পরাজিত স্বাধীনতার বিজয়ী যোদ্ধা
আর একটি ঘন্টা পরে বিজয় দিবস। হ্যাঁ, বিশ্বের বুকে মাথা তুলে দাঁড়াবার সেই অসামান্য দিন, আর একটি ঘন্টা পরে খুব জাঁক জমকের সাথে পালন করা হবে। এতক্ষনে আলোয় আলোয় ভরে গেছে জাতীয় স্মৃতি সৌধ আর প্রতিটি শহীদ মিনার। রাজপথে কত গাড়ি ছুটছে সাভারের দিকে। রাষ্ট্রপতি যাবেন, প্রধানমন্ত্রী যাবেন। বিরোধী দলের নেতা যাবেন। আরো যাবেন অসংখ্য দলের নেতা, উপনেতা, পাতি নেতা, চামচা নেতা। হয়তো স্বাধীনতার বিরোধী শক্তিও যাবে। আড়াল করে রাখতে চাইবে তাদের জঘন্য ইতিহাস। ক্যামেরা হাতে সাংবাদিকরা ছুটবেন। বিভিন্ন পেশাজীবিরা ছুটবেন। নানা ভাবে, ভঙ্গীতে, সংগীতে, আকারে, ইঙ্গিতে নানা সাজে, কাপড়ের নানান ভাঁজে, মুখে রঙের ছোঁয়ায়, মনে দেশের জন্য অলীক মায়ায় তার ছুটবেন। ক্যামেরার সামনে হুমরি খেয়ে পড়বেন। নিজেদের চেহারা ক্যামেরায় দেখাবার জন্য ধাক্কাধাক্কি করবেন, একজনকে কনুয়ের গুতোয় সরিয়ে, পাজরে লাথি কষিয়ে, দাঁতে দাঁত চেপে তারা চেহারা দেখানোর যুদ্ধে নামবেন। যুদ্ধ শেষে মোবাইলে প্রিয়জন, শালা-শালী, শ্বশুরের আর বাপের বাড়ির চৌদ্দ গুষ্টিকে জানাবেন, ‘আজ রাতে অমুক চ্যানেলের প্রাইম টাইম নিউজটা দেখবেন কিন্তু ভাই’।
কিন্তু এরা কারা?? কী এদের পরিচয়?? এইসব মানুষদের সাথে স্বাধীনতার সম্পর্ক কতখানি?? কতটুকু আত্নত্যাগ তারা করেছিলেন সেই অসাধারণ বিজয়গাথা রচনার প্রতিটি কান্না ঝরা রাতে?? কোন অংগে গুলি খেয়ে, হাত-পা হারিয়ে, পঙ্গু হয়ে আজ তারা এই স্বাধীনতার মঞ্চে বুক ফুলিয়ে ভাষণ দিতে এসেছেন?? আজকের রাতের প্রথম প্রহরে, কিংবা আগামী দিনের প্রতিটি ক্ষণে তারা নিজেদেরকে যেভাবে স্বাধীনতার ধারক ও বাহক বলে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পরিচিত করবেন, সেই গৌরব কি তাদের আসলেই প্রাপ্য?? কালও প্রধান দুই দল একে অপরকে কুৎসিত ভাষায় গালি দেবে। স্বাধীনতার কে ঘোষক আর কে স্বপ্নদ্রষ্টা, আর কে এই চেতনার উত্তরসূরি তা নিয়ে চলবে ধুন্ধুমার কান্ড। কলকিংত এখানে আসলে কে হচ্ছে?? পৃথিবীতে আর কোন দেশ কি আছে, যে দেশের স্বাধীনতার ইতিহাস একেক দলের দৃষ্টিতে একেক রকম??? অথচ দুই দলেই সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেয়া মুক্তিযোদ্ধারা আছেন। সেই প্রবল আত্নবিশ্বাসী মানুষগুলো হয়তো ’৭১ এর সেই অগ্নিঝরা রাতে নিজেদের খাবার ভাগ করে খেয়েছেন। হয়তো একে অন্যের কাঁধে হাত রেখে সাহস যুগিয়েছেন। হয়তো আগামীদিনের মিশনে যাবার আগে চোখের জলে একে অন্যকে বিদায় দিয়েছেন। অথচ সেই মুক্তির সেনানীরা আজ নিজেদের দলের স্বার্থের কাছে বিক্রি হয়ে দেশের চেয়ে দলকে বড় করে দেখছেন। তারা আজ থেকেও নেই। কারণ তারা এই অস্থির সময়ে, নিজের স্বার্থ সবার আগে দেখার যুগে তাদের চেতনা হারিয়েছেন। তারা আজ পরাজিত।
আরো একধরনের মানুষ আছেন যারা আজকের রাতে অথবা আগামীকালের প্রতিটি ক্ষণে অথবা বছরের ৩৬৫ দিনে অশ্রুসজল চোখে এই দেশটাকে দেখবেন। তাদের কেউ হয়তো হুইল চেয়ারে বসে, কেউ হয়তো ক্রাচে ভর দিয়ে অথবা কেউ হয়তো রোগে শোকে বিছানায় শয্যাশায়ী হয়ে মনের মধ্যে দেশের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা লালন করবেন। তারা সেদিন ছিলেন হানাদারদের বন্দুকদের একদম সামনে, বুক চিতিয়ে, চোখের তাঁরায় মুক্তির নেশার ঘোর নিয়ে। আজ তারা থাকবেন না ক্যামেরার সামনে। তারা থাকবেন না কোন টক শো কিংবা বক্তৃতার মঞ্চে। ’৭১ এ তারা নিজ হাতে মুছে ফেলেছিলেন প্রিয় মানুষের হাতে সদ্য আঁকা মেহেদির রঙ। তারা সেদিন বুকে এঁকেছিলেন বাংলাদেশের নাম, ভালোবাসার রক্ত দিয়ে। আজ তাদের জীবন বর্ণহীন। তারা আজ ময়লা, তেল চিটচিটে একটা মুক্তিযোদ্ধা সনদ নিয়ে নিজেদের ভাগ্যের রঙ বদলাতে ব্যস্ত। তারা সেদিন অসীম সাহসে শত্রুকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড ছুঁড়েছিলেন। কিন্তু আজ তারা সরকারী অফিসের একজন পিয়নের সাথেও উঁচু গলায় কথা বলতে ভয় পান।
আজ রাতে অথবা কাল সারাদিনে হরেক রকম গাড়ির বহর ছুটবে নানা দিকে, নানা আয়োজন উপলক্ষে। কিন্তু সেদিনের সেই দেশ অন্তপ্রাণ মুক্তিসেনাদের কেউ প্রতিদিনের মত বের হবেন তার রিকশা নিয়ে। কেউ বের হবেন হাঁটে মাঠে ঘাটে জীবিকার সন্ধানে। অথবা কেউ বসবেন বিজয় দিবস উপলক্ষে আয়োজিত কাঙ্গালী ভোজে – পেটের দায়ে। এর থেকে বড় লজ্জা আর কি হতে পারে??? তারা চোখ ভরা জল নিয়ে দেখবেন নিজ স্বার্থ উদ্ধারকারী, কুলাঙ্গার আর দেশের সাথে বেঈমানী করা মানুষগুলো তাদের দৃষ্টির সামনে দিয়ে নিজেদের প্রবল দাপটে অতীত ভুলে অথবা পালটে দিয়ে কী বিলাসী জীবনেই না ব্যস্ত আছে। তাদের বুকের সেই চাপা কষ্ট শোনা যাবেনা কোন বিজয় দিবসের কনসার্টে। তারা পাবেন না কোন সম্মাননা, স্বীকৃতি বা সম্মান। একটুকরো কাগজের মূল্যহীন সার্টিফিকেট সারাজীবন আগলে রাখবেন পরম মমতায়। মাঝে মাঝে ভাঁজ খুলে দেখবেন আর ফিরে যাবেন সাহসিকতার সেই অদ্ভুত মঞ্চে।
কিন্তু তবুও তারা জয়ী। জীবন যুদ্ধে তারা লড়াই করে যাচ্ছেন অসীম সাহস আর সততা নিয়ে। তারা কোন প্রতিদানের আশা নিয়ে আমাদের কাছে আসেন না। তারা দাবী জানিয়েও কিছু বলেন না। নিরবে নিভৃতে থেকে যাওয়া সেই মুক্তিযোদ্ধারাই সত্যিকার অর্থে দেশের সূর্য সন্তান। পরাজিত স্বাধীনতার তারাই একমাত্র বিজয়ী যোদ্ধা।
পুনশ্চঃ বিজয়ের এই দিনে প্রতিজ্ঞা করছি কোন মুক্তিযোদ্ধাকে চিকিৎসা দেবার সৌভাগ্য হলে নিজের সবকিছু দিয়ে চেষ্টা করবো। বিনিময়ের কোন প্রশ্নই আসেনা।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua