দ্য থার্টিন বা’ক’তুন
লেখার শুরুতেই বলে দিচ্ছি এটা কোন গল্প নয়। লেখাটা বর্তমান সময়ে খুব জনপ্রিয় হওয়া একটা তারিখ নিয়ে। তারিখটা হলো ২১ শে ডিসেম্বর। এই ২১শে ডিসেম্বর তারিখে (মানে আগামীকাল) পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে বলে অনেকের মনের মধ্যে একটা কেমন কেমন অনুভূতি কাজ করছে। কেউ কেউ ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন যে ভয় পাচ্ছেন। আবার কেউ কেউ বলছে আসলেই কি কিছু হবে নাকি এ ব্যাপারে তারা সন্দিহান। ঘুম থেকে মাত্র উঠলাম। উঠেই একজনের স্ট্যাটাস দেখলাম যে নাসা (NASA) বলেছে কালকের দিনটা মহাজাগতিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। ফোনের স্ক্রিনে খুব ভালোমত বুঝলাম না। তবে ঘুম ঘুম ভাবটা চলে গেল। বিছানায় উঠে বসতেই মনে হল, হায় হায় সত্যিই যদি এমন কিছু হয় তাহলে আমার কি হবে? মানুষ কত স্বার্থপর দেখেন- যদি সত্যিই পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যায় তাহলে আমার উচিত ছিল সবার কথা চিন্তা করা। তা না করে আমি নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। আসলে মনের মধ্যে কেমন যেন একটা শূণ্যতা। বিয়ে-সাদি না করেই মরে যাব ভাবতেই মনটা ভয়াবহ টাইপ খারাপ হল। দিল্লির লাড্ডুটা খাবার ইচ্ছা আর পূরণ হচ্ছে না ভেবে মনে বেজায় দুষ্ক। তবে চোখের কোণা কিন্তু শুষ্ক। তা দিল্লির লাড্ডু নাই বা খেলাম, এই ব্যাপারটা তো একটু খতিয়ে দেখা যেতেই পারে। বাসি মুখে নেটে বসলাম। অনেক ঘেঁটে যা পেলাম তার সারমর্ম নিচে তুলে ধরছি। ব্যাপারটা সেইরকম মজার। অন্তত আমার কাছে তাই লেগেছে। নতুন কিছু জানতেও পারলাম। বিশেষ করে মায়ানদের সম্পর্কে। সে যাই হোক। পাঠক, এতটুকু পড়ার পরে যদি ধৈর্য্য থাকে তাহলে নিচে নামেন।
প্রথমেই বলে নেই কোথা থেকে এই ২১ শে ডিসেম্বর তারিখের ধারণাটা এলো। এই ২১/১২/২০১২ তারিখের ধারণটা এসেছে মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডার থেকে। তাহলে চলুন মায়া সভ্যতার ক্যালেন্ডারে একটু চোখ বুলিয়ে আসি। মায়ানরা দুই ভাবে সময়ের হিসাব রাখতো। একটা হিসাব হল অল্প দিনের জন্য। অন্য ক্যালেন্ডার হল অনেক লম্বা সময়ের জন্য। ছোট সময়ের জন্য যে হিসাব সেটা হল ‘জোলকিন’। ‘জোলকিন’ হিসাবে তারা ২০ দিনে মাস আর ১৩ মাসে (১৩*২০=২৬০) বছর হিসাব করতো। প্রতিটি দিনের আলাদা আলাদা নাম ছিল। মায়াদের কাছে ১৩ আর ২০ সংখ্যা দুটো ছিল খুব গুরুত্বপূর্ণ। ২১ শে ডিসেম্বরের সাথে অবশ্য এই হিসাবের কোন সম্পর্ক নেই। এর সাথে সম্পর্ক হল লম্বা সময় হিসাব করার জন্য যে ক্যালেন্ডার আছে সেটার।
মেসো-আমেরিকান লং কাউন্ট ক্যালেন্ডার বলে একটা পদ্ধতি মায়া সভ্যতার সূচনার আগে থেকেই প্রচলিত আছে। এই ক্যালেন্ডারের উৎপত্তি ‘অমলেক’ নামক সভ্যতা থেকে। পরে মায়ানরা এটাকে ঘষে মেজে নিজেদের জন্য বানিয়ে নিয়েছে। মায়া ভাষায় ওরা দিনকে বলতো ‘কিন’। ২০ দিন মানে ’২০ কিন’-এ এক ‘উইনাল’। ১৮টা ‘উইনাল’-এ ১ ‘তুন’। এরকম ২০ ‘তুন’ এ হবে ১ ‘কা’তুন’। আর ২০ কাতুনে হবে ১ বা’কাতুন। এছাড়া বা’কাতুনের পরেও আরো ইউনিট আছে। যেমন ‘পিকতুন’, ‘কালাবতুন’ ইত্যাদি। আমরা সেদিকে না যাই।
যা বলছিলাম। মায়ানরা প্রতি ৫১২৫ বছর পরপর একটা করে ‘বা’কাতুন’ শেষ করছে। একটা উদাহরণ দেই। মায়া হিসাবে ০.০.০.১.৫ মানে হল ২৫ তম দিন। কারণ ওরা ১০ ভিত্তিক সংখ্যা গণনা পদ্ধতির জায়গায় ২০ ভিত্তিক সংখ্যা গণনা পদ্ধতি ব্যবহার করতো। কিন্তু মাসের বেলায় আবার ১৮ মাস ধরতো। সেই হিসাবে ০.০.১.০.০ হল ৩৬০ দিন। পরে বছরের শেষে এর সাথে অতিরিক্ত ৫ দিন যোগ করে ৩৬৫ দিন পুরো করে নিত। যদিও বছরের এই শেষ ৫ দিন তাদের কাছে ছিল ভয়ংকর দিন। এখন ২১শে ডিসেম্বর, ২০১২ তে এসে মায়ানরা শেষ করছে ১৩তম বা’কতুন। মানে আগামীকাল হল মায়ানদের হিসাবে ১৩.০.০.০.০। মায়ানদের জন্য এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। হবারই কথা। ৫১২৫ বছর পরপর যে দিনটি আসে সেটা গুরুত্বপূর্ণ হবারই কথা। কিন্তু সমস্যা হল এই ‘থার্টিন বা’কতুন’ নিয়ে ব্যাপক ভুল ধারনায় বর্তমান পৃথিবী সয়লাব হয়ে গেছে। মায়া সভ্যতার যে নিদর্শন পাওয়া গেছে, যতটুকু প্রাচীন নথি উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে এ পর্যন্ত সেখানে কোথাও বলা নাই যে এই ১৩.০.০.০.০ তারিখে সৃষ্টি জগত ধ্বংস হবে। এইটা আমার কথা না। এই কথা বলেছেন Foundation for the Advancement of Mesoamerican Studies, Inc. (FAMSI) এর এক্সিকিউটিভ ডাইরেক্টর সান্দ্রা নোবেল। তাঁর মতে এই চক্র পূরণ করা বা একটা বা’কতুন শেষ করা মায়ানদের কাছে ছিল প্রচন্ড আনন্দের একটা ঘটনা। তারা মনে করতো একটা বা’কতুন শেষ করা মানে মানব সভ্যতা একটা নতুন যুগে প্রবেশ করবে। এই নতুন যুগে অনেক পরিবর্তন আসবে। যা হবে মানুষকে নতুন পথে পরিচালনা করার জন্য। মজার কথা হল যে দুইটা প্রাচীন নথিতে এই দিনটির কথা উল্লেখ আছে সেই দুইটা নথির কোনটাই পুরোটা পাওয়া যায়নি। কিছু ছেড়া, বিছিন্ন অংশ পাওয়া গেছে। আর যা পাওয়া গেছে সেখানে কোথাও ধ্বংস শব্দটাই নাই।
সত্তর আর আশির দশকের দুটো কল্প-কাহিনীতে এই কথাটা প্রথম প্রচার করা হয় যে, মায়া ক্যালেন্ডারে এই দিনে পৃথিবী ধ্বংসের কথা বলা আছে। আর সেই ভুল কথাগুলোই এতদিন ধরে প্রচার পেয়ে আসছে এবং বর্তমানে ফেসবুকের বুকেও সযত্নে লালিত পালিত হচ্ছে। তবে আমরা আর কি মাতামাতি করছি। আমেরিকা আর ইউরোপে যা হচ্ছে তা মোটামুটি বিশাল একটা ব্যবসা। december212012.com নামে একটা ওয়েব সাইট টিপস দিচ্ছে কীভাবে এই দূর্যোগ মোকাবেলা করা যায়। তারা সেখানে গ্যাস মাস্ক থেকে শুরু করে ফার্স্ট এইড বক্স পর্যন্ত এডভারটাইজ করে যাচ্ছে। কি আজব দুনিয়া। তবে এই নিয়ে মায়াদের কিন্তু কোন দুঃশ্চিন্তা নেই। CNN এর মেক্সিকান প্রতিনিধি রিপোর্ট করেছে সেখানকার মায়াদের সাথে কথা বলে যে তারা এসব নিয়ে মোটেও চিন্তিত নয়। কারণ তাদের কথা হল, ‘আমাদের পূর্বপুরুষদের ক্যালেন্ডারের তথ্য ভুল ভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছে’। নাসা বলেছে, আগামী দিন হবে আর দশটা সাধারণ দিনের মতই।
বন্ধুরা, আমি এবং আপনি আগামীকাল একটা অদ্ভুত দিনের সাক্ষী হতে চলেছি ইনশা আল্লাহ্। ৫১২৫ বর্ষপূর্তি দেখতে পারার সৌভাগ্য কয়জনের হয় বলুন। আমরা তো বাংলা, ইংরেজী, আরবী সব নববর্ষই পালন করি। কাল না হয় আমরা মায়া বা’কতুন বর্ষপূর্তিই পালন করবো।
স্বাগতম, দ্য থার্টিন বা’কতুন।
[ অফ রেকর্ডঃ এই পর্যন্ত এসে আমি বুঝলাম যে আমার দিল্লির লাড্ডু খাবার সম্ভাবনা পৃথিবী ধ্বংস জনিত কারণে শেষ হয়ে যাচ্ছে না। তবে সেই সম্ভাবনা অন্য কারণে শেষ হবে কিনা তা এখনি বলতে পারছি না।]editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua