ধর্ম, বিজ্ঞান ও আমরা
প্রচুর বিতর্ক হচ্ছে বিষয়গুলো নিয়ে। বিতর্ক আগেও ছিল। অনেক আগেও ছিল। তারও আগে থেকেই ছিল। বিতর্ক আর কাঁদা ছোড়াছুঁড়ির মধ্যে মোটা দাগে অনেক বড় পার্থক্য আছে। মানুষ বিতর্ক করে অন্তত কিছুটা হলেও জেনে শুনে। কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি করতে কোন জ্ঞান লাগেনা। পড়াশোনা করতে হয় না। নিদেন পক্ষে গুগলে দুইটা সার্চও দিতে হয় না। কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি তে লাগে কাঁদা, প্যাক। বিতর্ক মানুষকে আলোকিত করে। না জানা অনেক বিষয়ে জানতে সাহায্য করে। কাঁদা ছুঁড়ে আপনি আরেকজনকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করতে পারবেন। সেই সাথে নিজেও তাই হবেন। কাঁদা তো আপনার গায়েও লাগবে।
আমরা আদতে একটি উগ্রবাদী জাজমেন্টাল জাতি। আমরা জাজমেন্ট বা বিচার করতে খুব ভালোবাসি। বিচার করি খুব দ্রুত। সমস্যা হচ্ছে খুব দ্রুত বিচার করার কারণে আমরা সমস্যার গভীরে যেতে পারি না। তথ্যের নির্ভুলতা যাচাই করার সময়টুকুও আমরা নেই না এবং কাউকে দেইও না। এটাকেই আমরা খাস বাংলায় বলি – হুজুগ। বাজি ধরে বলছি। আপনি একটা পোস্ট দেন এরকম – “কে সেরা? আর্জেন্টিনা না ব্রাজিল?” কিংবা “বিশ্বের সেরা ফুটবলার কে? – মেসি না রোনাল্ডো?” আমি নিশ্চিত আপনি সেখানে ৯৫ ভাগ মানুষকে পাবেন যারা একজনকে ভালোবেসে অন্যজনকে গালি দিবে। খুব কম মানুষই আপনাকে যুক্তি, তথ্য ও উপাত্ত দিয়ে বুঝাতে চাইবে তার চোখে কে সেরা এবং কেন।
আমাদের মানসিকতায় সহাবস্থান শব্দটার বোধকরি কোন স্থান নেই। পৃথিবীতে দুটো জিনিস যে একসাথে ভালো হতে পারে তা আমাদের মাথায় আসে না। আবার দুটো জিনিস যে একসাথে খারাপ হতে পারে তাও আমাদের মাথায় আসে না।
ধর্মের সাথে অন্ধ শব্দটা খুব যায়। কারণ বিশ্বাস এর দুটো ডোমেইন আছে। এক দেখে বুঝে বিশ্বাস। দুই না দেখে বিশ্বাস। না দেখতে পারা তো এক অর্থে অন্ধরই প্রতিশব্দ। না দেখা বিষয় সমূহে বিশ্বাস ইসলাম ধর্মের জন্য অত্যন্ত জরুরি। আল্লাহ পবিত্র কোরআনে সূরা বাকারায় বলছেন – “এই সেই কিতাব যাতে কোনই সন্দেহ নেই, এটা পরহেযগারদের পথ প্রদর্শনকারী, যারা অদেখা বিষয়সমূহে বিশ্বাস স্থাপন করে।“
বিজ্ঞান অন্ধ না। বিজ্ঞানের দৃষ্টি আছে। সে অদেখা বা অপ্রমাণিত কোন বিষয়ে বিশ্বাস রাখে না। এজন্য বিজ্ঞানে Law, Theory and Hypothesis বলে তিনটা শব্দ আছে। যেটা ল, সেটা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে স্বতঃসিদ্ধ। যেটা থিওরি সেটা গ্রহণযোগ্য মাত্রায় সমাদৃত কিন্তু শতভাগ প্রমাণিত নয়। যেটা হাইপোথিসিস সেটা প্রমাণের অপেক্ষায়। কাজেই যা কিছুই আমরা বিজ্ঞান বলে জানি তার পুরোটাই ১০০ শতভাগ প্রমাণিত কোন বিষয় না। কিন্তু কিছু মানুষ আছেন যারা এসবের ধার ধারেন না। যদি কোথাও কেউ বলে ডক্টর ট্যান রিচার্ড ভির বলেছেন “ করোনা ভাইরাস আসলে ব্যাকটেরিয়া যেটা সাইজে ছোট অনেকেই আছেন শেয়ার দিয়ে ভরায় ফেলবেন।
বিজ্ঞানের আরও একটা সমস্যা হল এটা নিয়ত পরিবর্তনশীল। পরিবর্তনশীলতায় বিজ্ঞানের ধর্ম। প্রশ্ন করে সঠিক জিনিসটা বের করাই বিজ্ঞানের কাজ। একজন বিজ্ঞানমনষ্ক মানুষকে স্থির সিদ্ধান্তে থাকলে হবে না। একটা বিষয়ে পরিবর্তন আসতেই পারে – এটা না মানা পর্যন্ত আপনি বিজ্ঞানমষ্কই না। বিজ্ঞান গত ১০০ বছর আগে যা বলেছিল আজ তার অনেকটুকুই পরিবর্তিত হয়েছে। আজ যা বলছে আগামীকাল তাও পরিবর্তিত হতে পারে। করোনার কথাই ধরুন না। অনেক তথ্যই আমরা পরিবর্তিত হতে দেখেছি। সামনে আরও দেখবো।
বিজ্ঞান স্থির কোন বিষয় নয়। বিজ্ঞান গতিশীল। বহমান নদীর মত পুরোনো ধ্যান-ধারণাকে দুমড়ে মুচড়ে চলার নাম বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের পূজারি হতে হলে আপনাকেও তাই হতে হবে। বিজ্ঞান সুনিশ্চিত নয়। অসংখ্য সুনিশ্চিত থিওরি কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। আপনি বিজ্ঞানের পূজারি হলে আপনাকে অনিশ্চয়তায় বিশ্বাস রাখতে হবে। আপনি মুক্তমনের অধিকারী। তার মানে আপনি কোন একটা বিষয়ে আবদ্ধ নন। সকল পরিবর্তন আপনি খোলা মনে গ্রহণ করেন। আর যদি না করেন তাহলে আপনি বিজ্ঞানমনষ্ক নন।
সৃষ্টিকর্তা আছে না নেই এই বিতর্কের কোন শেষ নেই। বিজ্ঞান কখনো প্রমাণ করতে পারবে না সৃষ্টিকর্তা নেই। আবার বিজ্ঞান সৃষ্টিকর্তা আছে এটাও প্রমাণে ব্যর্থ। বিজ্ঞান তথ্য, প্রমাণ, যুক্তিতে বিশ্বাস করে। সৃষ্টিকর্তার থাকা না থাকার সাথে তার কোন বিরোধ নেই। আগামীকাল কেউ যদি সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সমীকরণ দিয়ে, অংক কষে, কোয়ান্টাম ফিজিক্স মিলিয়ে প্রমাণ করতে পারে তাহলে বিজ্ঞান তাতেই সহমত জানাবে। বিজ্ঞান আপনার জাজমেন্টাল এটিটুড এর জন্য অপেক্ষা করবে না।
ধর্ম কিংবা বিজ্ঞান দুটোরই লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ। কাঁদা ছোড়াছুঁড়ি তে কোন কল্যাণ আছে বলে মনে হয় না। তাহলে এই দুই বিষয়ের সমর্থকদের মাঝে এত ঝগড়া বিবাদ কেন? কারণ না আমরা ধর্মকে ধারণ করি, না আমরা বিজ্ঞানের মর্ম বুঝি। আমাদের কাছে আমাদের জাজমেন্টই বড়।
বাঙ্গালী জাতির ধর্ম এবং বিজ্ঞান একটাই – আর তা হল তার জাজমেন্ট।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua