিত আর তা হলো এই জেনারেল তার সাথে প্রথম দেখাতেই প্রবল ঘোরের মধ্যে চলে গেছে। তারমানে পুরুষকে আকর্ষন করার ক্ষমতা এখনো তার আছে। রোজ কথা শুরু করে।

“জেনারেল বোনাপার্ট, পার্টি কেমন লাগছে??”

“ভালো”। নেপোলিয়নের সরল উত্তর।

“আপনি কি নাচের ফ্লোরে যেতে চান??”

“না”।

নেপোলিয়নের এই কাটা কাটা উত্তরে রোজ যথেষ্ট বিরক্তি বোধ করছে। সম্ভ্রান্ত মহিলাদের সাথে কীভাবে কথা বলতে হয় এই লোকের দেখি সেই জ্ঞানটুকুও নেই। প্রবল বিরক্তি আর একরাশ হতাশা নিয়ে রোজ আবার এগিয়ে গেলো কোনার সোফার দিকে। পিছনে না ঘুরেও সে বুঝতে পারছে নেপোলিয়ন নামের গেয়ো ভূতটার দৃষ্টি তাকে অনুসরণ করছে।

ঠিক একই সময় দোতলার বারান্দা থেকে এই দৃশ্য দেখে মনে মনে যথেষ্ট আনন্দ অনুভব করছে আরো একজন মানুষ। সে হলো পল ব্যারাস। সে ঠিক করেছে আজ রোজকে বাসায় পৌঁছে দেবার দায়িত্ব সে নেপোলিয়নকে দেবে। তাকে অনেক বড় একটা ঝামেলা থেকে মুক্তি দেবার জন্য এটা নেপোলিয়নের প্রাপ্য হয়ে গেছে। নিজের প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ হয়ে শ্যাম্পেনের বোতলের দিকে হাত বাড়ায় পল ব্যারাস। এখন সে এই খুশি উদযাপন করতে পারে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত মনে।

ক্লারি-র খুব মন খারাপ। আজ ভোর বেলাতেই কেন যেন ঘুমটা ভেংগে গেল। ঘুম ভাঙা চোখে তার প্রথম যে কথাটা মনে হলো তা হচ্ছে অনেকদিন নেপোলিয়নের সাথে তার যোগাযোগ নেই। সেই কবে তার সাথে দেখা হয়েছিলো প্যারিসের রাস্তায় সে ভুলতেই বসেছে। ভোরের মৃদু আলোয় বাগানের এক কোনায় একটা দোয়েল পাখি দেখে তার মনে হলো সেও ঐ পাখিটার মত নিঃসঙ্গ। সে ঠিক করলো নেপোলিয়নের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবে। বাম হাতের অনামিকায় আটকে থাকা আংটির রঙ ধূসর হয়ে যাচ্ছে কি??

ক্লারির আংটির রঙ ধূসর হয়ে গেলেও নেপোলিয়নের স্বপ্নের ক্যানভাসে এখন হাজার রঙের খেলা। গতরাতে প্লিজেন্ট রোডের বাসায় সে কাটিয়েছে তার জীবনের স্মরণীয় রাত। যদিও খুব ভোরেই চলে এসেছে সে। ইতালিতে ফ্রান্সের অবস্থা খুব একটা ভালো না। সে চিন্তিত যে শেষ পর্যন্ত না অস্ট্রিয়ার বাহিনী তাদের অবস্থান আরো শক্ত করে ফেলে। এতসব সমস্যার মাঝেও সে শুধু জোসেফিনের কথা ভাবছে। হ্যাঁ, জোসেফিন। রোজ বোয়ানের নাম সে দিয়েছে জোসিফিন। এত চমৎকার হতে পারে একজন রমনী। এতটা উত্তেজনায় ভাসাতে পারে সে নিজেকে এবং তার সঙ্গীকে। অবিশ্বাস্য সেই রাতের কথা কিছুতেই ভুলতে পারছেনা নেপোলিয়ন। সে বুঝতে পারছে তার মনের অবস্থা। নিজেকে সে আবিস্কার করছে ভালোবাসার সমুদ্রে আবেগে ভেসে যাওয়া খড়কুটো হিসাবে। সে জোসেফিনকে ভালোবেসে ফেলেছে। প্রবল সে ভালোবাসা। কিন্তু এটাতো জোসেফিনকে জানাতে হবে। তাকে বুঝাতে হবে সে তার জন্য কতটা উন্মত্ত। তার মনের ঝড়ের একটু দোলা তো জোসেফিনকেও দেয়া উচিত। কিন্তু কীভাবে? হঠাৎ চোখের সামনে কালির দোয়াত চোখে পড়লো নেপোলিয়নের। এই তো। পাওয়া গেছে। আজকের অনুভূতি জানানোর জন্য চিঠির চেয়ে ভালো মাধ্যম আর কিছু আছে নাকি??

শীতের কুয়াশা মাখা ভোর। জানালা দিয়ে হিম শীতল বাতাস আসছে। সবকিছুকে উপেক্ষা করে মনের উষ্ণতা দিয়ে নেপোলিয়ন চিঠি লিখলো জোসেফিনকে।

 

ডিসেম্বর ২৯, ১৭৯৫

তোমাতে পরিপূর্ণ হয়ে আমি ঘুম থেকে উঠলাম। তোমার ছবি, গতরাতের নেশা ধরানো ভালোবাসার সুখ আমার সমস্ত অনুভূতিকে চঞ্চল করে রেখেছে।

প্রিয় এবং অতুলনীয় জোসেফিন, কি অদ্ভুত ভাবেই না তুমি আমার মনটাকে দখল করেছো।

তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো?? তুমি কি অসুখী?? তুমি কি বিষন্ন??

বিষন্নতার ঝড়ে আমার মন ভেঙে গেছে। আমার ভালোবাসা আমাকে বিশ্রাম পর্যন্ত নিতে দিচ্ছেনা। কিন্তু আমি কীভাবে বিশ্রাম নেই বল, যখন আমার মনকে নিয়ন্ত্রন করছে সেই অদ্ভুত অনুভূতি যা আমি পান করছি তোমার ঠোঁট থেকে, তোমার হৃদয়ের জ্বলন্ত প্রেমের শিখা থেকে।

ওহ, এই রাতে তুমি প্রমাণ করেছো প্রকৃত তোমাকে। আমি জেনেছি তোমার প্রতিচ্ছবি তোমার স্বরূপ নয়।

তুমি দুপুরে বের হচ্ছো। তিন ঘন্টার মধ্যে আমি তোমার সাথে দেখা করছি।

আমার জান, এই অবসরে তোমার জন্য সহস্র চুমু। খবরদার আমাকে একটাও দিও না। আমার রক্তে আগুন ধরে যাবে যে।

বি

 

চিঠি হাতে কেমন অদ্ভুতভাবে বসে আছে জোসিফিন। সে হাসবে না কাঁদবে ঠিক বুঝতে পারছেনা। এই মানুষের মাথায় নিশ্চিত সমস্যা আছে। এত অল্প সময়ের মধ্যে এত আবেগ? রোজের আবেগের প্রয়োজন নেই। তার দরকার টাকা, বিলাস, ক্ষমতা। এই পুঁচকে জেনারেল এত কিছু দিতে পারবে বলে তো মনে হচ্ছে না। আসলে কি চাচ্ছে বোনেপার্ট?? সব কিছু জেনে কেউ তাকে ভালোবাসবে এটা ভাবার মত এত বোকা সে নয়। তারপরও সে মিলাতে পারছেনা। পুরুষের মনের কথা বুঝা যায় তার চোখের ভাষায়, তার শরীরে। এই একটা জায়গাতে এসে ব্যাপারটা ঠিক মিলছেনা। বোনেপার্টের চোখ সত্যি ভালোবাসার কথা বলছে। কিন্তু জোসেফিনের এই ভালোবাসা দিয়ে কিছুই হবেনা। পল ব্যারাসকে চাই তার। হ্যাঁ, পল ব্যারাস। অর্থ, সম্পদ আর ক্ষমতা। কিন্তু হতচ্ছাড়া পল ব্যারাসই তো এই আপদটাকে তার সাথে পাঠিয়েছে। তার মতলব রোজের কাছে আগে থেকেই ভালো মনে হচ্ছিল না। কালকের এই ঘটনার পর সেটা দৃঢ় বিশ্বাসে পরিণত হয়েছে। কোথায় রোজ ভেবেছিল রাতে পলকে বিছানায় ভুলিয়ে ভালো অংকের টাকা পয়সা নেয়া যাবে সেখানে এক আবেগের সওদাগর মনের বাণিজ্য করতে এসেছেন। ভীষন অস্থির রোজ ঠিক করেছে নেপোলিয়ন আসার আগেই সে পলের সাথে দেখা করার জন্য বেড়িয়ে যাবে। পলের সাথে খোলামেলা কথা হওয়াটা খুব দরকার। সে চাচ্ছেনা নেপোলিয়ন নামের এই কার্টুন যেনো আর তার কাছে আসে।

 

পল নিজের চিন্তা শক্তির প্রতিভায় নিজেই মুগ্ধ। কিন্তু এত খুশীর মাঝেও সে ঠিক শান্তিতে নেই। ইতালির পরিস্থিতি ভালো ঠেকছেনা। খুব দ্রুতই একটা পদক্ষেপ নেয়া উচিত। কাউন্সিলরদের বৈঠকে ব্যাপারটা তোলা হবে আজকে। নিজের মাথায় এখন এই একটা বিষয় নিয়েই ভাবনা চলছে তার। এমন সময় চাকর এসে জানালো রোজ এসেছে। ভ্রু কুঁচকে পল ভাবছে কি করা যায়। এই সময়ে এই আপদ তার ভালো লাগছেনা। ভাবতে ভাবতেই রোজ এসে হাজির।

এসো রোজ। আমাদের তরুণ ক্যাপ্টেন কাল বিছানায় কেমন শৌর্য্য দেখালো?

আরে ধুর। ও তোমার গুন কোথায় পাবে পল?? ও তো একেবারেই শিশুদের মত। খেলাধূলার নিয়ম কানুন কিছুই জানেনা। তুমি যে কেন ওকে কাল আমার সাথে পাঠালে। কথা বলতে বলতেই রোজ, পলের একদম সামনে এসে দাঁড়িয়ে বুকে হাত রাখল।

পাঠালাম এজন্য যে, তুমি ওকে নিয়ম-কানুন শিখিয়ে দেবে তাই। আর ওর প্রতি তুমি বিশেষ খেয়াল রাখ। ওকে আমাদের ভবিষ্যতে দরকার হবে।

পলের এই কথা রোজের মাথায় আগুন ধরিয়ে দিলো। পল তার হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে বুঝতে পেরে সে চিৎকার করে বললো, আমি ওকে চাই না। পল, আমি তোমাকে চাই। তুমি আমাকে ছেড়ে যেও না পল। শেষদিকে রোজের গলা ধরে এসেছে। আসন্ন বিপদের ইশারায় তার মন ভীষণ বিক্ষিপ্ত।

এভাবে আমাকে ভুলাতে পারবেনা তুমি রোজ। খুব ঠান্ডা মাথায় পল ব্যারাস তার নিজের ইচ্ছার কথা জানিয়ে দিলো রোজকে। তোমার বয়স এখন ৩২ রোজ। তুমি যৌবনের অনেকটুকু পথ পাড়ি দিয়ে এসেছো। নিজের ভালোটা যদি বুঝতে না শিখো তাহলে আমার কিছু করার নেই। তোমাকে আমার কথা শুনতে হবে। বোনেপার্টকে নিয়ে তোমাকে ভাবতে হবে। ভুলে যেয়ো না এখনো বাসা রঙ করার বিল তুমি পরিশোধ করনি। সেই অংক কিন্তু খুব একটা কম নয়।

রোজ এবার পুরোপুরিই ভেঙে পড়েছে। সে বুঝতে পারছে পল ব্যারাসের কথা শোনা ছাড়া তার সামনে আর কোন পথ খোলা নেই। তবুও শেষ চেষ্টা হিসাবে সে নেপোলিয়নকে অপছন্দ করার কারণ তুলে ধরতে চেষ্টা করলো। রোজ তীব্র ভাষায় বলে যাচ্ছে আর পল উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।

বোনেপার্ট বেঁটে

তুমি তো লম্বা

ওর গায়ের রঙ হলদেটে

তোমার তো সাদা

ও কর্সিকান

ও ফ্রেঞ্চ আর্মির একজন জেনারেল

ওর কাছে অর্থ-সম্পদ নেই

সেতো তোমার কাছেও নেই। আর তাছাড়া আমার কথা মত চললে ওর হবে

ওর কোন ক্ষমতা নেই। তুমি জান ক্ষমতা ছাড়া আমি চলতে পারিনা

ওর নেই। আমার আছে। আমি তোমার পাশে থাকলেই তো হল।

রোজ বুঝতে পারছে এভাবে তর্ক করে ও পারবেনা। ওর আর কিছুই করার নেই। পল ব্যারাসের কথা মেনে নিয়েই ওকে এখন এই অপছন্দের তালিকায় উপরের দিকে থাকা ব্যক্তির সাথে সময় কাটাতে হবে। প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে রোজ বাসায় ফিরে যাচ্ছে। এমনটা কোনদিন হবে সে স্বপ্নেও ভাবেনি।

রোজের চলে যাওয়া দেখতে দেখতেই পল ব্যারাস তার পরবর্তী পদক্ষেপ ভেবে ফেলেছে। নেপোলিয়নকে খবর পাঠাতে হবে দ্রুত এখানে আসার জন্য। নাহ, বুদ্ধি আছে বটে আমার- কথাটা মনে মনে ভাবতেই একটা হালকা হাসির রেখা ফুটে উঠলো তার ঠোঁটের কোনায়।

নেপোলিয়ন তৈরী হচ্ছে তার স্বপ্নের মানবীর কাছে যাবার জন্য। এমন সময় তার কাছে খবর আসলো যে পল ব্যারাস জরুরী ভিত্তিতে যাবার জন্য বলেছেন। খবরটা শুনেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেল তার। কিন্তু কিছুই করার নেই। যেতেই হবে। মনে মনে তার জোসিফিনের কাছে ক্ষমা চেয়ে নেপোলিয়ন বের হলো তুলেরিসের পথে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে আজ কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তাকে কি ইতালিতে পাঠানো হবে?? স্বপ্ন কি তবে সত্যি হতে চলেছে??

তুলেরিস প্রাসাদে বেশ উত্তেজনা। পল ব্যারাস কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছেনা ফরাসি বিপ্লবের বিরুদ্ধে পুরো ইউরোপ এভাবে ক্ষেপে উঠলো কেন?? একটার পর একটা খারাপ খবর আসছে। অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়া আগে থেকেই শত্রু ছিল। তাদের সাথে এখন যোগ দিয়েছে ব্রিটেন আর স্পেন। সব দেশ মিলে তৈরী করেছে ‘ফার্স্ট কোয়ালিশন’। ইতিমধ্যেই অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়া তাদের বাহিনী নিয়ে এগিয়ে আসছে মন্টোয়ার দূর্গের অবরোধ ভেঙে দিতে। ফ্রান্সের এখন ঘোর দুঃসময়। সে বিষন্ন মনে টেরেসে বসে আছে। এমন একটা সময় চাকর এসে খবর দিল নেপোলিয়ন এসেছে।

“তাই নাকি?? আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম”। নিজের মনেই বললো পল। “তাকে নিয়ে এসো। আর এখন কেউ যেন আমার কাছে না আসে”।

কিছুক্ষন পর নেপোলিয়ন এল। চোখে মুখে কেমন যেন একটা উত্তেজনা।

“আরে বোনেপার্ট যে। এসো। খবর শুনেছো?”

“কোন খবর? অস্ট্রিয়া আর প্রুশিয়া এগিয়ে আসছে মন্টোয়ার দিকে, এই খবর?”

“তুমি তো তাহলে খারাপ খবরটা জেনেই এসেছো”।

“আমাদের জেনারেলরা যতদিন না নিজেদের পদ্ধতি এবং চিন্তাশক্তির পরিবর্তন করছে ততদিন আমাদের বিপদ কাটবেনা”।

“মনে হচ্ছে ইতালিতে যাবার তোমার খুব ইচ্ছা? পলের ভ্রু কুঁচকে গেছে। সে বুঝতে পারছে নেপোলিয়ন কিছু একটা মনেমনে ভেবে এসেছে”।

“ইচ্ছা অবশ্যই আছে। তবে আমি চাই আমাকে ইতালিতে অবস্থান করা ফরাসি বাহিনীর প্রধান করে সেখানে পাঠানো হোক”।

“তুমি এই কাজের জন্য যথেষ্ট তরুণ বোনেপার্ট”।

“যুদ্ধক্ষেত্রে তারুণ্য একটা বাড়তি শক্তি। এটা আমার ইতিবাচক দিক”।

“তুমি জাতিতে কর্সিকান। তোমাকে ফ্রেঞ্চরা এখনো বিশ্বাস করেনা”।

“আমি তুলনে নিজের জীবন বাজি রাখার পরও???”

পল বুঝতে পারছে নেপোলিয়ন আবেগপ্রবণ হয়ে পরেছে। এখনি সময়। বাণিজ্যটা এখনি করে ফেলা উচিত। এক ঢিলে দুই পাখি মারার এই সুযোগ কিছুতেই হাতছাড়া করা যাবেনা। মনের ভাব মনে রেখে খুব ঠান্ডা গলায়, যেন বাচ্চা ছেলেকে বুঝাচ্ছে সেভাবে পল ব্যারাস সম্পূর্ণ অন্য প্রসঙ্গে নেপোলিয়নকে প্রশ্ন করলো।

“তোমার বয়স ২৬। বিয়ে করতে ইচ্ছা হয়না??”

হঠাৎ যুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বিয়ের মত স্নিগ্ধ একটা বিষয়ে পল কেন চলে গেল বুঝতে পারছেনা সে। শুধু শুকনো মুখে বললো,

“হ্যাঁ হয় তো’।

‘পছন্দের কেউ আছে প্যারিসে???’

‘পছন্দের? হ্যাঁ, তা …’ নেপোলিয়নের ইতস্তত কথার মাঝখানেই পল বলে বসল,

‘যদি ধর এমন কেউ যে সম্ভ্রান্ত, সুন্দরী, ধনী এবং সবথেকে বড় কথা জাতিতে খাঁটি ফ্রেঞ্চ। তাহলে কি তোমার আপত্তি থাকবে?? এটা তোমাকে ফরাসিদের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য করে উপস্থাপন করবে’।

‘তা ঠিক। কিন্তু এমন কে আছে??’

খুশিতে পলের মুখ ঝলমল করছে। এই সুযোগ। নেপোলিয়নের কাছ রোজকে গছিয়ে দিতে হবে। সে যতটুকু সম্ভব মুখ গম্ভীর করে বললো, ‘রোজ ডি বোয়ানে’।

নেপোলিয়ন প্রথমে ভাবলো সে ভুল শুনছে। প্রবল আনন্দে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যে মানুষকে সে ভালোবেসে ফেলেছে প্রথম দেখাতেই সেই মানুষটির কথা বলছে পল ব্যারাস??? ভাগ্য তার প্রতি এত সুপ্রসন্ন হচ্ছে কীভাবে?? কেন হচ্ছে?? সে আমতা আমতা করে বলছে, ‘কিন্তু ……’

অধৈর্য্য পল তার কথা কেড়ে নিয়ে বললো, ‘কোন কিন্তু নয়। তুমি রোজ বোয়ানে কে বিয়ে কর। আমি তোমার ইতালি যাবার স্বপ্ন পূরণ করার চেষ্টা করছি’।

নেপোলিয়ন কিছু না বুঝেই বলে ফেললো, ‘চেষ্টা মানে???’

সাথে সাথে পল ব্যারাস বলে উঠলো, ‘ধরে নাও তুমি ফরাসি বাহিনীর প্রধান হয়েই ইতালি যাচ্ছো’।

নেপোলিয়ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুলেরিসের লিভিং রুমে। তার মাথার উপরে বিশাল একটা ঝাড় বাতি। চারিদিকে অদ্ভুত আলো। সামনে বর্তমান ফ্রান্সের সবথেকে ক্ষমতাধর মানুষ পল ব্যারাস। যে কিনা আজ তার মনের দুটো স্বপ্ন অভাবিত ভাবে পূরণ করার কথা বলছে। আচ্ছা সে কি স্বপ্ন দেখছে না এটা সত্যি?? কিন্তু কীভাবে এত আনন্দের উপলক্ষ একবারে ঘটবে?? হতবিহবল নেপোলিয়ন ভাবলেশহীন ভাবে শূণ্যে তাকিয়ে আছে। তার চিন্তা থেমে গেল পলের কথায়।

‘কি ভাবছো?? এত কিছু ভাবার সময় নেই। তুমি আজকেই রোজের সহকারী কালমেলের সাথে কথা বল। এবং সেটা এখুনি। তোমাকে খুব দ্রুত ইতালি যেতে হবে। আমরা খুব খারাপ অবস্থায় আছি’।

নেপোলিয়ন মনের মধ্যে প্রবল আনন্দ আর উত্তেজনার মিশেল নিয়ে বের হয়ে আসলো তুলেরিস থেকে। তার রক্তে সে দুটি ভিন্ন ধারার উপস্থিতি অনুভব করছে। একটা ধারাতে মিশে আছে বারুদের গন্ধ। সালফারের ধোঁয়া। সেখানে যুদ্ধের সমস্ত উত্তেজনা। অন্য ধারাতে তার জোসেফিনের গায়ের গন্ধ, তার সাথে কাটানো রাতের মায়া। নেশা ধরানো চোখে ঘোর লাগা জীবনের অদ্ভুত আহ্বান। নেপোলিয়ন জানে না কীভাবে কী হচ্ছে। শুধু জানে আজ তার ইচ্ছা করছে প্যারিসের রাস্তায় চিৎকার করে বলতে, ‘আমি সুখী, ভীষণ সুখী’।

 

প্লিজেন্ট রোডের সেই কটেজের দোতলা। শোবার ঘরে বসে বসে রোজ বোয়ানে ভাবছে তার ফেলে আসা দিনের কথা। ভাবছে গিলোটিনের নিচে চাপা পড়া জীবনের সমস্ত আনন্দের কথা। এখন দুটো সন্তান নিয়ে প্যারিস শহরে বাস করা তার জন্য কতটা কষ্টের। সে আজ একটা চিঠি লিখেছে তার প্রিয় এক বান্ধবীকে। সেখানে সে লিখেছে নেপোলিয়ন নামের এক পুঁচকে জেনারেলের কথা।

সে লিখেছে,

“……ওহ জেনারেল বোনাপার্ট, তার কথা আর কি বলবো। সে একটা আস্ত ভাঁড়। তুমি তো জানই এসব ব্যাপারে আমি কত বিব্রত হই। সে মেয়েদের সাথে ঠিক ভাবে কথা পর্যন্ত বলতে পারেনা। সবসময় সে সিরিয়াস। রসবোধ বলতে গেলে একদম নেই। তার পোশাক নোংরা, মলিন। জুতা থেকে উঠে আসে বিশ্রী গন্ধ। ঘাড়ের উপর দিয়ে নেমে আসা চুল দেখলে মনে হয় খড়ের গাদা। হলুদ চামড়ার, বেঁটেখাটো, হাড্ডি সর্বস্ব এই মানুষ নিয়ে আমি কী করবো বল?? ওহ সে একটা আস্ত কৌতুকের উপকরণ’’।

কিন্তু সে জানে নেপোলিয়ন ইতিমধ্যেই তার সহকারী কালমেলের সাথে কথা বলেছে বিয়ের ব্যাপারে। পল ব্যারাস খুব চাচ্ছে এই বিয়েটা হোক। পল ব্যারাসের স্বার্থ সে খালি চোখেই দেখতে পাচ্ছে। সে রোজ নামের ৩২ বছর বয়সের এই বোঝাটাকে মাথা থেকে নামাতে চাচ্ছে। এবং নেপোলিয়নকে হাতের মুঠোয় রাখার জন্য তার রোজকে দরকার। কিন্তু খুব ভালভাবে চিন্তা করেও সে বুঝতে পারছেনা এখানে জেনারেল বোনেপার্টের কি স্বার্থ?? তার তো আর কাউকে কিছুই দেবার নেই। তাহলে?? নেপোলিয়ন আসলে কি চাই?? তবে কি সে সত্যিই আমাকে ভালবাসে?? প্যারিসের মত এই শহরে, এই ১৭৯৬ এর শুরুতে, এই অশান্ত পরিবেশে ভালোবাসা?? তাও কি সম্ভব?? কিন্তু সে তো নেপোলিয়নকে ভালোবাসে না। একদম না। কিন্তু নিয়তির হাতে সে বন্দী। হয় তাকে এখন নেপোলিয়নকে বিয়ে করতে হবে না হলে প্যারিস থেকে চলে যেতে হবে। কী করবে রোজ?? আচ্ছা কোনভাবে যদি নেপোলিয়নকে ফেরানো যায়?? তাহলে তো পল ব্যারাস আর তাকে চাপ দিতে পারবে না।

এতসব ভাবনার মধ্যেই নেপোলিয়ন আসার সংবাদ পেল রোজ। নিজেকে যথাসম্ভব দুঃখী মানুষের মুখোশ পড়িয়ে সে নিচে নামলো।

‘জেনারেল বোনেপার্ট, আসুন’।

‘ওহ জোসেফিন। আমি তোমার কাছে আসার জন্য সেই কখন থেকে অপেক্ষা করছি। কিন্তু খালি কাজ আর কাজ। তুমি আমার চিঠি পেয়েছো??’

‘ওহ চিঠি। হ্যাঁ, হ্যাঁ পেয়েছি তো’।

‘আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি জোসেফিন’।

এবার নিজের অভিনয় ক্ষমতার সবটুকু ঢেলে দিয়ে রোজ বললো,

‘না। না। তুমি আমাকে ভালোবাসো না নেপোলিয়ন। তুমি ভালোবাস আমার টাকাকে। আমার অর্থ-সম্পদ আর ক্ষমতাকে’।

নেপোলিয়ন এমন কথার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিল না। সেতো কখনো এসবের কথা ভাবেইনি। তার মনের মধ্যে শুধু ভালোবাসার গান। সেখানে অর্থ-সম্পদ, ক্ষমতা এসব কিছুর কোন স্থান নেই। কিন্তু কীভাবে সে বুঝাবে এটা তার জোসেফিনকে?? সে শুধু একরাশ হতাশা নিয়ে বললো,

‘জোসেফিন, ওহ জোসেফিন, তুমি কীভাবে আমাকে এই কথাটা বলতে পারলে?? আমি শুধু তোমাকে চাই। আমি ভুলেও ঐসব টাকা ক্ষমতার কথা ভাবিনি। আমি তোমাকে দেখেছি। শুধু তোমাকে। আমি দেখেছি তুমি কীভাবে আমার জীবনটাকে এক নিমিষে আনন্দের সাগর বানিয়ে দিতে পার। আমি শুনেছি তোমার কণ্ঠের মাদকতা। আমি আর কিছুই চাইনি। আমি শুধু তোমাকে চেয়েছি। প্রতি রাতে আমার দুই হাতের মাঝে। আমি মুখ লুকাতে চেয়েছি তোমার ঐ সুন্দর বুকের ভাঁজে। আমি…আমি…’

কথা খুঁজে পাচ্ছে না নেপোলিয়ন। সে কখনো এসবের সাথে পরিচিত না। প্রচন্ড আবেগে সে কাঁপছে।

তাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে চোখে একরাশ কৌতুক নিয়ে রোজ উপভোগ করছে ২৬ বছরের এই জেনারেলের বাচ্চা সুলভ আচরণ। মানুষটা সত্যিই তাহলে তার প্রেমে পড়েছে। শুধু পড়েনি। একেবারে ডুবেই গেছে। হঠাৎ সে প্রশ্ন করলো,

‘তাহলে আমার কাছে না এসে আগে কালমেলের কাছে কেন গিয়েছিলে??? আমার কত ধন সম্পত্তি আছে তার হিসাব নিতে?? বিয়ের পর আমার কাছ থেকে কী পরিমাণ টাকা পয়সা তোমার পকেটে যাবে সেজন্য??’

নেপোলিয়ন হতভম্ব হয়ে শুনছে তার ভালোবাসার মানুষের কথা। এও কি হয়?? সে কীভাবে বুঝাবে সে জোসেফিনকে কতটা ভালোবাসে। নেপোলিয়ন শেষ চেষ্টা করলো। জোসেফিনের দুই হাত ধরে সে কাপাকাপা গলায় বললো,

‘আমি প্রমাণ করে দেব যে আমি শুধু তোমাকে চাই। তুমি নিঃস্ব হলেও তোমাকে চাই। তুমি এক কাপড়ে আমার সাথে চলে আসতে চাইলে আমি সেটাতেও রাজি আছি’।

‘নাহ! তুমি প্রমাণ করতে পারবে না’।

‘আমি পারব’।

নেপোলিয়নের গলায় এখন সেই আত্মবিশ্বাস যা শোনা যায় যুদ্ধ ক্ষেত্রে। নেপোলিয়ন ভাবছে এটাও এক ধরনের যুদ্ধ। ভালোবাসার যুদ্ধ। সে আবার বললো, ‘বল আমাকে কী করতে হবে??’

রোজ চুপ। সে ভাবছে নেপোলিয়ন ঠিক জায়গা মত এসে পৌঁছেছে। এখন তাকে দিয়ে যেকোন কিছু করিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু তার পরিণতি হচ্ছে বিয়েতে তাকে সম্মতি দিতে হবে। এটাতো বড় যন্ত্রণা হল। রোজ ভাবছে। ৩২ বছর বয়স। অর্থ-সম্পদের অভাব। ক্ষমতার উচ্চ আসনে বসার সুতীব্র লোভ এসব কিছুকে একসাথে পেতে হলে এই জোকারটাকে ভালো না বাসলেও বিয়ে করতে হবে।

অধৈর্য্য হয়ে নেপোলিয়ন উত্তরের অপেক্ষা না করেই বলে ফেললো,

‘আচ্ছা ঠিক আছে আমি প্রমাণ করে দিচ্ছি। আমি ধরে নিচ্ছি আজ থেকে তোমার কিছুই নেই। তুমি শূণ্য। এখন থেকে তুমি আমার অর্থে চলবে। আমি আমার মাসিক বেতন থেকে একটা অংশ তোমার নামে দেবার জন্য বলে দিচ্ছি। তোমার যাতে কোন সমস্যা না হয় আমি দেখবো জোসেফিন’।

ঠিক এই কথাটার জন্যই জোসেফিন অপেক্ষা করছিলো। সে সাথে সাথে মুখটা করুণ করে বললো, ‘তুমি আমার জন্য এত কিছু কেন করবে জেনারেল??? আমি তো তোমাকে কিছুই দিতে পারছি না’।

নেপোলিয়ন জোসেফিনের গলার স্বর শুনেই বুঝলো সে পেতে যাচ্ছে তার প্রিয় মানুষটাকে। সে তার জোসেফিনকে বুকের মাঝে টেনে নিয়ে বললো,

‘আমি কিছুই চাইনা। তুমি শুধু সারাজীবন আমার বুকেই থাকো’।

রোজ বুঝতে পারছে সব কিছু শেষ। এখন সে ভবিষ্যতের জন্য নিশ্চিন্ত। আহ কি শান্তি। এখন একটু আনন্দ করায় যায়। সে নেপোলিয়নের বুকে চুমু খেয়ে বললো,

‘শুধু বুকের মধ্যে চুপচাপ শুয়ে থাকলেই তোমার চলবে??? আর কিছু চাই না তোমার??? আমরা কি আর কিছুই করতে পারিনা’।

নেপোলিয়নের শরীরে আগুন ধরে গেল। সে জোসেফিনকে জড়িয়ে ধরে বললো,

‘পুরো প্যারিসে তোমার চেয়ে এই ব্যাপারে ভালো আর কেউ জানে না জোসেফিন। কেউ না’।

 

ঠিক তার দুদিন পর, ৯ই মার্চ, ১৭৯৬। প্যারিসে ম্যারেজ রেজিস্ট্রি অফিসে রোজ বোয়ানে, পল ব্যারাস তাদের একজন সহকারী অপেক্ষা করছে নেপোলিয়নের জন্য। এখন দুপুর ৪টা বাজে। অপেক্ষা করতে করতে রেজিস্ট্রার চলে গেছে। এখন সহকারী রেজিস্ট্রার আছে। তারও যাবার সময় হয়ে গেছে। শুধু পল ব্যারাসের জন্য সে যেতে পারছে না।

‘আরে কি আশ্চর্য্য?? সে এখনো আসছে না কেন??? রোজের কণ্ঠে বিরক্তি আর হতাশা’।

পল ব্যারাস তীক্ষ্ম চোখে রোজকে দেখছে। সে রোজ কে জিজ্ঞেস করলো,

‘আচ্ছা, তুমি কি সত্যিই তাকে ভালোবাসো??’

আচমকা প্রশ্নে কিছুক্ষন চুপ হয়ে থাকলেও রোজ উত্তর দিল,

‘আমার প্রতি তার প্রবল ভালোবাসাটাকে আমি ভালোবাসি। আজ পর্যন্ত কেউ আমাকে এভাবে ভালোবাসেনি। আমি এই ভালোবাসার জন্যই এখানে এসেছি। কিন্তু ব্যক্তি নেপোলিয়ন, তুমি তো জানোই পল’।

ঠিক এমন সময় নেপোলিয়ন হাজির।

‘আমি দুঃখিত যে আমার দেরী হয়ে গেল আমার জান’। এরপর পল ব্যারাসকে একটা নড করে সে রেজিস্ট্রি অফিসের টেবিলে একটা ঘুসি মেরে বললো, ‘আরে জলদি করো না। আমাকে ৪৮ ঘন্টার মধ্যে ইতালি যেতে হবে’।

সহকারী রেজিস্ট্রার আচমকা এই শব্দে ভয় পেয়ে গেল। বলে কি জেনারেল??? বিয়ে করতে এসে এমন অস্থির হয় নাকি মানুষ?? সে শুরু করলো,

‘কনের নাম?’

উত্তর দিল পল ব্যারাস – ‘মাদাম রোজ ডি বোয়ানে’

‘বয়স?’

এবার খুব দ্রুত রোজ উত্তর দিল- ‘২৮ বছর’।

নেপোলিয়ন আর পল ব্যারাস ভ্রু কুঁচকে তাকালো।

‘বার্থ সার্টিফিকেট?’

আবার পল ব্যারাস- ‘মাদাম রোজ বোয়ানে তখনকার ব্রিটিশ অধ্যুষিত মার্টিনিক থেকে এসেছেন। কাজেই বার্থ সার্টিফিকেট নেই’।

নেপোলিয়ন আচমকা বলে বসলো, ‘আমি নেপোলিয়ন বোনেপার্ট, বয়স ২৮ বছর, আমি কর্সিকা থেকে এসেছি এবং আমারও বার্থ সার্টিফিকেট নেই’।

এবার রোজ আর পল ব্যারাস তার দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালো। রোজের মুখে মিটিমিটি হাসি। মনে মনে বলছে, উফফ গাধা হয়ে গেছে মানুষটা।

নেপোলিয়নের সহ্য হচ্ছেনা। সে আবার জিজ্ঞেস করলো,

‘এই যে জনাব, বার্থ সার্টিফিকেট ছাড়া বিয়ে হয়না?? বললাম আমি আর ৪৮ ঘন্টা পরে ইতালি যাচ্ছি। আমাকে কি আমার বউ এর সাথে একটু বেশী সময় থাকতে দেয়া যায় না???’

প্রচন্ড অবাক আর হতাশ সহকারী রেজিস্ট্রার তাদের খুব দ্রুত বিয়ে পড়িয়ে দিল।

নেপোলিয়ন বের হয়ে আসার সময় আবার সে বললো,

‘জেনারেল বোনাপার্ট আপনার বিয়ে এখনো সম্পন্ন হয়নি, প্রধান রেজিস্ট্রার সই না করা পর্যন্ত বিয়ে কার্যকর হয় না’।

নেপোলিয়ন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বললো,

‘আজকের এই ভালোবাসার রাতে আমার কারও সইয়ের জন্য অপেক্ষা করার মত ধৈর্য্য নেই। আজকের রাত শুধুই আমার। আমার ভালোবাসার’।

6

১৭৯৬ এর মার্চ। নিজের বাসার বাগানে প্রজাপতির মত ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অপরূপ সুন্দরী তরুণী। চমৎকার এই বিকেলে তার অসম্ভব মন খারাপ। কিছুক্ষন আগে সে জানতে পেরেছে তার প্রিয় মানুষ নেপোলিয়ন বিয়ে করেছে রোজ বোয়ানে নামে প্যারিসের এক মিস্ট্রেসকে। মন খারাপের এই বিকেল কিছুতেই কাটতে চাচ্ছেনা। প্রচন্ড কষ্টের নোনা জল নিয়ে আবেগের ঢেউগুলো আছড়ে এসে পড়ছে চোখের কোণে। নিজেকে সামলাতে অনেক কষ্ট হচ্ছে তার। এমন সময় তার সামনে এসে দাঁড়ালো তার বড় বোন জুলি আর দুলাভাই জোসেফ। জোসেফকে দেখে চোখের জল আটকাতে পারলো না মেয়েটি। হ্যাঁ, কাঁদছে মেয়েটি। কাঁদছে ক্লারি ড্রেসেরি। চারিদিকে এক অস্বস্তিকর নিরবতা। শেষে নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে সে বললো,

“তাকে তোমরা বলে দিও আমি তার নতুন জীবনের জন্য শুভকামনা জানিয়েছি। আরও বলো যে, আমি আশাকরি সে যাকে পছন্দ করে নিজের জীবনে জড়িয়েছে সে যেন তাকে ঠিক তেমন ভাবেই সুখী করে যেমনটা আমি তাকে করতে চেয়েছিলাম। আর একটা কথা। তাকে একবার জিজ্ঞেস করবে যে সে আমাকে ভুলে যাবে কিনা। তাকে বলো সে যেন আমাকে না ভুলে যায়”।

কান্নার আবেগে আর কথা বলতে পারেনা ক্লারি। দৌড়ে চলে যায় নিজের ঘরে। নেপোলিয়নের প্রথম আবেগের সাথে নিজেকে জড়ানো মেয়েটি কি এক অভিমানে নিজেকে গুটিয়ে ফেলে নিজের মধ্যে। এখানেই শেষ হয় ক্লারি অধ্যায়। ইতিহাস মেয়েটির ভালোবাসাকে মূল্য দেয়নি। ইতিহাস শুধু জয়ীদের কথাই বলে।

 

১৭৯৬। মার্চের মাঝামাঝি। ফরাসি বাহিনীর বেস ক্যাম্প। হঠাৎ বার্তাবাহক খবর নিয়ে এলো যে একজন নতুন জেনারেল আসছেন বাহিনী প্রধান হিসাবে। নেপোলিয়ন বোনেপার্ট নামের এই ছোটখাটো মানুষটি আগে কখনো এতবড় সৈন্য বাহিনী পরিচালনা করেনি। সৈন্যদের মধ্যে তেমন কোন চাঞ্চল্য দেখা গেলনা। দিনের পর দিন এইসব হতচ্ছাড়া জেনারেলদের মাথামোটা বুদ্ধির জন্য তারা এখনো যুদ্ধ জয় করতে পারেনি। তার মধ্যে নাকি এক ২৬ বছরের জেনারেল আসছে যার আগে এত বড় যুদ্ধের অভিজ্ঞতা নেই। সৈন্যরা খুবই হতাশ। একই সাথে সেখানে থাকা জেনারেলরাও হতাশ। তাদের হতাশা একটু ভিন্ন। তাদের হতাশার কারণ হল পল ব্যারাসের মত এমন বিচক্ষন মানুষ কীভাবে এত বড় ভুল করতে পারে?? কোথাকার কোন পুঁচকে নেপোলিয়নকে এখানে দায়িত্ব দিয়ে পাঠানোর অর্থ কি তাদের এক অর্থে অপমান করা নয়। তারা হাসাহাসি করে সময় কাটাচ্ছে। তাদের ধারণা এই পুঁচকে মানুষ এখানে ১ সপ্তাহও টিকবে না।

মার্চের শেষের দিকের কথা। ইতালির আকাশে ঘন কালো মেঘ। একটু আগেই বৃষ্টি হয়েছে। কাঁচা রাস্তা দিয়ে সামান্য কিছু সৈন্য নিয়ে নেপোলিয়ন যাচ্ছে ইতালিতে অবস্থানরত ফরাসি বাহিনীর কমান্ড গ্রহন করতে। তার মনের মধ্যে যুদ্ধের উত্তেজনা। কিন্তু হাতে একটা লকেট। সেই লকেটের দুই অংশে একদিকে তার ছবি। অন্যদিকে তার জোসেফিনের ছবি। সে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে লকেটের দিকে। পাশে যে তার খুব বিশ্বাসী সঙ্গী মুরিওন একভাবে তার কাজ কারবার দেখছে সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। শেষ পর্যন্ত মুরিওন আর থাকতে পারলো না।

“কি আছে এই লকেটে, জেনারেল??”

“হুম। ওহ। লকেট। হ্যাঁ, লকেট। দেখো, সে কত সুন্দর তাই না??” নেপোলিয়নের চোখে মুগ্ধতার বৃষ্টি কিন্তু মনে কষ্টের ঝড়।

“হ্যাঁ। সুন্দর”। খুব ছোট্ট করে বললো মুরিওন। সে বুঝতে পারছে নেপোলিয়ন ঘোরের মধ্যে আছে। সে এও বুঝতে পারছে যে এই ঘোর কেটে যাবে যখন তারা বেস ক্যাম্পে পৌঁছাবে।

নেপোলিয়ন বাইরের আকাশ দেখছে। এমন ঘন কালো কেন আকাশ??? তবে কি তার মত আকাশের মনও খারাপ?? তার অস্থির লাগছে। চোখে ভাসছে জোসেফিনের কাছ থেকে বিদায় নেবার দৃশ্যটা। কিন্তু কোথায় জানি একটা সমস্যা। খুব সুক্ষ্ম একটা কাঁটা মনের মধ্যে ভালোবাসার বেলুনটাকে প্রতিমূহুর্তে ফুটো করে দিচ্ছে। সে আবার পুরো ব্যাপারটা ভাবতে বসে। আচ্ছা কি হয়েছিল সেই বিদায়ের ক্ষণে??? কি এমন জিনিস যেটা তাকে এতটা অস্থির করে রাখছে??? নেপোলিয়ন পুরো ঘটনাটা চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছে।

ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। নেপোলিয়ন তখন জোসেফিনের নগ্ন বুকের মাঝে। খুব দ্রুত উঠে সে প্রস্তুত হয়ে নিল চলে যাবার জন্য। জোসেফিন তখন উঠেছে কেবল। অফ হোয়াইট কালারের গাউনটাতে তাকে কত সুন্দরই না লাগছে। জোসেফিন এসে সামনে দাঁড়ালো।

“তুমি এখনই যাবে??”

“হ্যাঁ, জোসেফিন। যত দ্রুত সম্ভব আমাকে মন্টোয়ার দূর্গ থেকে ওদেরকে তাড়াতে হবে। জেনারেল এ্যালভিঞ্জি মন্টোয়ার দূর্গের দিকে আসার আগেই ওকে আমার আটকাতে হবে। আমাদের বোকার হদ্দ জেনারেলরা সামনে থেকে যুদ্ধ করতে চাচ্ছে। অথচ তারা বুঝতে পারছে না যে অস্ট্রিয়া আর পিডমন্টিজদের সাথে সামনে থেকে যুদ্ধ করে আমরা পারবো না। ওরা একবার হারবে আবার নতুন সৈন্য নিয়ে আসবে। এভাবে ওদের রিজার্ভ বাহিনী আসতেই থাকবে। আমাদের এডিজ নদী পার হয়ে ওদের পিছনে চলে যেতে হবে। ওদের রিজার্ভ ফোর্স সরবরাহ লাইন কেটে দিতে হবে। না হলে এই যুদ্ধ অনন্তকাল চলতে থাকবে”। নেপোলিয়নের চোখ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। নতুন যুদ্ধ জয়ের এক হাতছানি তার সামনে।

জোসেফিনের হাই উঠছে। সে হাই তুলতে তুলতে খুব নিঃস্পৃহ গলায় বললো, “তুমি কি সারারাত আমার বুকের মধ্যে শুয়ে এই সব চিন্তা করলে??”

জোসেফিনের অসম্ভব ঠান্ডা গলায় বলা এই কৌতুক নেপোলিয়নকে খুব কষ্ট দিল। তাহলে কি জোসেফিন বুঝতে পারছে না তার এই চিন্তাটা কত গুরুত্বপূর্ণ। সে কি বুঝতে পারছে না এই চিন্তা এক নেপোলিয়ন ছাড়া অন্যকারো মাথায় আসবেনা। সে কি চিন্তা করতে পারছে না যে এতবড় দুঃসাহসিক পদক্ষেপ এক সে ছাড়া পুরো ফ্রান্সে আর কারো নেবার ক্ষমতা নেই। মনের কষ্ট মনে রেখে সে হাসিমুখে জোসেফিনকে বুকের মধ্যে টেনে নেয়। কথা ঘুড়িয়ে সে বলে,

“আমি তোমাকে খুব দ্রুত ইতালিতে নিয়ে যাবো। আমার কাছে”।

“কি??? এইটা কেমন কথা?? জোসেফিনের চোখ কপালে উঠে গেছে। তুমি কি আমাকে তোমার সাথে কাঁদা মাড়িয়ে, লাশ পাড়িয়ে এক যুদ্ধ ক্ষেত্র থেকে অন্য যুদ্ধ ক্ষেত্রে ঘুরে বেড়াতে যেতে বলছো??”

নেপোলিয়ন বুঝলো জোসেফিন তার সাথে যুদ্ধ ক্ষেত্রে থাকার চেয়ে বাসায় আরাম করাটাকে পছন্দ করছে। সে আবার কথা ঘুড়িয়ে বলল,

“আমি তোমাকে প্রতিদিন চিঠি লিখবো। কথা দাও তুমিও লিখবে”।

“কিন্তু আমি তো চিঠি তেমন একটা লিখি না”।

এবার নেপোলিয়ন অস্থির হয়ে যায়। “লিখো না তো কি হয়েছে। এখন থেকে তোমাকে লিখতেই হবে”।

জোসেফিন বুঝতে পারছে নেপোলিয়ন উত্তেজিত। সে তাকে ঠান্ডা করার জন্য বললো,

“আমি চেষ্টা করবো”।

জোসেফিনের দিকে একভাবে তাকিয়ে আছে নেপোলিয়ন। তার একটু আগে বলা চেষ্টা করবো কথাটা তাকে বুঝিয়ে দিয়েছে অনেক কিছু। কিন্তু সে এখন এত কিছু ভাবতে চায় না। আজ বিয়ের মাত্র ২ দিন। আহত চোখে নেপোলিয়ন তাকিয়ে আছে অপলক।

“জেনারেল??? জেনারেল বোনেপার্ট???”

“হুম। ওহ”। মুরিওনের কথায় বাস্তবে ফিরে আসে নেপোলিয়ন। কখন যে পৌঁছে গেছে বেস ক্যাম্পে সে নিজেও জানে না।

ঘোড়ার গাড়ি থেকে নেমে এল ফরাসি বাহিনীর ইতালি ফ্রন্টের কমান্ডার, জেনারেল নেপোলিয়ন বোনেপার্ট। সবাই দেখছে দৃঢ় পদক্ষেপে, অবিচল মানসিকতার আলো বিলিয়ে সে হেঁটে যাচ্ছে তার জন্য বরাদ্দকৃত তাবুর দিকে। কিন্তু সবার ধারণা ভুল প্রমাণ করে নেপোলিয়ন চলে গেল একদম সৈন্যদের মাঝে। যেখানে তার আর্টিলারি বাহিনীর কামান মজুদ করা আছে। সব কিছুতে খুব দ্রুত একবার চোখ বুলিয়ে সে চলে গেল তার অশ্বারোহী বাহিনীর কাছে। নেপোলিয়ন দেখলো সৈন্যদের অবস্থা খুবই করুণ। তারা ঠিকমত খেতে পাচ্ছেনা। তাদের মনোবল শূণ্যের কোঠায়। তাদের পোশাক শতছিন্ন। এই বাহিনী নিয়ে সে কি করবে??

নেপোলিয়ন একটা টুলের উপর উঠে দাঁড়ালো। সৈন্যদের উদ্দেশ্যে নেপোলিয়ন বললো, ‘সৈনিক, আমি জানি তোমরা ক্ষুধার্ত, তোমরা হতাশ, তোমাদের চোখে-মুখে বিজয় গৌরবের সেই উজ্জ্বল আলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছেনা। তোমরা মনমরা হয়ে আছো। আমি তোমাদের পথ দেখানোর জন্য এসেছি। বেশী না। আমাদের আর কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে। এরপর আমি তোমাদের সন্ধান দেব অর্থ, সম্মান আর পেটভরা খাবারের উৎসের। কে কে আমার সাথে যাবে সেই উৎসের সন্ধানে???’

কথায় কাজ হল। সৈন্যরা বুঝলো এই মানুষটা অন্যধাতে গড়া। তারা একবাক্যে নির্ভর করলো নেপোলিয়নের উপর। এর সাথে আরো একটা জিনিস ঘটলো। তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় জেনারেলরা বুঝলো এই ছোট খাটো লোকটা সম্পর্কে যতই শোনা যাক না কেন যে সে তার নতুন বউয়ের আচলে্র তলে তলে থাকে, সে আসলে জানে তাকে কি করতে হবে।

 

এপ্রিল ২, ১৭৯৬। নেপোলিয়নের প্রথম বড় পরীক্ষা। তার সাথে ৩৮০০০ সৈন্যের বাহিনী। অন্যদিকে সামনে শুধু অস্ট্রিয়ার বাহিনীই ৩৮০০০। সাথে তাদের পাশে আছে ২৫০০০ পিডমন্টিজ। এত বড় বাহিনী দেখে নেপোলিয়ন ভাবছে, এরা তো আমাদের টিপে টিপে মারার জন্য এসেছে দেখা যাচ্ছে। নেপোলিয়ন দ্রুত চিন্তা করে একটা সিদ্ধান্ত নিল। সে বুঝতে পারছে যে এই দুই বাহিনী যদি একসাথে তাকে আক্রমন করে তাহলে তার পক্ষে টিকে থাকা মুশকিল। তাহলে উপায়?? হুম। উপায় হল এদেরকে একসাথে হতে দেয়া যাবে না। পিডমন্টিজদের বাহিনী ছোট। ওদেরকে নিয়ে আগে ভাবতে হবে। অস্ট্রিয়ার বাহিনীকে কিছু বুঝতে না দিয়ে পিডমন্টিজদের আলাদা করে ফেলতে হবে ওদের কাছ থেকে। এরপর আক্রমন করতে হবে খুব দ্রুত। সাথে সাথে সে সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল। একই সময়ে সে অদ্ভুত একটা কাজ করলো যা কেউ করার কথা ভাববে না। সে তার সৈন্যবাহিনীকে খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ার নির্দেশ দিল। পিডমন্টিজরা দেখছে ফরাসি বাহিনী ছড়িয়ে পড়ছে। খন্ড খন্ড গ্রুপ হয়ে এগিয়ে আসছে। তারাও ঠিক সেরকম খন্ড খন্ড গ্রুপ করে বাঁধা দেবার জন্য সৈন্যবাহিনীকে ছড়িয়ে দিল।

এই ছড়িয়ে দেবার কাজ করতে করতেই দুটো দিন শেষ। এখন গভীর রাত। নেপোলিয়ন বসে আছে তার তাবুতে। বাইরে হঠাৎ করে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। সবকিছু ঠিক মতই চলছে। বাহিনী ছড়িয়ে পড়ছে। এখন দেখা দরকার যে পিডমন্টিজরা এই ব্যাপারটাকে কীভাবে নেই। ওরাও কি ছড়িয়ে দেবে ওদের বাহিনী?? এতসব ভাবনার মাঝেও জোসেফিনের কথা ওর খুব মনে পড়ছে। যুদ্ধে বের হবার পর থেকে সে জোসেফিনকে মাঝে মাঝেই চিঠি লিখেছে। যদিও উত্তর এসেছে কম। তবুও কয়েকদিন আগে আসা শেষ চিঠিটা তাকে অনেক কষ্ট থেকে মুক্তি দিয়েছে। নাহ, যুদ্ধ চুলোয় যাক। এখন জোসেফিনকে চিঠি লিখতে হবে। নেপোলিয়ন তাবুর মধ্যে বসে চিঠি লেখা শুরু করলো। নেপোলিয়ন লিখছে আর জোসেফিনকে ভাবছে। তার মনের জমানো সব আবেগ এসে জড়ো হচ্ছে চিঠির পাতায়।

 

এপ্রিল ৩, ১৭৯৬

প্রিয়তমা জোসেফিন,

আমি তোমার সব চিঠি পেয়েছি। কিন্তু শেষ চিঠিটার মত কোন চিঠিই আমার মনকে এভাবে আন্দোলিত করতে পারেনি। কীভাবে?? কীভাবে, আমার ভালোবাসা, তুমি আমাকে এভাবে লিখতে পারলে??

তুমি কি ভেবে দেখেছো আমার এখনকার অবস্থান কতটা নিষ্ঠুর?? এর মধ্যে আমার দুঃখে আর একটু কষ্ট যোগ না করলে, আমার মনোবলটাকে চাপা দিয়ে পিষে না ফেললেই কি হত না???

কী অদ্ভুত চিঠির ভাষা! কী অনুভূতির প্রকাশ! আহা! সেগুলো ছিল আগুন যা পুড়িয়ে দগ্ধ করেছে আমার বেচারা মনটাকে।

আমার এক ও অদ্বিতীয় জোসেফিন, তোমাকে ছেড়ে থাকার মাঝে কোন আনন্দ নেই। তোমার কাছ থেকে দূরে এই পৃথিবীকে মনে হয় মরুভূমি যেখানে আমি আমার মনের জানালা খুলে দিতে পারিনা।

তুমি আমার স্বপ্ন থেকেও বেশি, আমার একমাত্র ভাবনা।

যখন প্রচন্ড কাজের চাপে আমি ক্লান্ত হই, যখন আমি অনুভব করি সেই ক্লান্তি, যখন সৈন্যরা আমাকে বিরক্ত করে, যখন আমি বেঁচে থাকার জন্য নিজেকে অভিশাপ দিতে যাই, ঠিক সেই সময় আমি আমার হৃদয়ের উপর হাত রাখি। সেখানে তোমার একটা ছবি ঝুলানো আছে। আমি অপলক দেখি আর সাথে সাথে ভালোবাসার অনুভূতি আমার মনকে সুখের সাগরে ভাসিয়ে নিয়ে যায়।

কি যাদু করে তুমি আমার সমস্ত চেতনা আর অনুভূতিকে শুধু তোমার মাঝেই ধরে রেখেছো??? এই অনুভূতিগুলো খুব চমৎকার বন্ধু। ওরা শুধু তখনি অস্তিত্ব হারাবে যখন আমি মারা যাব।

শুধু জোসেফিনের জন্য ভালোবাসাই হবে আমৃত্যু আমার জীবনের ইতিহাস।

আমি তোমার কাছে আসার চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত। দেখো আমি কত বোকা! আমি ভেবেই দেখিনি যে আমি তোমার কাছ থেকে কত দূরে। কত দেশ যে তোমাকে আমার আমাকে আলাদা করে রেখেছে।

কত সময় পরে তুমি আমার এই বন্দী মনের শিশুশুলভ অনুভূতি গুলো পড়বে, যেখানে তুমিই একমাত্র আমার মনের রাণী।

ও আমার প্রিয়তমা স্ত্রী, আমি জানি না আমার ভাগ্যে কি লেখা আছে। কিন্তু এইভাবে যদি আমি তোমার কাছ থেকে দূরে থাকি তবে সেটা হবে অসম্ভব কষ্টের ব্যাপার। সেই কষ্ট সহ্য করার মত সাহস আমার নেই।

কোন একসময় আমি নিজেকে ভীষণ সাহসী ভাবতাম। কখনো কখনো মনে চিন্তা আসতো যে হয়তো ভাগ্যে খুব খারাপ সময় আসবে যখন আমি ভয়ংকর পরিস্থিতিতে পড়বো। কিন্তু এখন আমার জোসেফিন খারাপ থাকতে পারে, বিপদে থাকতে পারে আমাকে কম ভালোবাসতে পারে এমন সব খারাপ ভাবনাগুলো আমার মনকে আছন্ন করে থাকে। আমার শক্তি নিঃশেষ করে দেয়, আমাকে বিষন্ন আর দুঃখিত করে দেয়।

আমার একমাত্র বন্ধু তুমি যাকে আমার ভাগ্য আমার পাশে থেকে জীবনের এই দূর্গম পথ পাড়ি দেবার জন্য বেছে নিয়েছে। যেদিন আমি তোমার মনের আকাশ থেকে হারিয়ে যাব সেদিন আমার জন্য এই প্রকৃতি তার উষ্ণতা এবং প্রাণচাঞ্চল্য হারাবে।

আমি থেমে আছি প্রিয় বন্ধু। আমার অন্তর বিষন্ন, দেহ ক্লান্ত আর মন হতাশাগ্রস্থ। সৈন্যরা আমাকে বয়ে নিয়ে চলেছে আমার মনের আঙিনা থেকে দূরে অনেক দূরে। আমি তাদের ঘৃণা করি।

আমি এখন পোর্ট মরিস-এ, অগনেলিয়ার কাছাকাছি। আগামীকাল এলবেনজা পৌছাবো। দুটো সেনাবাহিনীই আগাচ্ছে। একে অন্যকে হারিয়ে দেবার ইচ্ছা নিয়ে। জয় শুধু বুদ্ধিমানদের জন্য।

আমি বিউলিয়ের উপর খুশি। সে সুন্দর ভাবে তার বাহিনীকে ছড়িয়ে দিচ্ছে। বড় কথা সে তার আগের জেনারেলের চেয়ে মানসিকভাবে অনেক দৃঢ়। কিন্তু আমি তাকে খুব চমৎকার ভাবে পরাজিত করবো বলে আশা করি।

ভয় পেয়ো না। আমাকে ভালোবাসো ততটা যতটা তুমি তোমার ঐ সুন্দর চোখকে ভালবাস। না, হল না। আমাকে ভালোবাস তোমার নিজের মত। উমম, না, তার থেকেও বেশি। তোমার ভাবনার মত, তোমার জীবনের মত, তোমার সবকিছুর মত।

ক্ষমা করে দিও প্রিয়তমা। আমি উন্মাদের মত হয়ে গেছি। প্রকৃতি খুব নাজুক এবং ভঙ্গুর হয়ে যায় যখন কেউ খুব গভীরভাবে অনুভব করে, যখন কেউ তোমার ভালোবাসার ছোঁয়া পায়।

বিদায়! বন্ধু বিদায়! আমি আজো তোমাকে ছাড়ায় বিছানায় যাব, তোমাকে ছাড়ায় ঘুমাবো। পায়ে পড়ি, আমাকে ঘুমাতে দাও। সুখের স্বপ্ন দেখতে দেখতে কতদিন আমি ভেবেছি তুমি আমার বুকের মধ্যে শুয়ে আছো কিন্তু তুমি ছিলে না।

বি.

সকাল বেলাটা শুরু হল প্রত্যাশিত খবর দিয়ে। পিডমন্টিজরাও ছড়িয়ে পড়েছে। খন্ড খন্ড গ্রুপে ভাগ হয়েছে। নেপোলিয়ন এই সময়ের জন্যই অপেক্ষা করছিল। সে একদম শেষ মুহুর্তে তার বাহিনীকে আবার একসাথে জড়ো হবার নিদের্শ দিল। সৈন্যরা অবাক। হচ্ছে কি এসব?? এই দুইদিন আগে বললো ছড়িয়ে পড়ো। আবার এখনি বলে একসাথে হও?? মাথা খারাপ নাকি মানুষটার?? এতসব ভাবনার দোলাচলে থাকলেও সৈন্যরা শৃঙ্খলা মেনে একসাথে হল। ৩৮০০০ হাজার সৈন্য নিয়ে নেপোলিয়ন ঝাঁপিয়ে পড়লো পিডমন্টিজদের খন্ড খন্ড একেকটা গ্রুপের উপর। ফরাসি বাহিনী একেকটা গ্রুপের উপর আক্রমন করছে আর নিমিষেই তাদেরকে শেষ করে দিচ্ছে। সৈন্যরা দেখছে একি কান্ড। যেদিকে যাচ্ছি সেখানেই দেখি ওরা সংখ্যায় অল্প। পিডমন্টিজরা প্রথম হারলো মন্টেনটের যুদ্ধে। এরপরের সপ্তাহে হারলো মন্ডোভির যুদ্ধে। দুই সপ্তাহের মধ্যে হেরে তারা নেপোলিয়নের সাথে শান্তি চুক্তি করলো। ওদিকে অস্ট্রিয়ার বাহিনী কিছুতেই পিডমন্টিজদের কাছাকাছি আসতে পারছে না। কারণ যুদ্ধ একটা জায়গায় হচ্ছে না। নেপোলিয়ন পিডমন্টিজদের শুধু আক্রমনই করছে না। তাদেরকে পিছু হটার সুযোগও দিচ্ছে। ওরা পিছু হটে আরও পিছনে যায়, নেপোলিয়নও ওদের পিছু নিয়ে সেখানে পৌঁছে যায়। অস্ট্রিয়ার বাহিনী এতদ্রুত এগোতে পারেনা। এভাবে ফরাসি বাহিনী সবসময় অস্ট্রিয়ার বাহিনীর ধরা ছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে। সে এক অদ্ভুত স্ট্রাটেজি। তখনকার যুগে বিরল এবং অকল্পনীয়।

পিডমন্টিজদের হারিয়ে নেপোলিয়ন তাদের কাছ থেকে অর্থ দাবী করলো। তারা সবকিছু দিতে বাধ্য হল। নেপোলিয়ন ফিরে এলো তার সৈন্যদের মাঝে। আবার সেই টুলের উপর দাঁড়ালো সে। পিডমন্টিজদের কাছ থেকে পাওয়া অর্থ সৈন্যদের মাঝে বিলিয়ে দিতে দিতে সে মাথার টুপি খুলে একটু ঝুঁকে বললো, ‘সৈন্যরা, আমাদের ধন্যবাদ শুধু তোমাদের জন্য”। সৈন্যদের চোখে খুশি আর আনন্দের ঝিলিক। এতদিন পর তারা বাস্তব অর্থে একটা বড় যুদ্ধ জিতলো। অর্থ পেল। খাবার পেল। খুশি মনে তারা ভাবলো, নাহ। মানুষটা একেবারেই অন্যরকম।

ফরাসি সেনাবাহিনী খুশি। খুবই খুশি। তারা একজন জেনারেল পেয়েছে যে যুদ্ধের ব্যাপারে একেবারেই নতুন ধ্যান ধারণা রাখে। যদিও এই লোকটার সাথে তাল মিলানো খুবই কষ্টের। এখন যদি বলে ডাইনে যাও, একটু পরেই বলবে বায়ে। তবুও তো যুদ্ধ জেতা যাচ্ছে। কীভাবে যেন সে বুঝে ফেলে প্রতিটি যুদ্ধে কী করতে হবে। শত্রুপক্ষের দূর্বলতা বোঝায় তার জুড়ি নেই। সৈন্যদের মাঝে নেপোলিয়নকে নিয়ে অনেক আশা। পারবে, এই লোকই পারবে। না হলে আর সম্ভব না। সৈন্যদের আস্থা অর্জন করতে পেরে নেপোলিয়ন আশ্বস্ত হয়েছে অনেকখানি। কিন্তু মনের গুমোট ভাবটা কেন যেন কাটছে না। সে জোসিফিনকে একটার পর একটা চিঠি লিখে যাচ্ছে। কিন্তু কোন উত্তর নেই। আজ কতদিন হলো জোসেফিন চিঠি লেখে না। সে কি বুঝতে পারছে না নেপোলিয়ন তাকে কতটা ভালোবাসে নাকি সে ইচ্ছা করেই এমন করছে। নেপোলিয়ন দ্বিধাগ্রস্থ। শান্তি নেই। মনে শান্তি নেই। তার খুব ইচ্ছাছিল জোসেফিন তার সাথে আসবে। যুদ্ধক্ষেত্রে না থাকলেও অন্তত ইতালিতে থাকবে। যাতে করে যুদ্ধের ফাঁকে সে জোসেফিনের কাছে যেতে পারে। নেপোলিয়ন বুঝতে পারছে জোসিফিন এখন তার সমস্ত অস্তিত্ব জুড়ে আছে। হয়তো সেই ভালোবাসার বিস্তার হৃদয়ের অনেক গভীরে। নেপোলিয়ন চিন্তিত। হতাশাগ্রস্থ।

এদিকে হতাশাগ্রস্থ মানুষের তালিকায় আরো অনেকের নাম আছে। তার মধ্যে অন্যতম হল জেনারেল এ্যালভিঞ্জি। পিডমন্টিজরা পরাজিত। শুধু পরাজিত না। ফরাসি বাহিনী তাদেরকে আত্মসমর্পনে বাধ্য করে শান্তি চুক্তি করে ফেলেছে। আচ্ছা ওদের এই নতুন জেনারেল নেপোলিয়নটা কে?? কি অদ্ভুত কাজ করলো। লোকটা এমনভাবে আগালো যে তাকে ধরার জন্য অস্ট্রিয়ার বাহিনীর হাজারো চেষ্টা কোনই কাজে আসলো না। এখন তাকে যে করেই হোক নিজেদের অবস্থান ধরে রাখতে হবে। কে জানে এই হতচ্ছাড়া জেনারেল কোথা থেকে কি করে বসে। এ্যালভিঞ্জি ভাবছে। নাহ, নেপোলিয়নকে এডিজ নদী পার হতে দেয়া যাবে না। অস্ট্রিয়া আর ফরাসি বাহিনীর মাঝে এখন একটাই বাঁধা। সেটা হল ইতালির ২য় বৃহত্তম নদী এডিজ। এ্যালভিঞ্জি সব কিছু ভেবে তার বাহিনীকে ভাগ করে নদীর তিনদিকে ছড়িয়ে দিল। মনে মনে সে এখন যথেষ্ট খুশি। নেপোলিয়ন এডিজ পার হতে একটু খালি চেষ্টা করুক। মেরে ছাতু বানিয়ে দেয়া যাবে। শান্তিতে ঘুমাতে গেলো জেনারেল এ্যালভিঞ্জি।

শান্তি নেই জোসেফিনের মনে। নেপোলিয়নের এইসব ব্যাপার তার কাছে ভীষণ বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছে। এটা কেমন কথা। প্রায় প্রতিদিন চিঠি। আর প্রতিটি চিঠির সে কী অদ্ভুত ভাষা। এত আবেগ মানুষ যুদ্ধক্ষেত্রে থেকে যে কীভাবে পায়?? তা চিঠি পড়তে জোসেফিনের খারাপ লাগেনা। কিন্তু তার বিরক্ত লাগে যখন প্রতিটি চিঠিতেই দুটো কথা সবসময় ঘুরে ফিরে থাকেই। একটা হল তাকে চিঠি লিখতে বলা আর দুই নম্বরটা হল তাকে ইতালি যেতে বলা। এই অশান্তি তার ভালো লাগছেনা। আচ্ছা এত ঘন ঘন চিঠি লেখার কি আছে?? মাসে ২টা বা ৩টা চিঠিই কি বেশি নয়?? তারমধ্যে চিঠি লেখাতে ব্যাপারটা সীমাবদ্ধ থাকলে সহ্য করা যেত। কিন্তু এখন নাকি আবার ইতালি যেতে হবে। কি অদ্ভুত। প্যারিসের এই শান্তি ছেড়ে ইতালি যাবার দরকার কি সেট জোসেফিন বুঝতে পারছে না। সে এখন বসে আছে নেপোলিয়নের পাঠানো শেষ চিঠিটি নিয়ে। তার ইচ্ছা করছে চিঠিটি কুটিকুটি করে ছিড়ে ফেলতে। নেপোলিয়ন লিখেছে,

 

এপ্রিল, ১৭৯৬

আমি ১৬ আর ২১ তারিখের চিঠি দুটো পেয়েছি। কিন্তু এমন অনেক দিন আছে যে দিনগুলোতে তুমি আমাকে এক লাইনও লিখোনি। আচ্ছা এই নিরবতার সময়গুলোতে কি কর তুমি বলতো?? নাহ ডার্লিং আমি জেলাস নই, আমি একটু চিন্তিত। তাড়াতাড়ি আমার কাছে চলে এসো। আমি কিন্তু তোমাকে বলে দিচ্ছি, তুমি যদি দেরী কর তাহলে এসে কিন্তু আমাকে সুস্থ্য পাবেনা। তোমার অনুপস্থিতি আর অবসন্নতা খুব প্রবল ভাবে অনুভূত হচ্ছে।

তোমার চিঠিগুলো আমার প্রতিদিনের আনন্দ। কিন্তু দুঃখের বিষয় এমন আনন্দের দিন সংখ্যায় খুব বেশি না। জুনো ২২ টা ফ্ল্যাগ নিয়ে প্যারিসে যাচ্ছে।

তুমি অবশ্যই ওর সাথে চলে আসবে। বুঝতে পেরেছো?? আমি যদি তোমাকে তার সাথে না দেখি তাহলে কি হবে বুঝতে পারো?? আশাহীন দুঃখ, সান্তনা দেয়া যায় এমন কষ্টের অনুভূতি, আর অপরিসীম বেদনার সাগরে ডুবে যাব আমি। আমার প্রিয় বন্ধু, সে তোমার সাথে দেখা করতে যাবে। তুমি তার সাথে আসছো তো, তাইনা?? তুমি এখানে আমার পাশে এসে থাকবে, আমার দুই হাতের বন্ধনে থাকবে। তুমি থাকবে আমার নগ্ন বুকের উষ্ণতায়, আমার ঠোঁটের ছোঁয়ায়।

বুঝলে, ডানা মেলে উড়ে চলে আসো।

তোমার হৃদয়ে একটা চুমু। আর একটা চুমু তার থেকে নিচে, অনেক অনেক নিচে।

বি

 

জোসেফিন ভাবছে এইবার সে কি করবে। অনেক অনেক নিচে চুমুর কথাটা পড়ে বেশ একচোট হেসে নিল সে। মনে মনে ভাবছে, অনেক নিচে চুমুর ব্যবস্থা তো আমি ইতিমধ্যেই করে ফেলেছি নেপোলিয়ন। তোমাকে আর এর জন্য চিন্তা করতে হবেনা। আচ্ছা এইসব কিছু বাদ দিয়ে সে ইতালি কীভাবে যাবে?? নাহ। বড়ই চিন্তার বিষয় হল। ভাবছে জোসেফিন। বাইরে শান্ত বাতাস। ভিতরে অশান্তির ঝড়। দেহে কামনার আগুন। ফায়ারপ্লেসের আগুনের চেয়েও যা কম উত্তপ্ত নয়। আচ্ছা ভালো কথা, আজ রাতে কি চার্লসের আসার কথা আছে?? হুম। আছে তো। তাহলে তো এবার আয়নার সামনে বসতেই হচ্ছে। মনের ভিতর প্রেমের আগুন টের পাচ্ছে জোসেফিন। শরীর সর্বস্ব এই প্রেমের উত্তাপ হিপোলাইট চার্লসকে মোমের মত গলিয়ে ফেলেছে সেটা বুঝতে জোসেফিনের বাকি নেই।

এদিকে ইতালির পরিস্থিতিও ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। এ্যালভিঞ্জির সৈন্য ভাগ করার কথা নেপোলিয়নের কানে এসেছে মাত্র। সাথে সাথে ম্যাপ নিয়ে বসে পড়েছে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে পরিস্থিতি। শেষ পর্যন্ত সে ঠিক করলো তাকে এডিজ নদী পেরোতেই হবে। অস্ট্রিয়ানদের সরবরাহ লাইনের পিছনে না গেলে এই যুদ্ধে জেতা সম্ভব না। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কোন পথে?? অনেক চিন্তা করে নেপোলিয়ন দেখলো আরকোলের ব্রিজের উপর দিয়ে নদী পার হওয়াটাই সব থেকে ভালো হবে। এ্যালভিঞ্জি আছে তিন ভাগে বিভক্ত সৈন্যবাহিনীর মাঝেখানে। সেও হয়তো ভাবছে যে নেপোলিয়ন মাঝখান থেকেই নদী পার হয়ে আক্রমণ করতে আসবে। তবে তাকে আরো বিভ্রান্ত করতে হবে। সে তার অধীনে থাকা ১৮০০০ সৈন্য নিয়ে এডিজের তীর ধরে ডানে সরে যেতে থাকলো। মাঝখানে সে কিছুই রাখলো না। শুধুমাত্র ভেরোনা তে সে জেনারেল মেসেনার অধীনে মাত্র ৩০০০ সৈন্যের একটা দলকে রেখে দিয়েছে।

নেপোলিয়ন আগাচ্ছে। এডিজের উপর একটা পন্টুন ব্রিজ ফেলে খুব সহজেই সে পার হয়ে গেল। খুব অবাক হয়ে সে ভাবছে, এটা কি হল?? অস্ট্রিয়ানরা ঘুমাচ্ছে নাকি?? সে আরো ডানে সড়ে গেল। তার সামনে এখন এডিজের শাখা নদী এলপিন। এলপিনের উপরেই সেই আরকোলের ব্রিজ। কিন্তু নেপোলিয়ন একটা ব্যাপার বুঝতে পারছে না যে অস্ট্রিয়ানরা কোন ধরনের প্রতিরোধ তৈরী করছে না কেন?? ব্যাপারটা বুঝা গেল একটু পরেই। নেপোলিয়ন যা ভেবেছিল তাই। ওরা ভাবেনি যে নেপোলিয়ন ওদের একদম বামে সড়ে এসে এই আরকোলের ব্রিজ দখল করতে আসবে। ওরা এখানে মোটামুটি একটা প্রতিরোধ ব্যবস্থা রেখে নিশ্চিন্তে আছে। নিজের উপর খুবই খুশি নেপোলিয়ন। এই সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। কিন্তু সমস্যা শুরু হল একটু পরেই। ব্রিজের ঠিক ঐ পাশে অস্ট্রিয়ানদের ৪টা কামান, আর সৈন্যবাহিনী। ব্রিজে ওঠা মাত্র ওরা পাখি মারার মত করে ফরাসিদেরকে মেরে ফেলবে। কোন পাগলেও এই অবস্থায় নিজের বাহিনী নিয়ে ব্রিজে ওঠার সাহস দেখাবে না। এ যে স্রেফ মৃত্যু ডেকে আনা। নেপোলিয়ন ভাবছে। সে ঠিক করলো সে ব্রিজের উপরেই উঠবে।

১৫ই নভেম্বর, ১৭৯৬। নেপোলিয়ন এলপেইনের তীরে বেড়ে ওঠা জলাভূমিতে বিশাল বিশাল গাছের ছায়ার ভিতর দিয়ে তার বাহিনী নিয়ে আগাচ্ছে। তারা এখনো জানে না এই লোকটা কি করতে চাচ্ছে। তারা শুধু তার নির্দেশ পালন করছে। তবে মুরিওনের ব্যাপারটা একদম পছন্দ হচ্ছে না। সে খুব ভালো মতই বুঝতে পারছে যে নেপোলিয়ন বিশাল একটা ঝুঁকি নিতে চলেছে। ব্রিজে ওঠার মানেই হলো একসাথে শত্রু বাহিনীর সামনে হেঁটে যাওয়া। আর ওরা ওপাশ থেকে খুব চমৎকার নিশানা করে টিপে টিপে মারবে ফরাসিদেরকে। মুরিওন বুঝতে পারছে না, জেনারেলের মাথায় কি আজ হঠাৎ করে বুদ্ধির অভাব হল কিনা। ব্রিজ থেকে আধাকিলো আগে নেপোলিয়ন নিজের বাহিনীকে থামালো। সে মুরিওনকে বললো

চলো, আমরা একটু ওদের খবর নিয়ে আসি।

কিভাবে জেনারেল।

কীভাবে?? হুম। আমি আর তুমি যাবো। গাছের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে। এই দূরবীনটা দিয়ে দেখে আসবো ওদের অবস্থা।

আপনি কি ব্রিজে ওঠার কথা ভাবছেন, জেনারেল??

আহা চলোই না। দেখে তো আসি।

নেপোলিয়ন, মুরিওনকে সাথে নিয়ে গাছের আড়ালে আড়ালে এগিয়ে গেল। ব্রিজ থেকে খানিকটা দূরে একটা গাছের গুড়িতে হেলান দিয়ে নেপোলিয়ন দেখে নিল অস্ট্রিয়ানদের কাজ-কর্ম। সে যা ভেবেছিলো পরিস্থিতি তার থেকেও ভালো। ওরা এখানে মোটামুটি অপ্রস্তুত বলা যায়। কামানের কাছে লোকজন বসে বসে গল্প করছে। এই কামান থেকে গোলা ছুড়তে ওদের কিছুটা হলেও সময় লাগবে। কিন্তু সমস্যা তবুও একটা থেকে যাচ্ছে। ওদের বন্দুকগুলো তো আর থেমে থাকবেনা। এর অর্থ খুব পরিষ্কার। যেই ব্রিজে উঠবে তাকেই মরতে হবে। নেপোলিয়ন বুঝতে পারছে ব্যাপারটা এত সোজা হবেনা তার জন্য। ব্রিজে উঠার কথা বললে সৈন্যরা মেনে নেবে কিনা সেটা একটা ব্যাপার আর তার থেকেও বড় ব্যাপার হল ব্রিজে ওঠার পর যখন একজন একজন করে সৈনিক মারা যাতে থাকবে তখন তাদের মনোবল ঠিক রাখাটা বিশাল ব্যাপার। নেপোলিয়ন মুরিওনকে বলছে,

চলো হে, আমরা ওদের একটু চমকে দেই।

জেনারেল? আপনি সত্যিই ব্রিজে উঠতে চাচ্ছেন??

নেপোলিয়ন তার দিকে খুব স্থির ভাবে তাকিয়ে বললো, আমি জানি এখন আমাকে কী করতে হবে। তুমি এসো।

মুরিওন ভাবছে, আমি এই মানুষটার গার্ড। আমাকে তার সাথে সাথেই থাকতে হবে। মুরিওনের চোখের পাতা কাঁপছে। দূরে তাকিয়ে সে দেখছে আল্পসের পর্বতে নীলচে মেঘের খেলা। এই দৃশ্য আবার দেখার সৌভাগ্য কি তার হবে???

নেপোলিয়ন তার বাহিনীর কাছে এসেছে। পিছনে দাঁড়িয়ে আছে মুরিওন। নেপোলিয়ন সৈন্যদেরকে পরিস্থিতি বুঝিয়ে কী করতে হবে তা বলে দিচ্ছে। সবকিছু বলার পর সবার চোখের দিকে তাকিয়ে নেপোলিয়ন দেখলো সেখানে মনোবলের বড়ই অভাব। নাহ এভাবে হবেনা। কিছু একটা করতে হবে।

নেপোলিয়ন আবার একটা অদ্ভুত কাজ করলো। সে প্রথমে তার মাথার চওড়া টুপিটা খুলে ফেললো। ফ্রান্সের পতাকা যে বহন করছিলো তার হাত থেকে পতাকাটা নিয়ে দুইহাতে শক্ত করে ধরলো। একবার মাথা উঁচু করে পতাকার দিকে তাকালো। তারপর বললো, সৈন্যগণ আমি এই পতাকার সম্মানে নিজের জীবন দিতে প্রস্তুত। আমি সবার আগে ব্রিজে পা রাখবো। তোমরা কি আমার সাথে আছো??? যারা আছো এসো।

মুরিওন হতভম্ব। এও কি সম্ভব। ফরাসি বাহিনীর ইতালি কমান্ডের প্রধান, সে একটা পতাকা হাতে সবার আগে মৃত্যুর মুখে ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য যাচ্ছে। একি মানুষ না অন্যকিছু?? মুরিওন ভাবছে। ততক্ষনে ট্রাম্পেটে শুরু হয়ে গেছে যুদ্ধের বাজনা। মুরিওন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেনা। নেপোলিয়ন পতাকা হাতে দৌড়ানো শুরু করেছে। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। মুরিওন একবার উপরে আকাশের দিকে তাকালো। আল্পসের পর্বত কত সুন্দর করে সেজেছে এই কুয়াশা মাখা সকালে। মুরিওন দৌড় দিচ্ছে। প্রাণপণে চেষ্টা করছে নেপোলিয়নের কাছে যেতে। এই মানুষটাকে যেভাবেই হোক বাঁচিয়ে রাখতেই হবে।

অস্ট্রিয়ানরা প্রথমে কিছু বুঝতে পারেনি। ট্রাম্পেটের বাজনা যে এত কাছ থেকে শোনা যাবে তা তাদের মাথায়ই ছিলনা। তারা খুব দ্রুত নিজেদেরকে গুছিয়ে নিচ্ছে। এরই মাঝে দেখা গেল সেই অভূতপূর্ব দৃশ্য। একটা লোক ফ্রান্সের পতাকা হাতে ছুটে আসছে ব্রিজের দিকে। আরে পাগল নাকি এই লোক। অমা একি এর পিছনে পিছনে যে ফরাসি বাহিনীও এসে হাজির। এরা কি আজ মদ খেয়ে মাতাল হয়ে গেছে?? সেধে মরতে আসছে। যাক এত চিন্তা করে কি হবে। মরতে আসছে তোদের আমরা মরণ দিচ্ছি। নে, মর এইবার।

নেপোলিয়ন জান বাজি রেখে দৌড়াচ্ছে। সে জানে যেকোন সময় একটা গুলি তার মাথা অথবা বুকে কিংবা পেটে লেগে তার সবকিছু এখানেই থামিয়ে দিতে পারে। কিন্তু সে থামছে না। তার একটাই চিন্তা। ব্রিজের দখল নিতেই হবে। আচ্ছা মুরিওন কই?? সেও কি আসছে?? পাশে তাকিয়ে নেপোলিয়ন দেখে মুরিওন ও তার পাশেই আছে। মাথাটা একটু ঝুকিয়ে সে বুঝাতে চাচ্ছে, জেনারেল আমি আছি। আপনি এগোন। এইতো চাই।

ব্রিজ থেকে ৫৫ কদম দূরে থাকতে প্রথমগুলিটা হলো। নেপোলিয়নের কানের পাশ দিয়ে একটা গরম বাতাস শীষ কেটে ছুটে গেল। সাথে সাথেই একটা আর্তচিৎকার। নেপোলিয়নের বাম হাতে গরম তরলের ছোঁয়া। মারা গেছে তার পাশে থাকা এক সৈনিক। নেপোলিয়ন সৈন্যবাহিনীকে নির্দেশ দিলো পাল্টা গুলি চালালনোর জন্য। কিন্তু নির্দেশ দিলে কি হবে। সৈন্যরা তো এসে বন্দুক তাক করতেই পারছেনা। সামনে থেকে অনবরত গুলি চলছে। একজনের পর একজন সৈন্য ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। নেপোলিয়নের প্রথম চেষ্টা ব্যর্থ হতে চলেছে। হাটু গেড়ে বসে নেপোলিয়ন ভাবছে কি করা যায়। ভাবতে ভাবতেই সে আবার উঠে দাঁড়ালো। আবার সেই দৌড়। এবার ব্রিজের ঠিক গোড়ায় পৌঁছে গেলো সে। কিন্তু সৈন্যরা ঠিক সুবিধা করতে পারছে না। যদিও এখন ফরাসি বাহিনী গুলো চালাতে পারছে এবং ওদের সৈন্যরাও মারা যাচ্ছে তবে এরই মধ্যে ওরা কামান থেকে গোলা বর্ষন শুরু করেছে। সৈন্যরা বেশ ভয় পেয়ে গেল। নেপোলিয়ন দেখছে, এতো ভারী বিপদ হল। শেষে কি পিছনে ফিরেই যেতে হয়। এমনসময় আবার একটা আর্তচিৎকার। খুব কাছ থেকে। গালের ডানপাশে রক্তের ধারা অনুভব করতে পারছে নেপোলিয়ন। চিৎকারটাও পরিচিত তার কাছে। ঝট করে ডানপাশে তাকিয়ে দেখে রক্তে লাল হয়ে গেছে মুরিওনের বুকের ঠিক মাঝখানটা। মুরিওন একটু শুকনো হাসার চেষ্টা করছে। মুখ ভরে আছে রক্তে। হাতটা বাড়িয়ে মুরিওন বলার চেষ্টা করলো, বিদায় জেনারেল। শেষদিকে কথাটা আর শোনা গেল না। নেপোলিয়ন একভাবে তাকিয়ে আছে মুরিওনের দেহটার দিকে। চোখ ভরে যাচ্ছে জলে। নাহ। এইভাবে আর বসে থাকা নয়। নেপোলিয়ন উঠে দাঁড়ালো। চারপাশ থেকে ছুটে যাচ্ছে অসংখ্যগুলি। তাকে উঠে দাড়াতে দেখে সৈন্যরাও উঠে দাড়িয়েছে। নেপোলিয়ন এগিয়ে যাচ্ছে ব্রিজের দিকে। গুলির শব্দে কান পাতা দায়। বারুদের গন্ধে বাতাস ভারী। নেপোলিয়ন দৌড়ে যাচ্ছে। ব্রিজের মাঝামাঝি পৌঁছে সে দেখতে পেল তার পিছন পিছন তার সেনারা ঠিকই এসেছে। তারা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। ক্লান্ত চোখে সামনে তাকিয়ে নেপোলিয়ন দেখলো অস্ট্রিয়ানরা সরে যেতে শুরু করেছে। তার স্ট্রাটেজি কাজে লেগেছে। ওরা পিছনে চলে যাচ্ছে। ফরাসি সেনাদের তখন নতুন উদ্যম। অনেক জীবনের বিনিময়ে হলেও এই আরকোল ব্রিজ দখলের যুদ্ধে তারা জিততে যাচ্ছে।

নেপোলিয়ন ব্রিজ দখল করে ফেললো। এখন আর কোন সমস্যা হবেনা। এখন সে প্রায় পৌঁছে গেছে অস্ট্রিয়ানদের সরবরাহ লাইনের কাছে। সে হঠাৎ একজনের অভাব অনুভব করছে। জেনারেল বলে একটা কণ্ঠের ডাক সে শুনতে চাচ্ছে। কিন্তু পারছে না। সে মনে মনে বলছে, মুরিওন। আমি তোমাকে ভুলবো না।

8

ইতালির ছোট্ট ছিমছাম শহর ভেরোনা। শীতের কুয়াশা ঢাকা সকালে হালকা রোদের ছোঁয়া। কেমন যেন একটা শান্তি চারিদিকে। শুধু শান্তি নেই নেপোলিয়নের মনে। চারিদিকে তার ভালোবাসার মানুষকে নিয়ে, তার জোসেফিনকে নিয়ে কত আজেবাজে কথা শুরু হয়েছে। নেপোলিয়ন এর কিছুই বিশ্বাস করেনি। সে অপেক্ষা করছে তার ঘোড়ার গাড়ির জন্য। আজ তার মিলানে যাবার কথা। শুধুমাত্র জোসেফিন আসবে বলে সে মিলানে একটা এপার্টমেন্ট সাজিয়েছে মনের মত করে। জোসেফিন মিলানে আছে এই খবর নেপোলিয়ন আগেই পেয়েছে। কিন্তু সে যেতে পারেনি এতদিন। হতচ্ছাড়া এই যুদ্ধ তাকে বঞ্চিত করে রেখেছে সবকিছু থেকে। আজ তার মুক্তি। অস্ট্রিয়ানরা পরাজিত প্রায়। ইতালি এখন ফ্রান্সের হাতের মুঠোয়। এতদিনের কষ্ট, আত্মত্যাগ আর অবিশ্রান্ত ভাবে ছুটে চলার দিন শেষ হয়ে যাবে তাড়াতাড়িই। এখন তো নেপোলিয়নের খুশি হবার কথা। কিন্তু সে কেন যেন খুশি হতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে আজকের সকালের এই নরম রোদের মাঝে কেমন যেন হাহাকার মিশে আছে। সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছে না জোসেফিনকে নিয়ে এমন কথা হতে পারে। আচ্ছা, চার্লস হিপোলাইট কি তার চেয়েও জোসেফিনকে বেশি ভালোবাসে?? কথাটা মনে হতেই নেপোলিয়নের চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে। না, তার চেয়ে বেশি ভালোবাসা জোসেফিনকে কেউ কোনদিন দিতে পারবে না। ভাবতে ভাবতেই সে শুনতে পায় গাড়ি প্রস্তুত। নেপোলিয়ন সব হতাশা ঝেড়ে ফেলে গাড়িতে উঠে বসে।

latest video

news via inbox

Nulla turp dis cursus. Integer liberos  euismod pretium faucibua

Leave A Comment