পরাজিত জোছনার কান্না
রাত ২টা বেজে ৩৫। কুইন্স এলিজাবেথ হাসপাতালের তিনতালার ৩১১ নং রুমে বাতি জ্বলছে। হিসাব মত এত রাতে রোগীর ঘরে বাতি জ্বলার কথা না। নার্স লিন্ডা মায়ার উঠে দেখতে যাচ্ছিল কেন বাতি জ্বলছে। তবে কি রোগীর কোন সমস্যা? তাকে হাত ধরে টেনে বসালো তার সহকর্মী এমিলা হ্যান্সন।
লিন্ডা, ব্যস্ত হবার কিছু নেই। তুমি এই ফ্লোরে অনেক দিন পরে ডিউটি তে এসেছো। তাই ঐ পেশেন্ট কে আগে দেখোনি। সে আর ঠিক ২৫ মিনিট পরে বাতি নিভিয়ে দেবে। তবে ঘুমাবে কী না জানি না।
কেন?? ওর ঘুম আসেনা?
হয়তো না। তবে মাঝে মাঝে মনে হয় ঘুম না আসলেই ভালো।
এমন কেন বলছো?
ও ঘুমের মধ্যে অনেক কষ্ট পায়। হয়তো শারীরিক। আমি ঠিক জানিনা। সেদিন রাতে হয়তো সে ঘুমিয়ে গিয়েছিলো। ভোরের একটু আগে শুনি প্রচন্ড ব্যাথায় সে কাতরাচ্ছে। পরে প্রফেসর হার্ডিকে ঘুম থেকে তুলে পেথিডিনের অর্ডার নিতে হয়েছিলো।
কেন? তার মেডিসিনের অর্ডারে তো আছেই। তাও প্রফেসর হার্ডিকে ডাকলে কেন?
শোন, প্রফেসর হার্ডির কড়া নির্দেশ অর্ডার থাকুক বা না থাকুক ব্যাথানাশক কিছু দেবার আগেই তাকে যেন জানানো হয় তা সে যত রাতই হোক না কেন।
ও কি কোন বিগ শট নাকি? যার জন্য প্রফেসর হার্ডির মত মানুষ এতটা চিন্তিত।
আমি ঠিক বলতে পারবোনা। তবে শুনেছি ছেলেটা প্রফেসর হার্ডির খুব কাছের কোন সহপাঠির ছেলে। ছেলেটা অবশ্য বেশ আন্তরিক। বুঝতে পারিনা সে কিভাবে এত নিশ্চিন্তে থাকে। আমি হলে তো এই যন্ত্রনা সহ্য করার আগেই মরে যেতাম। উফফ সে কী কষ্ট।
আমি কাল সকালে ওর ফলো আপে যাব। কোন বিশেষ কিছু কি জানার আছে ওর ব্যাপারে?
তেমন কিছু নেই। তবে ওকে দেখে ভয় পেয়ো না। পিছনের বাগান থেকে ২টা গোলাপ নিয়ে যেয়ো। ও ফুল খুব ভালোবাসে।
ওর কাছের মানুষরা কোথায়?
ওর স্ত্রী আছে। বাবা-মা সবাই আছে। তারা এইতো সামনে আর্চার রোডে একটা বাসায় উঠেছে। তবে রাতে ছেলেটা কাউকে থাকতে দেয়না। জানি না কেন। তুমি পারলে ওর চার্টে একটু চোখ বুলিয়ে নিও। আমি ৩২০-এ যাচ্ছি। বুড়ো জনসনের মেডিসিনটা দিয়ে আসি।
এমিলা ফাইল কেবিনেটের কাছে এগিয়ে যায়। গোলাপি রঙের ফাইলটা হাতে নিয়ে টেবিলে রেখে কফি বানিয়ে নিয়ে আসে। কফিতে চুমুক দিয়ে এমিলা ফাইল খোলে।
দুপুর তিনটার টিউটোরিয়াল শেষ করে ঢাকা ভার্সিটির আইআর আর এর তিনতালার করিডোরে আসতেই মন ভালো হয়ে গেলো অনন্যার। ঝুম বৃষ্টি নেমেছে। ওর খুব ইচ্ছা করছে এখনি নেমে যেতে। কিন্তু বাইরে গাড়ি দাঁড়ানো। আজ কেন যেন বাসায় তাড়াতাড়ি যাবার কথা বলে দিয়েছে আম্মু। শান্তাকে ওর নোট বুঝিয়ে দিয়ে যেই নীচতলার সিড়ির দিকে পা বাড়াবে তখনি চোখে পড়লো দৃশ্যটা। এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে একটা হালকা-পাতলা ছেলে কয়েকটা পিচ্চির সাথে সামনের ছোট্ট মাঠে ফুটবল খেলছে। পিচ্চি গুলো এখানকারই টোকাই। এত গুলো পিচ্চির সাথে এত বড় একটা ছেলে ফুটবল খেলছে দেখতে খুবই হাস্যকর লাগার কথা। সবার মাথা ওর কোমরেরও নিচে। কিন্তু ব্যাপারটা দেখতে খুব একটা খারাপ লাগছেনা ওর। কারণ এই দৃশ্য দেখে সে খুব একটা অবাক হয়নি। ছেলেটাকে চেনে ও। রাতুল। ফিজিক্স থার্ড ইয়ার। ভার্সিটিতে পাগল বলে যার আলাদা একটা পরিচয় আছে সবার কাছে। সাম্যবাদ, নাস্তিকতা আর জীবন দর্শনে স্বকীয়তা এই তিনের মিলিত যোগফলের নাম রাতুল। ছেলেটার সাথে পরিচয় টিএসসি-র একটা অনুষ্টানে। তখনো ও জানতো না যে এই ছেলেটা ফিজিক্সের ছাত্র হয়েও অবলীলায় জীবনান্দ থেকে আবৃত্তি করে। খুব সহজেই রবার্ট ফ্রস্ট কিংবা জন ডান থেকে কোট করে। আবার একটু পরে সেই ছেলেটাই পার্টিকেল ফিজিক্স থেকে কোয়ান্টাম থিওরি দিয়ে সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে সন্দিহান হয়। জীবনের সব বিষয়ে অমিল থাকলেও একটা ব্যাপারে ওর সাথে রাতুলের খুব ভালো মিলে যায়। কবিতা। হ্যাঁ, রাতুল কবিতার খুব ভক্ত। যদিও ওর আবৃত্তি এতটা ভালো না তবে কবিতা ও খুব পছন্দ করে। আর এজন্যই রাতুলের সাথে মাঝে মাঝে আড্ডায় বসে ও টিএসসি তে। হঠাৎ মোবাইলের শব্দে চমকে ওঠে ও। ড্রাইভারের ফোন। ব্যাটা ওকে নিচ থেকে বারান্দায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ফোন দিয়েছে। লাইন কেটে নিচে নেমে যাবার আগে আর একবার দৃশ্যটা দেখে ও। কেন দেখে নিজেও জানে না। তবে বুঝতে পারে তার মনে এখন প্রবল একটা ইচ্ছা কাজ করছে। সেটা হলো এই ঝুম বৃষ্টিতে ঐ ছোট্ট খেলার মাঠে ইট দিয়ে বানানো একটা গোলপোস্টের নিচে দাড়াতে। অনন্যা জানে ইচ্ছাটা পূরন হবার নয়। আর সত্যি বলতে ইচ্ছাটা হওয়ায় উচিত নয়। নিজেকে খুব দ্রুত সামলে নেই সে। এই আবেগ প্রশয় দেয়া যাবে না। কিছুতেই না। গাড়িতে উঠে চলে যাবার ঠিক আগে নিজের অজান্তেই আবার পিছনে ফিরে তাকায় সে। রাতুল হাতে বল নিয়ে দৌড়াচ্ছে আর ওর পিছু পিছু ছেলে গুলো। চোখ ভিজে ওঠে অনন্যা র। ও জানে এই কান্নার মানে। কিন্তু এই কান্নার প্রতিটি ফোঁটা যার জন্য সে কিছুই জানে না। আর তাকে জানানোর মত এত বড় ভুল সে কখনোই করবে না। কিছু কিছু কথা কখনো বলতে হয় না।
বারান্দায় বসে সিগারেটে টান দিতেই কাশিটা আর আটকে রাখতে পারে না রাতুল। এই একটা সমস্যা গত কিছুদিন থেকেই হচ্ছে ওর। সিগারেটে টান দিলেই কাশি। আগে এমন ছিলো না। অবশ্য খুব বেশি দিন ও সিগারেট ধরেনি। আজ অবশ্য আর একটা ব্যাপারও হচ্ছে। সিগারেটটা খুব বিস্বাদ লাগছে ওর কাছে। নিজের গায়ে হাত না দিয়েও ও বুঝতে পারে জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। তবুও এই ঠান্ডা ঠান্ডা বাতাসে বসে থাকতে ওর ভালোই লাগছে। একটু আগে মা ডেকে গেছে খাবার জন্য। কিন্তু এখন খেতে যাওয়া যাবেনা। গেলেই মা জ্বরের ব্যাপারটা বুঝে যাবে। ডাক্তার ফ্যামিলির এই একটা সমস্যা। সামান্য জ্বর-কাশি হলেই একগাদা উপদেশ দেয়া শুরু করবে। তবে ভালো যে এখন বাবা বাসায় নেই। চেম্বারে। তাই ঝুঁকিটা নেয়ায় যায়। চুপচাপ উঠে একটু খেয়ে আসলে বা খাবার নিয়ে আসলে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা না তার। যদিও সে নিজেই জানে না আসলেই এই অবস্থায় সে খেতে পারবে কিনা। মোবাইলে সময় দেখে একটু অবাক হয় ও। রাত সাড়ে বারো। এখনো বাবা বাসায় ফেরেনি। বাবা যে বাসায় ফেরেনি এটা সে ভালোই বুঝতে পারছে। বাবা বাসায় আসলে নিয়ম হলো সবাইকে একবারের জন্য হলেও ফ্যামিলি স্পেসে জড়ো হতে হবে। নিজেদের খোঁজ-খবর নেবার এই ব্যাপারটা ভালোই উপভোগ করে রাতুল। মাঝে মাঝে বেশ মজাও হয়। বিশেষ করে রিমির মেডিকেল পরীক্ষার দিনগুলোতে। তখন ঘটনা গুলো হয় এরকম।
বাবা হাসিহাসি মুখে রিমি কে জিজ্ঞেস করবেন, কাল কোন আইটেম আছে মা?
সাথে সাথেই রিমির মুখটা ছোট হয়ে যাবে। ওকে দেখে তখন মনে হবে কাল আইটেম পরীক্ষার জন্য সে খুবই লজ্জিত এবং একই সাথে বিরক্ত। সে যতটা সম্ভব স্বাভাবিক ভাবে বলার চেষ্টা করবে আইটেমের নাম। এরপর বাবা তাকে একটা প্রশ্ন করবেন। যদি সে পারে তবে সে পাশ। আর যদি না পারে তবে মোটামুটি ৩০ মিনিটের একটা লেকচার শুনতে হবে তাকে। লেকচারের শেষে একটা ঘটনা বাবা উল্লেখ করবেনই। তার আর তার বন্ধু হার্ডির লন্ডনের ইম্পেরিয়াল কলেজের ঘটনা। এই ঘটনাটা শুনতে শুনতে তাদের সবার মুখস্ত হয়ে গেছে। তবুও বাবা প্রতিবার বলার সময় তারা এমন ভাব করে যেন জীবনে প্রথম শুনছে। ঘটনাটা হলো, এনাটমি ক্লাশে বাবার একজন লেকচারার ছিলেন জন খাইরিলস নামে। সবাই তাকে খুবই ভয় পেতো। যাকে বলে হাটু কাপাকাপি টাইপ ভয়। তো একদিন ডেমোনেস্ট্রশন ক্লাশে উনি পেলভিক ভিসেরা পড়াবেন। হার্ডিকে উনি ভ্যাজাইনার ভিসেরা দিয়ে বর্ণনা করতে বললেন। হার্ডি কোন মতে ভিসেরা হাতে ধরে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বলে উঠলো,
This is uterus, Sir. It has, has…………has……….
সবাই মাথা নিচু করে আছে। কেউ কেউ মুচকি হাসছে। বিশেষ করে মেয়েরা। জন খাইরিলস প্রচন্ড অবাক হয়ে একবার ভিসেরার দিকে তাকাচ্ছেন একবার হার্ডির দিকে তাকাচ্ছেন। শেষে খুব মিষ্টি করে উনি বললেন,
My boy, didn’t you ever see a vagina?? Not even in your dream?? Or somewhere else?? If you didn’t, then I am really sorry for you my child. Now get lost and come back again when you think you are able to be in my class.
এই কথাটা বলার সময় বাবা খুব হাসবেন। বাবার হাসি দেখে আমাদেরও হাসি চলে আসবে। পরিস্থিতি হালকা হয়ে যাবার পর বাবা তার বন্ধুর এখনকার কথা বলে রিমিকে বলবেন, মা, ব্যর্থতাই সফলতার চাবিকাঠি। সুতরাং তুমি আইটেম নিয়ে চিন্তা করো না। ভবিষ্যতে তুমিও হার্ডির মত বড় ডাক্তার হতে পারবে। রিমি মাথা তুলে বাবার দিকে তাকাবে। ওর চোখে বড় ডাক্তার হবার স্বপ্ন স্পষ্ট বুঝা যাবে। এই মেয়েটা কেমন যেন। ওর চোখ দেখেই সব বলে দেয়া যায়। মেয়েদের এমন হলে চলে না। মেয়েদের হতে হবে রহস্যময়ী। যে রহস্যের পিছনে ছেলেরা ছুটে বেড়াবে। তারা হারিকেন, হ্যাজাক, টর্চ এমনকি চার্জার নিয়েও খুঁজবে রহস্যের কিনারা। কিন্তু পাবেনা। নাহ, এই মেয়েকে দিয়ে কিচ্ছু হবেনা। রাতুল আর একটা ব্যাপার মনে মনে ঠিক করে রেখেছে। যদি কোনদিন ওর সাথে হার্ডির দেখা হয় তখন সে হার্ডিকে জিজ্ঞেস করবে সে কিভাবে আবার ঐ টিচারের ক্লাশে যাবার যোগ্যতা অর্জন করেছিলো। রাতুল ডাইনিং এ যাবার জন্য পা বাড়ালো। তখনি ওর চোখ অন্ধকার হয়ে গেলো। ওর মনে হচ্ছে ও এক গভীর খাদে পড়ে যাচ্ছে। ওর শরীর খুবই হালকা লাগছে। প্রচন্ড শীতের অনুভূতির সাথে সাথে একটা গাঢ় ভয়ের অনুভূতি ওকে গ্রাস করছে। ও শুধু অস্ফুস্টে বলে উঠলো, মা। মা।
আজ ৫টি দিন হলো রাতুলকে ভার্সিটিতে না দেখে বেশ অবাক হয়েছে অনন্যা । নিজের মানসিক অস্থিরতায়, আকুলতায় নিজেই নিজেকে অনেক প্রশ্ন করেছে। তার সব প্রশ্নের উত্তর গিয়ে শেষ হয়েছে একটা বাক্যে, একটা অনুভবে। সেটা হলো কেউ একজন যেন ভিতর থেকে তাকে বলে দিচ্ছে ফিসফিস করে, “বালিকা তুমি তোমার মনের পদ্ম গুলোকে আবেগের থালায় সাজিয়ে নিজের অজান্তেই এই বোহেমিয়ান যুবকটিকে সমর্পণ করেছো পূজার অর্ঘ্য হিসাবে। এখন তোমার আর ফিরে যাবার উপায় নেই। নারীর প্রেম অনবদ্য, তার প্রেমে নেই মত্ততা, আছে স্নিগ্ধতা। নেই অস্থিরতা, আছে শান্ত বিহ্বলতা। এবার কি হবে তোমার???” এই প্রশ্নের কোন উত্তর সে খুঁজে পাচ্ছেনা, খুঁজতে চাচ্ছেও না। সে এখন খুঁজে বেড়াচ্ছে রাতুলকে। ফোনের পর ফোন, মেসেজের পর মেসেজ। কিন্তু কোন উত্তর নেই। ছেলেটা এমন অদ্ভুত কেন? গত ২দিনে রাতুল সাধারণত যেসব জায়গায় থাকতে পারে তার সবগুলোই একবার করে ও দেখে এসেছে শুধু একটা বাদে। আজ ও ঠিক করেছে পাবলিক লাইব্রেরির পিছনের চত্তরটা দেখে রাতুলকে না পেলে ওর বাসায় চলে যাবে। যদিও আজ জারিন ম্যাডামের খুব ইম্পর্টেন্ট ক্লাশ মিস হল। কিন্তু এখন আর কোন কিছুই ওর মাথায় নেই। রাতুলকে খুঁজে পেতেই হবে। অনন্যা যখন পাবলিক লাইব্রেরির পিছনের চত্তরে তখন বিকেলের সূর্য্য তার শেষ আলো বিতরণে ব্যস্ত। ক্লান্ত চোখের কোনায় চিকচিক করা জল নিয়ে অনন্যা দেখে রাতুল ওখানে নেই।
গত তিনদিনে একটা ব্যাপার খুব অদ্ভুত লেগেছে রাতুলের কাছে। কেমন যেন একটা অনুভূতি। মেয়েটা এতবার ফোন দিচ্ছে কেন বুঝে পাচ্ছেনা সে। মেসেজ দিয়েছে বেশ কয়েকটা। সব গুলোতেই একটা কথা। “কি ব্যাপার, ভার্সিটিতে দেখি না যে? কেমন আছো? কোন প্রবলেম?”
দোয়েল চত্তরের সামনের রাস্তায় ফুচকার গাড়ির পাশে ফুটপাতে বসে রাতুল মনে মনে ভাবে আসলেই কি কোন সমস্যা হচ্ছে ওর? সেদিন রাতে ওর ঘুম ভেঙেছিল ভোরের দিকে। ঘুম ভেঙে নিজেকে সে ফ্লোরেই আবিষ্কার করেছিলো। কিন্তু মাথাটা ওভাবে কেন ঘুরে উঠেছিল সেটার কারণ এখনো বের করতে পারেনি। নিজের প্রতি সীমাহীন অবহেলা তার এটা সে জানে। তবুও আজ সে নিজেকে নিয়ে কিছুটা হলেও চিন্তিত। সাথে অবশ্য অন্য একটা ব্যাপার নিয়েও ভাবছে। সেটা হলো এই কবিতাওয়ালী। ইচ্ছা করেই ও কোন যোগাযোগ করছে না মেয়েটার সাথে। এটা ওর চরিত্রের একটা অদ্ভুত দিক। মানুষ সাধারণত তার প্রতি বেশি আগ্রহ দেখায় যে তাকে জানতে চায়। কিন্তু ও সেটা করে না। এমন না যে এটা ইচ্ছাকৃত। কিন্তু ওর প্রতি কেউ আগ্রহ দেখালে সে তাকে এড়িয়ে যায়। কিন্তু আজ এই নিয়মে ব্যতিক্রম হয়ে যাচ্ছে। ও একটা প্রবল আগ্রহ বোধ করছে মেয়েটার প্রতি। খুব ইচ্ছা করছে ফোন করতে বা মেসেজ দিতে। কিন্তু নিজেকে অনেক কষ্টে সে সামলে রেখেছে। এত দিনের নিয়মে কোন ব্যতিক্রম হওয়া যাবে না। এজন্যই এখন সে মোবাইল অফ করে রেখেছে। যদিও মনের অস্বস্তি দূর করতে পারেনি। প্রকৃতি মাঝে মাঝে কি চায় এটা রাতুল বুঝতে পারেনা। যেমন এখন ওর মনের চাওয়াটাও ওর কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না। রাতুল এখন চাচ্ছে ওর সাথে অনন্যার দেখা হোক। কেন চাচ্ছে জানে না। শুধু জানে ওর ইচ্ছা করছে অনন্যার সাথে খুব ঝাল দেয়া ফুচকা খেতে। ঝালের চোটে চোখ মুখ লাল হয়ে যাবে। কিন্তু ওরা পানি খাবেনা। দেখবে কে কতক্ষন পানি না খেয়ে থাকতে পারে। আজব চিন্তা ভাবনার জগত থেকে ওকে বাস্তবে ফেরালো ফুচকাওয়ালা।
মামা, আপনেরে ডাকে।
কে ডাকে? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে রাতুল।
উত্তরে ফুচকাওয়ালা কিছু না বলে একটা গাড়ির দিকে ইশারা করে।
একটা ব্লু কালারের হোন্ডা সিভিকের পিছনের জানালা দিয়ে একটা ছোট্ট মাথা বের হয়ে আছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। চোখ দেখতে পাচ্ছেনা রাতুল। মানুষ এমন একটা প্রাণী যে চোখ দেখে অন্য মানুষের মনের ভাব বুঝে থাকে। এখন রাতুল বুঝতে পারছেনা মেয়েটা কি চাচ্ছে। হাতের ইশারা সে দেখতে পাচ্ছে। কিন্তু এমন একটা ভাব করছে যে সে দেখতে পাচ্ছেনা। ধীরে ধীরে গাড়ির দরজা খুলে যাচ্ছে। একই সাথে প্রচন্ড বিরক্তি আর আনন্দের অনুভূতি নিয়ে একটা খুব সাধারন মেয়ে তার দিকে এগিয়ে আসছে। রাতুল বুঝতে পারছে না তার কি করা উচিত। বুঝতে বুঝতেই অনন্যা তার পাশে এসে বসলো।
হাকাউ! হাকাউ!! হাকাউ!!!
অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে রাতুল জিজ্ঞেস করলো, এটার মানে কি?
হাকাউ, হাকাউ, হাকাউ।
আরে আজব? এটার মানে বলবে তো।
এটার মানে একটু আগে তুমি যা বললে তাই। এটার মানে হলো অদ্ভুত কিংবা আজব।
তাই নাকি? কোথায় পেলে এই শব্দ?
আমার বাবা খুব অবাক হলে মাঝে মাঝে এই শব্দটা বলে। এটা দিনাজপুরের আঞ্চলিক ভাষা। এবার বলো তোমার সমস্যা কি? মানুষতো একটা রিপ্লাই দেয়। বা একবার ফোন ধরে। কি হয়েছে, শুনি। তার আগে শুনি রিপ্লাই না দেবার কারণ।
আমি তো ফোন ব্যবহার করছিনা। এই যে দেখো আমার কাছে কোন ফোন নেই।
তারমানে কি? এই যুগে তুমি কি মোবাইল ছাড়া থাকতে চাও নাকি?
না, আসলে একটা পরীক্ষা করছিলাম নিজের সাথে। তবে পরীক্ষার কথা পরে বলবো। আগে তুমি বলো আমাকে এভাবে খোঁজার মানে কি?
এই প্রশ্নের কোন উত্তর দেয়া যাবে না, রাতুল। কেন খুঁজছিলাম জানি না। মাথা নিচু করে বলে অনন্যা।
রাতুলে চোখে কৌতুক। বেশ আন্তরিকতার সাথে সে বলে, আসো একটা কাজ করি। আমরা ২ প্লেট ফুচকার অর্ডার দেই। খেতে খেতে কবিতার মাধ্যমে মনের ভাব প্রকাশ করি। নিজেরদের প্রশ্নগুলোর উত্তরও কবিতার মাধ্যমেই দেয়া যাবে। এটাতে তোমার-আমার দুইজনেরই সুবিধা।
খানিকটা ভেবে অনন্যা রাজি হয়। ঠিক আছে। তুমি শুরু কর। আচ্ছা যাও আমি শুরু করছি। রাতুলের চোখে তাকিয়ে অনন্যা শুরু করে,
আলো-অন্ধকারে যাই- মাথার ভিতরে
স্বপ্ন নয় কোন এক বোধ কাজ করে;
স্বপ্ন নয়-শান্তি নয়- ভালোবাসা নয়,
হৃদয়ের মাঝে এক বোধ জন্ম লয়;
আমি তারে পারি না এড়াতে,
সে আমার হাতে রাখে হাত;
সব কাজ তুচ্ছ মনে হয়,- পন্ড মনে হয়,
সব চিন্তা- প্রার্থনার সকল সময়,
শূন্য মনে হয়, শূন্য মনে হয়।
How do we know Eve and Adam were happy,
deprived, as they were, of a childhood?
Eve never knew, unlike Adam, a world
that was free of the chatter of others.’
How did she cope? And how could she choose,
if she’d wanted, to live by herself?
What did the man eat that made him hear voices,
while Eve was inventing frustration?
পৃথিবীর বাঁধা- এই দেহের ব্যাঘাতে
হৃদয়ে বেদনা জমে; – স্বপনের হাতে
আমি তাই আমারে তুলিয়া দিতে চাই।
যেই সব ছায়া এসে পড়ে
দিনের-রাতের ঢেউয়ে,- তাহাদের তরে
জেগে আছে আমার জীবন;
সব ছেড়ে আমাদের মন
ধরা দিত যদি এই স্বপনের হাতে,
পৃথিবীর রাত আর দিনের আঘাতে
বেদনা পেত না তবে কেউ আর-
থাকিত না হৃদয়ের জরা,-
সবাই স্বপ্নের হাতে দিত যদি ধরা।
অনন্যার চোখের কোণায় জলটা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে রাতুল। অবাক হয়ে ও তাকিয়ে আছে এই মেয়েটার দিকে। খুব সাধারণ একটা মানুষ – একটা মেয়ে, এক প্লেট ফুচকা হাতে, চোখ ভরা ভালোবাসার জল নিয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে। দূরের দিগন্তের লালা আভায় চিকচিক করছে সেই জল। সেখানে রাতুল দিব্যি দেখতে পাচ্ছে ওর নিজের মুখ। আনমনে ফুচকা মুখে দেয় ও। ঝালে মুখটা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু ওরা তো ঝাল দিতে বলেনি। নিজের মনের সেই খেলার ভাবনার কথাটাও তো অনন্যাকে বলা হয়নি। তাহলে আজ এসব কী হচ্ছে?? ও ভাগ্য বিশ্বাস করেনা, সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস ছেলেমানুষি মনে হয়। কিন্তু আজ সব বোধকে কে নাড়িয়ে দিয়ে যাচ্ছে?? কেন যাচ্ছে??? ও দূরে তাকিয়ে থাকে।
কি ব্যাপার?? উত্তর দিচ্ছোনা কেন? কবিতা পছন্দ হয়নি?
তুমি কি জানো তুমি কি বলছো? অনন্যার দিকে না তাকিয়েই রাতুল জিজ্ঞেস করে।
হ্যাঁ। আমি জানি। আমি যা বলেছি সেটা আমার মনের কথা। এবার তুমি যেকোন কিছু বলতে পারো। না বলতে চাইলেও কিছু বলবো না। তবে সবার আগে একটু কোকের ব্যবস্থা কর। আমি এখানকার পানি খাবো না। ঝালে মুখ পুড়ে যাচ্ছে। এত ঝাল কেউ দিতে বলে??? যাও কোক নিয়ে আসো। আমি অপেক্ষা করছি।
রাতুল হাসি মুখে কোকের খোঁজে যাচ্ছে। কোক কাছে পিঠে কোথায় পাওয়া যাবে মনে করতে পারছেনা। সে হাটছে টিএসসি-র দিকে। অনন্যা ব্যাগ থেকে টিস্যু বের করে ঠোঁট মুছে নেয়।
১৫ মিনিট পরে ২ হাতে ২টা কোক নিয়ে ফিরে এসে রাতুল প্রচন্ড অবাক হয়ে দেখে মেয়েটা চলে গেছে। ও শুধু অবাক হয়ে আপন মনে বলে ওঠে হাকাউ! হাকাউ!! চটপটি মামাকে বিল দিতে গেলে মামা হাসি মুখে বলে, আপায় বিল দিয়া গেছে। আর এইটা আপনারে দিতে কইছে।
রাতুল চোখ বড়বড় করে একটা টিস্যু পেপার হাতে নেয়। ভাজ খুলে পড়ে দেখে একটা ছোট্ট কথা লেখা। একটা কবিতা আশা করছি উত্তর হিসাবে আজ রাতে।
যত্ন করে টিস্যুটা পকেটে রেখে, একবার দূরের নীলিমার দিকে তাকিয়ে একটা সিগারেট ধরিয়ে ও বাসার পথে হাটা দেয়। এলোমেলো এই জল-জোছনার উত্তর তার মাথায় আসছেনা। জন ডান, রবার্ট ফ্রস্ট, জীবনানন্দ সবাই একসাথে মিটিং করলেও উত্তর বের হয়ে আসবে কিনা ও সন্দিহান। শেষে রবিবাবু এসে যদি কিছু করতে পারেন। রাতুল বাসায় এসে অনুভব করে ওর আবার শীত শীত লাগছে। মুখটা তেতো হয়ে যাচ্ছে। সাথে পিঠে বেশ ব্যথা। ঘোর লাগা চোখে বিছানায় শুয়ে ও মোবাইল অন করে। মেসেজ লেখার চেষ্টা করেও কিছুই মনে করতে পারছেনা ও। সব কবিতা অর্থহীন মনে হচ্ছে। অথবা প্রকাশ করতে পারছে না ওর মনের কথাটা। শেষে নিজেই একটা কবিতা লেখার চিন্তা করে। শব্দ খুঁজতে খুঁজতেই ও ঘুমিয়ে যায়। গভীর ঘুম।
চোখে মুখে পানির ছিটায় যখন ওর ঘুম ভাঙে তখন দেখে তিন জোড়া চোখ ওর দিকে অপলক তাকিয়ে আছে। উঠে বসতে গেলে মা বাঁধা দেয়।
খবরদার উঠবে না। তোমার মাথায় পানি দেওয়া হচ্ছে। এত জ্বর তোমার, তুমি বাসায় এসে বলোনি কেন???
আমি জ্বরই তো বুঝিনি। বাসায় এসে শীত শীত লাগছিলো। শুয়ে ছিলাম। কখন ঘুমিয়েছি নিজেই জানি না। এখন কয়টা বাজে?
কেন? সময় দিয়ে কি হবে? চুপচাপ শুয়ে থাকো। এখন জ্বর কমেছে। তাও ১০২। রিমি তোমার রুমে এসে দেখে তুমি শুয়ে আছো। কী মনে করে ও কপালে হাত দিয়েই আমার কাছে দৌড়ে আসে। তোমার বাবা এইস খেতে বলেছে। আমি স্যুপ নিয়ে আসছি। তারপর এইস খাবে।
এ্যাই রিমি! সময় কত রে?
এখন রাত দেড়টা। কেন ভাইয়া? সময় দিয়ে কি করবি?
আমার মোবাইলটা দে। একজনকে একটা কবিতা লিখে পাঠাতে হবে। আজ রাতের মধ্যেই।
রিমি অবাক হয়ে মোবাইলটা বাড়িয়ে দেয়। বিস্ময় মাখা স্বরে জানতে চায়, কিসের কবিতা? জন্মদিনের শুভেচ্ছা?
না। এটা হলো কবিতার উত্তরে কবিতা। আমার মাথাটা মুছিয়ে দে। এখন অনেক ভালো লাগছে। বারান্দায় গিয়ে বসবো। মা কে বলিস স্যুপটা বারান্দায় দিয়ে যেতে। আমি এখন ভালো আছি।
রাতুল বারান্দায় গিয়ে বসে। আকাশে অনেক বড় একটা চাঁদ। আজ পূর্ণিমা ওর মনেই ছিলোনা। আচ্ছা সূর্যের আলোতে তো আল্ট্রাভায়োলেট রে থেকে শুরু করে আরো কত ওয়েভ লেংথের রশ্নি থাকে। চাঁদের আলোতে কি এমন কিছু আছে?? কেউ কি কখনো এটা বের করার চেষ্টা করেছে যে কোন ওয়েভ লেংথের আলো প্রতিফলিত হয়ে এমন সুন্দর, মায়াময় জোছনার সৃষ্টি হয়। এটা কি প্রকৃতির নিজের খেয়াল? নাকি এর পিছনে কোন স্রষ্টার হাত আছে?? রাতুল মেসেজ পাঠায়।
আমি জানি না তাকে
আমি চিনি না যাকে
আজ তার জন্যই এই জোছনা মাখা রাত
এই লজ্জা রাঙা প্রহরের সবটুকু আলো
অথবা সবটুকু আঁধার
হয়তোবা দুটোর সম্মীলনে তৈরী যে ছায়া
আমি তারই মাঝে খুঁজে পেতে চাই
আমার ভালোবাসার মায়া।
ক্লান্ত চোখে বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে রাতুল। ২টা শালিক পাখি নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করছে। আচ্ছা কে যেন বলেছিল “One for sorrow, two for joy”- দুজন মানেই যদি আনন্দ তবে পাখি দুটো ঝগড়া করছে কেন??? নাকি এটা ওদের মধুর ঝগড়া? ঝগড়া কখনো মধুর হয়? হ্যাঁ, হয় তো। আজও তো একটা মধুর ঝগড়া হয়ে গেলো ওর আর অনন্যা র মধ্যে। জীবনে বেঁচে থাকার যে কী আনন্দ, ঝগড়া করার মাঝে যে কী অসামান্য সুখ এখন সেটা অনেক বেশী অনুভব করতে পারে সে। জীবন থেকে অবসর নেবার সময় কাছে এসেছে বলেই কী জীবনের প্রতি এই আকুলতা???
আজ সকালে একজন নতুন সিস্টার আসলো। রাতুল তখন কেবিনের বারান্দায় বসে। উনাকে আগে দেখেনি কখনো। মিষ্টি হেসে খুব সুন্দর ২টা গোলাপ রাতুলের হাতে দিলো।
-“একটা তোমার আর একটা তোমার বউ এর জন্য। নাকি আমি গোলাপ দিলে তোমার বউ রাগ করবে?? হা হা হা”।
উত্তরে একটা মুচকি হাসি দিলো রাতুল। এদের মেডিকেল সার্ভিসের এই একটা দিক খুব প্রশংসনীয়। এদের অসাধারণ পেশেন্ট ম্যানেজমেন্ট। আজ প্রায় ২ মাস যখনি কোন নতুন নার্স বা ডাক্তার এসেছে, এমন ভাবে কথা বলেছে যেন ওকে অনেক দিন থেকে চেনে। ওদের এমন ব্যবহারে রাতুল অভ্যস্ত। কিন্তু আজ বেশ অস্বস্তি লাগছিলো এই নতুন সিস্টার, এমিলার, চোখের দিকে তাকিয়ে। তার চোখে কেমন একটা করুণার ছায়া। মানুষের চোখের ভাষা পড়তে পারার এই ক্ষমতা রাতুলের আগেও ছিলো। কিন্তু গত ৬ মাসে সেই ক্ষমতার অনেক উন্নতি হয়েছে। এখন রাতুল কেউ এলে সবার আগে তার চোখের ভাষা পড়ার চেষ্টা করে। একেক জনের চোখের ভাষা এক এক রকম। বাবা, মা, অনন্যা, রিমি এদের মত প্রিয়জনদের চোখের ভাষাতেও অনেক পার্থক্য। এমনকি গত ৬ মাস ধরে তাদের চোখের ভাষাতেও কিছু পরিবর্তন এসেছে।
৬ মাস আগে প্রথম যখন ল্যাব এইডে ডাঃ মালেক চাচা ব্লাড রিপোর্ট দেখে ভুরু কুঁচকে বাবার দিকে তাকিয়েছিলো তখন তার চোখে ছিল সন্দেহ ও আতঙ্কের এক মিশ্র অনুভূতি। আর বাবার চোখে ছিল অবিশ্বাস। আবার ব্লাড দেওয়া লাগলো। তবে এবার পপুলারে। এবার মালেক চাচার চোখে কি ছিল তা দেখা যায়নি। কারণ রিপোর্ট নিয়ে শুধু বাবা গিয়েছিল চাচার চেম্বারে। ফিরে এসে বাবা যখন আমার রুমে এলো তখন তার চোখে একরাশ হতাশা। এক মাসে ৩য় বারের মত ব্লাড দিতে হলো আমাকে। এবার আইসিডিডিআরবি তে। রিপোর্ট নিয়ে বাবা আর মালেক চাচা পিজিতে গেলেন হেমাটোলোজির বড় একজন ডাক্তারের কাছে। ফিরে এসে বাবা আর আমার রুমে আসেনি। রিমিও সে রাতে আমার রুমে আসেনি একটিবারের জন্য। মা আর অনন্যা অনেকক্ষন বারান্দায় বসে কি কথা বললো তাও আমি শুনতে পাইনি। তবে বেশ বুঝতে পারছিলাম আমার এমন কিছু হয়েছে যা খুব খারাপ কোন ধরনের অসুখ। লাইট নিভিয়ে শুয়ে ছিলাম বলে অনন্যার চোখ দেখতে পাইনি। মায়ের চোখও না। তবে সারারাত আমার মাথায় হাত রেখে অনন্যা যে একটু পরপর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল তা বুঝতে একটুও কষ্ট হয়নি। আমি কাউকে কিছুই জিজ্ঞেস করিনা। কারণ জিজ্ঞেস করলেই তাদের কষ্ট অনেক বেড়ে যাবে। আমি শুধু বিছানায় শুয়ে থাকি। মাঝে মাঝে জ্বরের ঘোরে অস্থির হয়ে উঠি। পিঠের ব্যাথাটা সাংঘাতিক কষ্ট দেয়। এর মাঝেই পড়তে শুরু করি মানুষের চোখের ভাষা। ইদানিং আত্নীয় স্বজনরা বেশ আসছে বাসায়। বড় খালু এলেন। উনার চোখে আমার জন্য সে কী করুণা। আমার খুব খারাপ লেগেছিলো তখন। খালা মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে এসে কেঁদে কেটে একটা কান্ড করলেন। কারও চোখে করুণা দেখলেই আমার ভীষণ কষ্ট হয়। এজন্য আমি বাসার মানুষ ছাড়া আর আস্তে আস্তে সবার সাথে দেখা করা বন্ধ করে দিলাম। বাসার মানুষ গুলোর চোখে আমি করুণা দেখিনা। মায়ের চোখ বেশির ভাগ সময় ফোলা থাকে। সেই চোখের দৃষ্টি গভীর মমতায় মাখানো। মাঝে মাঝে আতংক এসে ভড় করে সেখানে। তখন মা খুব শক্ত করে জড়িয়ে ধরে রাখে আমাকে। মায়ের চোখের পানিতে আমার মুখ ভেসে যায়। আমি হাসি মুখে মায়ের চোখ মুছে দিয়ে বলি,
-“দেখো, আমার কিচ্ছু হবেনা। আমি তোমায় এত সহজে মুক্তি দেবোনা মা। তোমায় আরো অনেক জ্বালানোর বাকি আছে আমার। এখনতো আমি একা। কিছুদিন পরে আমার ফুল ফ্যামিলি তোমাকে জ্বালাবে। হা হা হা”।
মা আরো জোরে শব্দ করে কেঁদে ওঠেন।
বাবা ইদানিং কেন যেন তেমন একটা আসেন না। এখন বাবাকে দেখলে যে কেউ বলবে যে মানুষটা হঠাৎ করে বুড়িয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। রাতে ঘুমাননা ঠিক মত। সারাক্ষন মোবাইলে কার কার সাথে যেনো কথা বলেন। গতকাল শুনলাম ভিসা পেতে এত দেরি কেন হচ্ছে সেটা নিয়ে এজেন্টের সাথে চিল্লাচিল্লি করছেন। রাতে আমার রুমে এসে আমার পাশে বসেছিলেন বেশ কিছুটা সময়। মাথা নিচু করে বিড়বিড় করে কি সব বলে গেলেন। আমি খুব চেষ্টা করছিলাম বাবার চোখটা দেখতে। কিন্তু পারছিলাম না। হয়তো বাবা চাচ্ছিলেন না তার চোখের ভালোবাসার জলটা আমি দেখে ফেলি। কিন্তু আমি আমার জ্বরে পোড়া হাতে বাবার চোখের পানির ফোঁটার অস্তিত্ব অনুভব করতে পারছিলাম। আহ! কী প্রশান্তি সেই শ্রাবণ-ধারায়। বাবা বলে গেলেন আমরা খুব তাড়াতাড়ি ইংল্যান্ডে যাচ্ছি। শুধুই আমার জন্য। আমার তখন মনে হলো ছোট বেলায় কোথাও যাবার কথা শুনলে আমার খুব আনন্দ হত। যাবার ৭ দিন আগে থেকেই আমার ব্যাগ গুছানো শেষ। যদিও যাবার পর দেখা যেত আমি আমার সব থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসটা আনতেই গুলে গেছি। একবার খুব মজার একটা ঘটনা হয়েছিল। আমরা গেলাম শ্রীমঙ্গলে। রেস্ট হাউজে থাকার ব্যবস্থা। সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠে দেখি আমি ব্রাশ আনতে ভুলে গেছি। কিভাবে এই ভুলটা হলো মনে করতে পারছি না। কিন্তু এখন আমার কি হবে? দাঁত ব্রাশ না করে থাকা অসম্ভব। আর ধারে কাছে ব্রাশ পাওয়া যাবে সে সম্ভাবনাও নেই। আমি মুখ হাড়ি করে ঘুরে বেড়াচ্ছি। হঠাৎ মা আমার দিকে ব্রাশ এগিয়ে দিলো। সে আমার জন্য আলাদা একটা ব্রাশ এনেছিলো সাথে করে। মায়েরা আসলে এমনি হই। তাদের কিছু বলে দিতে হয়না।
এখন অবশ্য আমার নিজের ব্যাগ নিজেকে গুছাতে হবেনা। আমার মাও এখন সে দায়িত্ব থেকে ছুটি নিয়েছে। এখন আমার পাশে আছে খুব সাধারণ একটা মেয়ে। সারাক্ষনই আছে। আমি ওর চোখের ভাষাও পড়েছি। প্রথমে সেই চোখে ছিল অবিশ্বাস। আমার যে এত শক্ত একটা অসুখ হতে পারে তা সে বিশ্বাস করতে পারেনি। এখন সেখানে কেমন একটা বিহ্বলতা কাজ করে। মাঝে মাঝে রাতের বেলা চোখ মেলে দেখি সে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। রাতের ঘন কালো আকাশের সাথে নিজের ভাগ্যের খুব মিল খুঁজে পায় মনে হয়। মাত্র দেড় বছর তার সংসার জীবন। এসময় স্বামীর সাথে তার নিজের ছেলে-মেয়ের নাম ঠিক করার কথা। নাম নিয়ে রাতে মিষ্টি মিষ্টি ঝগড়া করার কথা। মাঝে মাঝে রান্না করে বাড়ির সবাইকে খাওয়ানোর কথা। কিংবা ছোট বোনের মত ননদের সাথে শপিং এর লিস্ট বানানোর কথা। আর সে কিনা এখন এক অনিশ্চিত যাত্রার লিস্ট বানাতে ব্যস্ত। ওর চোখে মাঝে মাঝে আমি এক প্রবল আত্নবিশ্বাস দেখি। ও খুব সুন্দর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আমাকে নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখায়। ওর চোখে তখন সব কিছু জয় করার মত তেজ। সেই আলোতে, সেই তেজে আমার মনের হতাশা গুলো ক্ষনিকের জন্য হলেও পালিয়ে যায়। আমি আবার ভালো হবার কথা ভাবি। ওর হাত ধরে বসে দোয়েল চত্বরে খুব ঝাল দেওয়া ফুচকা খাবার কথা চিন্তা করি।
রিমিটা কেমন যেন চুপসে গেছে। আগের মত আর সারা বাড়ি মাতিয়ে রাখেনা। ও কিছুই লুকাতে শেখেনি। আমার ঘরে এলে ও অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে। আগের মত আর আমার সাথে দুষ্টামিও করেনা। কিছু আবদারও করে না। হয়তো বুঝে গেছে এখন আমার দেবার আর কিছুই বাকি নেই। এখন হলো দুহাত ভরে নেবার সময়। প্রিয় মানুষগুলোর অকৃত্রিম ভালোবাসা, তাদের যত্ন, তাদের মমতার ছোঁয়া আর তাদের আবেগের জল। আমার মনের কোঠরে প্রতিদিন এগুলো জমা হচ্ছে। কিন্তু আমি তাদেরকে কিছুই দিতে পারছিনা। আমার এখন শুধুই জমানোর পালা।
প্রফেসর হার্ডি মানুষটা খুবই মজার। ঠিক বুঝা যাচ্ছেনা এটা তার স্বাভাবিক আচরণ নাকি পেশাগত ব্যবহার। তার সাথে প্রথম দেখার ঘটনাটা খুব মজার ছিল। গোলগাল চেহারার একটা মানুষ হাতে একটা স্যান্ডুইচ নিয়ে কেবিনে এসেই বলে উঠলো,
-“হ্যালো মিস্টার রাটুল, আজ তোমার ব্রেকফাস্টের পার্টনার আমি। কি? দেখে পছন্দ হচ্ছে তো? নাকি কোন লেডি ডক হলে বেশী ভালো হত? হা হা হা”।
আমি প্রথমেই ওকে যেটা বললাম সেটা হলো, -“শোন, আমার নাম রাটুল না, রাতুল। তুমি নামটা আবার বলো। নাম ঠিক ভাবে বলতে না পারলে তোমার সাথে ব্রেকফাস্ট করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। আর এটা কি বডি স্প্রে ব্যবহার করেছো? গন্ধে বমি আসছে”।
হার্ডি তো হার্ডি আমার বাবা, মা এমনকি অনন্যার চোখগুলোও হয়েছে দেখার মত। বাবা কিছু বলতে যাবার আগেই আমাকে অবাক করে দিয়ে হার্ডি হো হো করে হেসে উঠলো। বাবার দিকে তাকিয়ে বললো, -“তোমার ছেলেটা তোমার মতই হয়েছে। লাইক ফাদার, লাইক সন”। খেতে খেতে রিপোর্ট গুলোর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলো, -“তোমার কি কোন ধারণা আছে যে তোমার কি অসুখ করেছে? অথবা তোমার শরীরে তার ভয়াবহতা কোন পর্যায়ে আছে?”
আমি খুব খুশি খুশি গলায় বললাম, -“তুমি কি জানো আমি আর পৃথিবীর কিছু অসাধারণ মানুষ একই রোগ বহন করে চলেছি যারা তাদের মনের জোরে এই রোগটাকে জয় করতে পেরেছে। পল এলেন-মাইক্রোসফটের সহ প্রতিষ্ঠাতা, তার এই অসুখ করেছিলো অনেক আগে। কিন্তু সে তার কাজ ঠিকই করে গেছে। ডন কোহান-আমেরিকান সেইলর, ৪২ বছর বয়সে ওর যখন এই অসুখ ধরা পড়লো তখন ও ছিল স্টেজ ৪বি তে। অসম্ভব মনের জোর নিয়ে সে ৭২ বছর বয়সে ইউএস সেইলিং চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলো। তবে আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি ড্যানিয়েল হশার এর মত হব না। যার মা কেমোথেরাপির ভয়ে ছেলেকে নিয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো”।
হার্ডি কিছুক্ষন মাথা নিচু করে থেকে বললো, “তোমার কেমো শুরু হবে আগামী পরশু থেকে”। আমার হাত ধরে আস্তে একটু চাপ দিয়ে বাবাকে ডেকে কেবিন থেকে বের হতে যেয়ে কি মনে করে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, -“মাই বয়, এই শতাব্দিতে যদি কেউ পারে তবে সেটা তুমিই”।
ওর চোখে আমি সেদিন দেখেছিলাম আমার প্রতি পিতার স্নেহের সমতূল্য মায়া। অজানা অচেনা একটা মানুষের আমার প্রতি এই গাঢ় ভালোবাসা সেদিন আমাকে মুগ্ধ করেছিলো। হঠাৎ আমার মনে হলো আমি ঐ প্রশ্নটা করতে ভুলে গেছি। তার টিচার খাইরিলস কে সে কিভাবে ম্যানেজ করেছিলো। পরের বার দেখা হলে জিজ্ঞেস করতে হবে।
এমিলা যখন রাতুলের কেবিনে ঢোকে তখন সে চিন্তাও করতে পারেনি সে এই দৃশ্য দেখবে। ভোর বেলা বাগান থেকে সে বেছে বেছে ২টা গোলাপ তুলেছিল। রাতুলের রুমে যেয়ে দেখে সে বারান্দায় বসে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। রাতুলকে ডেকে বিছানায় আসতে বলে সে চার্টে চোখ বুলাচ্ছিলো। রাতুল বিছানায় শোয়ার পর যখন সে প্রথমবারের মত রাতুলের দিকে ভালো করে তাকালো তখন হঠাৎ একটা ধাক্কার মত লাগলো তার কাছে। কেমোর রোগী অনেক খারাপ হয় তা সে জানে। তাই বলে এমন? কংকাল সদৃশ্য একটা মানুষ বিছানায় শুয়ে আছে। মাথার চুল চোখে গোনা যাচ্ছে। গালের চামড়া কুঁচকে চেহারাটা হয়েছে বীভৎস। ডান হাতে ক্যানুলাটা কোন রকমে হাতের সাথে লেগে আছে। সাদা, ফ্যাকাসে রক্ত শূন্য একটা মুখ। সে বিপি মাপার জন্য এডাল্ট কাফ এনেছিলো। কিন্তু এখন তাকে আবার যেতে হবে। বাচ্চাদের সাইজের কাফ আনার জন্য। যাবার আগে রাতুলকে ফুল দুটো দিয়ে সে রাতুলের চোখের দিকে তাকালো। কী উজ্জ্বল আর স্বচ্ছ সে চোখ। যেন জীবনের সব যুদ্ধে জয়লাভ করার পর সে এখন বিশ্রামের কথা ভাবছে। অথবা শেষ যুদ্ধে বিপক্ষের শক্তিমত্তায় সে মোটেও চিন্তিত নয়। শেষ যুদ্ধের প্রতিপক্ষ হতে পারে খুব ভয়ংকর কোন কিছু। তাতেও তার কিছু আসে যায় না।
রাতুলের এখন আসলেই কিছুতেই কিছু আসে যায় না। আজ ওর শেষ কেমো দেয়া হবে। তারপর আবার ব্লাডটেস্ট। এরপর কি তা ও জানেনা। ওর খুব ইচ্ছা করছে একছুটে দেশে চলে যেতে। যেখানে ওর স্বপ্নের মেঘগুলো ছুটে বেড়ায়। বাগান বিলাসী গাছের পাশে বসে ও একমনে কবিতা পড়বে। মাঝে মাঝে অনন্যা এসে ওর ভরাট গলায় আবৃত্তি করবে। ও আবার হাটতে চায় সেই ক্যাম্পাসে। জোছনা দেখতে যেতে চায় সমুদ্রের পাড়ে। এটা নিয়েই তো আজ অনন্যার সাথে ওর ঝগড়াটা হলো। ঘটনাটা ঘটলো দুপুরের একটু পরে। এখন রাতুল বলতে গেলে কিছুই খেতে পারেনা। খাবার দেখলেই ওর বমি আসে। আজ রাতে শেষ কেমো দেবার পর কি করবে ওরা সেটা নিয়েই কথা হচ্ছিলো। রাতুল বলছিলো,
-“কেমো তো শেষ হবে আজ। আমি ঠিক করেছি এক সপ্তাহ পর দেশে যাবো। বাড়িতে কিছুদিন বিশ্রাম নিয়ে তোমাকে নিয়ে সেন্টমার্টিন ঘুরে আসবো। কেমন হবে বলতো? আর মজার কথা কি জানো আমরা জোছনার সময় দেখে যাবো। ভাবো একবার, তুমি আমি আর আমাদের সামনে বিশাল সমুদ্র আর……”
-“ব্যস! হয়েছে রাতুল, আর কথা না”। রাতুলের কথা শেষ হবার আগেই অনন্যা ওকে থামিয়ে দেয়। ওর মনে রাজ্যের চিন্তা। কেমোর পরের ব্লাড রিপোর্টের উপর নির্ভর করছে অনেক কিছু। দুশ্চিন্তায় ওর এখন রাতে আর ঘুমও আসে না। অনন্যা দেখে রাতুল চুপ হয়ে গেছে। নিজের উপর অনন্যা এখন যথেষ্ট বিরক্ত। কি দরকার ছিল মানুষটাকে চুপ করানোর। বলছিলো বলুক না। ও জড়ানো গলায় বললো,
-“তুমি থামলে কেন? সমুদ্রের সাথে আর কি থাকবে? জোছনা?? বাতাস আর? বলো না। এ্যাই বাবু? বলো না”।
হঠাৎ অনন্যার হাত নিজের হাতে নিয়ে রাতুল বলে, -“বাবু, তুমি কি জীবনে শেষবারের মত আমার সাথে একটু যাবে ঐ দারুচিনি দ্বীপে? প্লিজ। আমি জানি আমি আর বেশীদিন থাকবো না তোমার এই হাতটা ধরে। আমি তোমার চোখের তাঁরায় হারানোর খুব বেশী সুযোগ পাবো না তো বাবু। প্লিজ। এবার আমাকে বাঁধা দিও না। আমি ধবল পঙ্খী নায়ে উঠার আগে একবার মন ভরে জোছনা দেখতে চাই, সমুদ্র ছুঁতে চাই। তোমার হাত ধরে প্রবালের জংগলে হেঁটে বেড়াতে চাই। শেষ বেলার কবিতাটুকু তোমার সাথে গলা মিলিয়ে আবৃত্তি করতে চাই”।
অনন্যার চোখ ভেঙে কান্না পাচ্ছে। টপটপ করে পানির ফোঁটা গুলো পড়ছে রাতুলের মুখে। রাতুল বলে যাচ্ছে-
-“আমি জানি না আমি পারবো কিনা। আমি জানি না আর কতটুকু সময় আমার হাতে আছে। আমি এই সময়টুকুর প্রতিটি মূহুর্ত, প্রতিটি ক্ষন নিজের মনের আনন্দে বাঁচতে চাই। তোমার সাথে, বাবা-মার সাথে। রিমির সাথে। আমরা সবাই যাবো। একসাথে। রিমির কত ইচ্ছা ছিলো ও জোছনা রাতে সমুদ্র-স্নান করবে। এবার আমরা একবারে সব শখ পূরণ করবো। প্লিজ তুমি না বলো না। আমি জানি তুমি বললে বাবা-মা অমত করবেন না। তারা যে তোমাকে কতটা ভালোবাসে তা তুমি নিজেও জানো না”।
অনন্যা শক্ত করে রাতুলকে জড়িয়ে ধরে। কতটা শক্ত করে ধরলে মৃত্যুর প্রচন্ড শক্তিকেও হার মানানো যায়? উত্তরটা জানা তার খুব, খুব বেশী দরকার।
গত পরশু দুপুরে রাতুলরা দারুচিনি দ্বীপে এসে পৌঁছেছে। সেন্টমার্টিনের পিছনের দিকে একটা নিরিবিলি কটেজ ভাড়া করেছে ওরা। আসার পড়েই রাতুল জ্বরে পড়েছে। আজ একটু ভালো। এ কদিনে ওর জোছনা দেখা হয়নি। আজ রাতুল ভালো বোধ করাতে সবাই ঠিক করেছে আজ ওরা জোছনা দেখবে রাতে। পুরো কটেজ ভাড়া করাতে ওদের সাথে আর কেউ নেই। রিমি আর অনন্যা মিলে ঠিক করেছে আজ সামুদ্রিক মাছের বার-বি-কিউ করা হবে। মাছ আনা হবে ২টা। কোরাল হলে ভালো। অনন্যা কেয়ারটেকারের সহকারী নুরু মিয়াকে বলে দিয়েছে যে করেই হোক কোরাল মাছ আনতে হবে। নুরু মিয়া এখন যাচ্ছে ব্যাপারি বাড়ি। মাছের দাম কত হবে আর সে কত বলবে এরই মধ্যে সে সেটাও ঠিক করে ফেলেছে। এদের দেখে মনে হচ্ছে এরা বিশাল বড়লোক। টাকা কোন সমস্যাই না। সে এই পরিবার সম্পর্কে ভাবছে। তার কাছে এই পরিবার এক বিরাট আশ্চর্য। পরিবারের সাথে কাজের লোক কাউসার মিলে ৬জন মানুষ। তারা পুরা কটেজ ভাড়া করেছে। সে অবশ্য এজন্য আশ্চর্য না। সে অবাক হয়েছে যে এরা এরকম একজন অসুস্থ মানুষকে সাথে করে ঢাকা থেকে কিভাবে এখানে এসেছে। আরে রোগী মারা যায় যায় অবস্থা। তোরা এখন থাকবি ঢাকা মেডিকেলে। নাহলে দেশের বাইরের কোন হাসপাতালে। মেয়েছেলে বাসায় সুর করে কোরআন তেলাওয়াত করবি। গরীব-মিসকিন খাওয়াবি। খাজা বাবার দরবারে গিয়া মানত করবি। এইসব না কইরা তোরা এই খানে হাওয়া খাইতে আসছোস। আফসোস! বড়ই আফসোস।
অনন্যা বারান্দায় বসে মাছ কাটা দেখছে। নুরু মিয়া বিশাল ২টা মাছ এনেছে। ওর মনটা এখন খুবই খারাপ। একটু আগে রাতুল একবার বমি করেছে। জ্বর অবশ্য এখনো বাড়েনি। ওদিকে বেছে বেছে আজকের দিনেই আকাশের মুখ গোমড়া। কালো মেঘে আকাশ ঢেকে আছে। রাতে চাঁদ দেখা যাবে কিনা এটা নিয়ে এখন তার সন্দেহ হচ্ছে। না হলে রাতুল অনেক কষ্ট পাবে। বাবা বলছিলেন কালই ঢাকায় ফিরতে চান। উনার কেন যেন রাতুলের অবস্থা ভালো মনে হচ্ছেনা। কেমোর সাইড ইফেক্ট খুব খারাপ। তবে অনন্যা ঠিক করেছে কাল যেহেতু ঢাকায় ফিরে যেতেই হবে তাই আজ একবার রাতুলকে নিয়ে ও সমুদ্রের পাড়ে বসবে। জোছনা থাকুক বা না থাকুক।
এখন কত রাত রাতুল জানেনা। ওরা বসে আছে একটা প্রবালের উপরে। অনন্যার কাঁধে মাথা রেখে রাতুল সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে আছে। বেশ কিছুটা দূরে বাবা-মা। আর রিমি আরো দূরে হাটছে আপন মনে। ওর মনের ইচ্ছা মত সব কিছু হয়নি। আকাশ মেঘে ঢাকা। চাঁদ দেখা যাচ্ছেনা। যদিও হিসাব মত আজ মাথার উপরে একটা মস্ত বড় চাঁদ থাকার কথা। তারপরও রাতুলের বেশ ভালো লাগছে। সমুদ্রের ঢেউ গুলো সাদা ফেনায় ভেঙে যখন ওর পা ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে ওর মনে হচ্ছে পৃথিবী শেষ বিদায়ের আগে ওর পা ধুইয়ে দিচ্ছে পরম মমতায়। অনন্যার হাতটা শক্ত করে ধরে ও শুনছে বেলা শেষের গান। হঠাৎ বহুদূর থেকে ভেসে আসা মিষ্টি সুরের মত অনন্যার কথা শুনতে পায় ও।
-“শীত লাগছে বাবু? আর একটা চাদর দেবো?”
-“নাহ। ঠিক আছি। বেশ ভালোই লাগছে। যদিও আমার স্বপ্নের মত হচ্ছে না। তবুও ভালো লাগছে”।
-“হুম। আজ কেন যে জোছনটা হলো না। আকাশ এমন করতে পারলো আমাদের সাথে? বলো?”
-“বাবু, সৃষ্টিকর্তা আমাকে ভালোবাসেন না। তাই তিনি আমার শেষ ইচ্ছা পূরণ করলেন না? কাপাকাপা গলায় বলে রাতুল”।
-“ওর মুখে সৃষ্টিকর্তার কথা শুনে ভীষণ অবাক হয় অনন্যা। তুমি সৃষ্টিকর্তায় তো বিশ্বাস করতে না রাতুল। আজ একথা বলছো কেন?”
-“আগে করতাম না। কিন্তু ইউকে তে বসে অনেক চিন্তা করে দেখলাম যতই আমরা গড পার্টিকেল বের করি না কেন এই অসীম জগতের সুন্দর শৃঙ্খলা কোন মাস্টার প্লান ছাড়া নিজে থেকে হওয়া সম্ভব না। আমি অন্ধ যুক্তিতে অজানাকে দেখতে চেয়েছি। অথচ আমি বিশ্বাসের চোখে তাকে খুঁজতে চাইনি। আমি জানি না সেই মহান সত্তা আমায় ক্ষমা করবেন কিনা। আমি জানি না মৃত্যুর পরে আমার পরিণতি কি হবে। তবে আমি বিশ্বাস করি না বুঝে তাকে বিশ্বাস করার চেয়ে বুঝে বিশ্বাস করার মূল্য তিনি অবশ্যই দেবেন। অনন্যা? শুনছো?”
-“হুম। বলো”।
-“একটা কবিতা শোনাবে। জোছনা নিয়ে যেকোন কবিতা”।
-“এই অন্ধকারে জোছনার কবিতা তোমার ভালো লাগবে, বাবু?”
-“অনন্যা, জানো, আমার কেন যেন মনে হচ্ছে এই মেঘ থাকবেনা। তোমার কবিতা শেষ হবার আগেই এই মেঘ সরে গিয়ে জোছনার আলোয় চারিদিক আলোকিত হবে। কেন মনে হচ্ছে আমি জানি না। তবে মনে হচ্ছে”।
-“তাই নাকি? আচ্ছা দেখা যাক। ঠিক আছে আমি শুরু করছি”।
রাতের নিরবতা, মেঘে ঢাকা আকাশ, নির্জন সমুদ্র পাড়ে জলের হাহাকার আর অনন্যার আবেগ মেশানো ভরাট গলার আবৃত্তি- রাতুলের মনে হয় বিদায় বেলাটা ঠিক এমনি হওয়া উচিত। ঠিক এমন।
“আমার এ গান
কোনদিন শুনিবে না তুমি এসে,-
আজ রাত্রে আমার আহবান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে,-
তবুও হৃদয়ে গান আসে।
ডাকিবার ভাষা
তবুও ভুলি না আমি,-
তবুও ভালোবাসা
জেগে থাকে প্রাণে,
পৃথিবীর কানে
নক্ষত্রের কানে
তবুও গাই গান;
কোনিদিন শুনিবে না তুমি তাহা,- জানি আমি –
আজ রাত্রে আমার আহ্বান
ভেসে যাবে পথের বাতাসে, –
তবুও হৃদয়ে গান আসে”।
কবিতা শেষ হবার আগে হঠাৎ অনন্যা অবাক হয়ে দেখে চারিদিক আলোয় ভরে গেছে। চোখ মুছে তাকিয়ে দেখে জোছনার আলোয় ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। আকাশে মস্ত বড় থালার মত একটা চাঁদ। চাঁদের দেখা পেয়ে সমুদ্র জেনে মেতে উঠেছে কোন এক আদিম উল্লাসে। হঠাৎ ওর মনে হলো রাতুলের হাতটা ওর হাতের মধ্যে নেই। ও বললো,
-“বাবু? এ্যাই বাবু? ঘুমিয়ে পড়লে নাকি? বাবু দেখো না! তোমার কথাই সত্যি হলো। আজ তোমার জন্যই সৃষ্টিকর্তার এই আয়োজন। তিনি তোমাকে ক্ষমা করেছেন বাবুটা। কি হলো? কথা বলো না কেন?”
রাতুলের মাথাটা যখন অনন্যার কোলে পড়লো তখনও রাতুলের মুখে একচিলতে হাসি। কী এক অদ্ভুত নির্ভরতায় পরম নিশ্চিন্তে সে ঘুমিয়ে পড়েছে তার প্রিয় মানুষের কোলে মাথা রেখে। তার চোখে জোছনার আলো পড়েছিলো কিনা অনন্যা জানেনা। শুধু তার এখন মনে হচ্ছে আজকের জোছনা পরাজিত হয়েছে। নিবিড় বিহ্বলতার আবেগ মেশানো মনে সে শুধু বুঝতে পারে এটা সবকিছু হারিয়ে নিঃশ্ব হওয়া এক পরাজিত জোছনার কান্না।
পরিশিষ্টঃ
রাতুলের কী অসুখ হয়েছিলো তা উল্লেখ করতে ইচ্ছা করলো না। গল্পে যে তথ্য দেওয়া আছে তা নেটে দেখলে অনেকেই পেয়ে যাবেন। অসুখের বর্ণনা দিতে একেবারেই ইচ্ছা করেনা। মানুষের আনন্দের কথা বলাটা যত সুখের কষ্টের কথা বলাটা ঠিক ততখানি কষ্টের কিনা জানি না। তবে শেষ বেলায় এসে আমার নিজের চোখটা কেন যেনো ভিজে যাচ্ছিলো।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua