তবুও স্বপ্নেরা হেঁটে যায় অলস দুপুরে

Published On: October 16, 2012By Tags: , Views: 61

একটানা মোবাইল এলার্মের চরম বিরক্তিকর শব্দ শুনে মেজাজটা পুরোই খারাপ হয়ে গেলো আমার। প্রতি ১০ মিনিট পরপর এলার্ম। শুক্রবারের সকালে কোথায় একটু আরাম করে ঘুমাবো তা না। এখন জেগে বসে আছি। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম মাত্র সকাল ১০টা। বিরক্তি আরও বাড়ছে যখন আমি দেখছি যার মোবাইলে এলার্ম বাজছে সে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছে। শফিকের এই চরম তৃপ্তির ঘুম দেখে ইচ্ছা করছে এক বালতি পানি এনে ওর গায়ে ঢেলে দেই। ব্যাটা তুই নিজে ওঠার জন্য এলার্ম দিয়েছিস। কিন্তু নিজে না উঠে অন্যের ঘুমের বারোটা বাজানো কি ধরনের সভ্যতা??? কষে নিজের মনে ওকে গুনে গুনে ১৩টা গালি দিলাম। আমি কাউকে গালি দিলে ১৩টা গালি দেই। ১৩ হলো অশুভ সংখ্যা। কাউকে যখন গালিই দেবো তখন অশুভ সংখ্যার সাথে যোগসাজস করে দেয়াই ভালো। শফিক একটু একটু নড়ছে। এখন আবার আমার মাথায় একটা শয়তানি বুদ্ধি এসেছে। ইচ্ছা করছে টিস্যু পানি দিয়ে ভিজিয়ে ওর কানের ফুটোয় এক ফোঁটা এক ফোঁটা করে পানি ঢালতে। এই ইচ্ছা বাস্তবায়নের জন্য দরজা খুলে যেই বের হয়েছি অমনি দেখা মতলব ভাইয়ের সাথে। আসলে উনার নাম মোতালেব। আমি নাম দিয়েছি মতলব এবং এই মেসে একমাত্র আমিই সামনাসামনি তাকে মতলব ভাই বলে ডাকি। অন্যেরা ডাকে আড়ালে আবডালে। তবে শুনছি ইদানিং নাকি শফিকও সামনাসামনি মতলব ভাই বলে ডাকা শুরু করেছে। এটা নিয়ে গত পরশু শফিকের সাথে আমাদের মতলব ভাইয়ের একচোট নাকি হয়েও গেছে। উনাকে দেখে আমি না দেখার একটা ভাব ধরে খুব ব্যস্ত হয়ে বেসিনের দিকে এগোচ্ছি। উনাকে পাশ কাটিয়ে যাবার ঠিক ৩ সেকেন্ড পরে উনি ডাক দিলেন।

তানভীর, নাকি??? তা আমাকে মনে হয় চোখেও দেখলা না??? খুব ব্যস্ত মনে হচ্ছে।

আমি পিছনে ফিরলাম। চেহারা যথা সম্ভব গম্ভীর রাখার চেষ্টা করছি। এখন কোন ভাবেই নরম হওয়া যাবেনা। মতলব ভাইয়ের মত মানুষরা শক্তের ভক্ত নরমের যম। ভ্রু উপরে তুলে সরাসরি উনার চোখের দিকে তাকিয়ে ঠান্ডা গলায় বললাম,

মতলব ভাই, আপনিতো আর আণুবীক্ষণিক কোন প্রাণী না যে আপনাকে চোখে দেখবো না।

কি প্রাণী বললা??? তুমি আমারে কিসের সাথে তুলনা করলা??? মতলব ভাই প্রায় বার্স্ট হবেন হবেন ভাব। আমি মুখটা যথাসম্ভব গম্ভীর করে, চোখ বড়বড় করে বললাম, ব্যাকটেরিয়া চেনেন?? মানুষের শরীরের সব জায়গায় থাকে। সবথেকে বেশী থাকে গুয়ের মধ্যে।

মতলব ভাইয়ের কথা বন্ধ হয়ে গেছে। উনি মনে হয় ঠিক ভাবে তাকাতেও পারছেন না। কানের দুইপাশ লাল হয়ে যাচ্ছে। উনাকে দেখে এখন আমার বুল ফাইটের বুলের কথা মনে হচ্ছে। শুধু নাকের ফুটো থেকে ধোয়া ছাড়াটাই বাকি। প্রচন্ড রাগে একটা মানুষের নাক থেকে ধোয়া বের হচ্ছে, দৃশ্যটা কল্পনা করতেই আমার পেট ফেটে হাসি আসছে। উনাকে আরেকটু রাগিয়ে দৃশ্যটা দেখতে পারলে খুব ভালো লাগতো। কিন্তু এখন আর উনার সামনে থাকা একেবারেই উচিত হবেনা। মতলব ভাইয়ের মস্তিষ্ক এই অভাবনীয় ব্যাপারটার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলনা। কাজেই সে আমার কাছে যে জন্য এসেছিলো সেটা সে কিছুক্ষনের জন্য হলেও ভুলে গেছে। এই সুযোগে পালিয়ে যাওয়াটাই উচিত। তিন মাসের মেস ভাড়া বাকি থাকলে কে সাধ করে সকাল বেলা মেস ম্যানেজারের সামনে পড়তে চায়।

সমস্যা হলো আমি ঠিক পালিয়েও যেতে পারছি না। আপাতত বাথরুমে বসে আছি। কিন্তু আমি চোখ বন্ধ করেও দেখতে পাচ্ছি মতলব ভাই আমার রুমে আমার বিছানায় যেয়ে বসছেন। গত ৫ দিন চেষ্টার পর আজ উনি আমাকে সকাল বেলা ধরতে পেরেছেন। আজ আর আমার নিস্তার নাই। এখন আমার কি করা উচিত?? হঠাৎ শফিকের উত্তেজিত গলার স্বর শুনে ভাবনার সূতোটা কেটে গেল। কী নিয়ে কথা হচ্ছে সেটা ঠিক ধরতে পারছি না। এই অবস্থায় বাথরুমে বসে থাকার কোন মানেই হয় না। এখুনি রুমে যেতে হবে। তবে রুমে যেয়ে ঠিক কী অবস্থার মধ্যে পড়বো সেটাও বুঝতে পারছিনা। এত কিছু ভেবে কিছু হবেনা। আমি রুমের দিকে পা বাড়ালাম।

রুমে ঢোকার মুখে দেখি মতলব ভাই হাসি হাসি মুখ করে রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছেন। এবার আমিই পুরো তাজ্জব হয়ে গেলাম। কেবলা-কান্ত একটা চেহারা নিয়ে হা করে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। উনি যাবার সময় আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি মিয়া মানুষটা খারাপ হলেও ছেলে ভালো। যাইহোক ব্যাকটেরিয়া না কিসের কথা বলছিলা যেন। আচ্ছা সত্যি কইরা বলো তো, ঐ প্রাণী কি সত্যিই শরীরের সব জায়গায় থাকে??? কি তাজ্জব কথা। আমার সারা শরীরে আরেক প্রাণী ঘুরঘুর করতেছে। খাইতেছে, বেড়াইতেছে নিজেদের মধ্যে গল্প গুজব করতেছে, না জানি আরো কত কিছু করতেছে আর আমি টেরও পাইতেছি না। সৃষ্টিকর্তার কী আজব কারিশমা।

আমার তখন সৃষ্টিকর্তার আজব সৃষ্টি রহস্য নিয়ে চিন্তা করার মত বোধ শক্তি নাই। আমার সামনেই যে আচানক ঘটনা ঘটছে তার কোন ব্যাখাই আমি খুঁজে পাচ্ছিনা। বাথরুমে ছিলাম বড়জোর ১০ মিনিট। এই ১০ মিনিটে এমন কী হলো যে মতলব ভাই আমার সাথে এমন একটা রসিকতা করে চলে গেলেন। আমি বিছানায় বসে শফিকের দিকে তাকালাম। ও মুখ গোমড়া করে বসে আছে। আমি ঠিক মিলাতে পারছি না। শফিককে জিজ্ঞেস করলাম

কি হলো রে?? হঠাৎ তুই এভাবে খেপে গিয়েছিলি কেন?? আর মতলব ভাইয়ের এই অযাচিত খুশির কারণ কি???

শফিক খুব স্বাভাবিক ভাবে ঠান্ডা গলায় বললো, তোর তিন মাসের মেস খরচ আমি দিয়ে দিয়েছি।

আজ সকালে আমি ২য় বারের মত আকাশ থেকে পড়লাম। না আকাশ বললে ভুল হবে। আমি একেবারে মহাশূন্য থেকে পড়লাম। তিন মাসের মেস খরচ মানে ৬০০০টাকা। শফিক এত টাকা দিয়ে দিল কেন সেটা একটা প্রশ্ন। তারথেকে বড় প্রশ্ন হলো এই টাকাটা কিসের টাকা ছিল। আমি তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে ছোট্ট করে বললাম, কেন??? আমি জানি এই ছোট্ট প্রশ্নের উত্তরের মাঝেই বাকি সব উত্তর নিজে নিজেই চলে আসবে। অনেকটা কান টানলে মাথা আসে টাইপ অবস্থা। এই ঢাকা শহরে শফিকের দুইজন পরিচিত মানুষ আছে যাদের কাছে সে অকপটে সব কিছু খুলে বলে। একজন আমি। আর একজন আনিকা, শফিকের আন্নি। শফিক শুরু করলো।

তুই রুম থেকে বের হয়ে যাচ্ছিস বুঝতে পারছিলাম। এর কিছুক্ষন পরেই মতলব ভাই এসে বিছানায় বসলেন। বসেই হাবিজাবি কথা শুরু করলেন। তোর তিন মাসের ভাড়া বাকি। তুই পালিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছিস। উনি এইজন্য বেছে বেছে শুক্রবার সকালটা ঠিক করেছেন তোকে ধরার জন্য। সেই সাতসকাল থেকে উনি মেসের দরজায় কড়া নজর রাখছেন যেনো তুই পালিয়ে যেতে না পারিস। আমি চুপচাপ মটকা মেরে পড়েই ছিলাম। কিন্তু যখন ঐ ব্যাটা বললো তুই কেমন বাপের ছেলে তখন আর মেজাজ ঠিক রাখতে পারি নাই। শোয়া থেকে উঠে উনারে ঠান্ডা গলায় বললাম, ভাই মানুষের বিপদ আপদ থাকতেই পারে। তাই বলে বাপ-মা তুলে কথা বলেন কেন??? শালা বলে কি জানিস, আমার এত লাগে ক্যান?? উনি তো আর আমার বাপ তুলে কথা বলে নাই। মেজাজ আর ঠিক রাখতে পারলাম না। তিন মাসের ভাড়া ব্যাটার মুখের উপর ছুড়ে মারছি। প্রথমে ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেছিলো। পরে জিজ্ঞেস করলে বললাম তুই আমার কাছে এই টাকাটা পেতি।

আমি শূন্য চোখে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। ওর মুখে বিষাদের একটা গাঢ় ছায়া। ওর এই চেহারাটা আমার খুব পরিচিত। আমি জিজ্ঞেস করলাম টাকাটা কি তোকে আনিকা দিয়েছিল??

ও অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, হু। গতকাল দিয়ে বলেছিলো আজ আমার সাথে কিছু কেনাকাটা করবে।  সামনে মাসের ৬ তারিখের চাকরীর ইন্টারভিউয়ের জন্য একটা স্যুট বানানোর কথা ছিলো। তবে ব্যাপার না। আমি ওকে বুঝিয়ে বলবো। ওর মুখে একটা খুবই শুকনো হাসি। আর তুই তো চাকরী পেলেই টাকাটা দিয়ে দিবি। এবার আমার কেন যেনো মনে হচ্ছে তোর চাকরীটা হয়েই যাবে। পড়াশোনাও করছিস দেখলাম।

আমার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। আমি খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছি শফিক খুব চিন্তায় আছে ও আনিকা কে কী বলবে এটা নিয়ে। বেচারা পড়েছে মাইনক্যা চিপায়। আমার তবুও কেনো যেনো একটা শান্তি শান্তি ভাব হচ্ছে। এটা কি মতলব ভাইয়ের হাত থেকে বেঁচে যাবার জন্য, নাকি আমার প্রতি শফিকের ভালোবাসা দেখে তা ঠিক বুঝতে পারছি না। তবে এটুকু বুঝতে পারছি আমি মানুষটা খুবই স্বার্থপর। ও হ্যাঁ আর একটা ব্যাপার আমার কাছে একেবারেই পরিষ্কার। যাকে বলে সাদা ফকফকা পরিষ্কার। সেটা হলো, আজ শফিকের খবর আছে। আমি শফিকের হাত ধরে টান দিলাম।

চল, আজ নুরানি হোটেলে নাস্তা করবো। অনেকদিন কালো ভুনা দিয়ে রুটি খাইনা। নাস্তার পর স্পেশাল মালাই চা আর ১টা সিগারেট। বিল আমার।

এইবার শফিকের মুখে একটা ঝকঝকে ক্লোজ আপ মার্কা হাসি দেখা গেলো। বেচারা এই হোটেলের কালো ভুনা খুব পছন্দ করে। আমরা কালো ভূনা খেয়ে মন ভালো করার জন্য বের হলাম।

হোটেলে খাবার সময় থেকেই দেখছি যে শফিক বারবার মোবাইল দেখছে। হয়তো আনিকার ফোন আসবে। চায়ের কথা বলে একটা সিগারেট ধরালাম। একটা বাড়িয়ে দিলাম শফিকের দিকে। ও আমাকে অবাক করে দিয়ে বললো, নারে দোস্ত এখন আর টানবো না। একটু পরে আন্নির সাথে দেখা হবে। ও বুঝতে পারলে খবর আছে।

আমি নিজেই টানছি। চা চলে এসেছে। আয়েস করে একটা চুমুক দিলাম। মনে মনে ভাবছি আজকের দিনের পরিকল্পনা কি হতে পারে। মামার বাসায় যাওয়া যেতে পারে। মামীকে ম্যানেজ করে যদি কিছু টাকা পাওয়া যায়। সাথে সাথেই মনে হলো গতবার আসার সময় মামা বলে দিয়েছিলো যে আগামী ২ বছরে যেনো আর তার বাসা মুখো না হই। ২ বছর কেন বললেন? বিশেষ কোন কারণ আছে কী না জিজ্ঞেস করতেই উনার চোখ মুখ একদম শক্ত হয়ে গিয়েছিলো। আমি আর কথা না বাড়িয়ে চলে এসেছিলাম। কিন্তু আজ এই রিস্কটা না নিলে আর হচ্ছে না।

দোস্ত, আন্নির ফোন এসেছে। আমি যাচ্ছি। রাতে দেখা হবে। এক নিঃশ্বাসে বলা শফিকের কথা গুলো আমাকে বাস্তবে ফেরত নিয়ে আসলো। নাহ ছেলেটা একেবারেই গেছে। প্রেম কি কঠিন জিনিসরে বাবা। পাকা সিগারেট খোরকেও নেশা থেকে দূরে রাখে। আরে বেকুব সকাল বেলা নাস্তার পরে নুরানি হোটেলের মালাই চা এর সাথে দিনের প্রথম সিগারেটের যে স্বাদ তা দুনিয়ার আর কিছুতেই নাই। আচ্ছা শফিকের এই সিগারেট থেকে দূরে থাকা কি ভালোবাসার জন্য নাকি প্রেমিকার হাতে ধোলাই খাওয়া থেকে বাঁচার জন্য??? হুম বড়ই চিন্তার বিষয়। আজকে রাতে শফিককে জিজ্ঞেস করে ব্যাপারটা জানতে হবে। আমি শফিকের আধ খাওয়া চা পিরিচে ঢেলে চুমুক দিয়ে দিনের ২য় সিগারেটটা ধরালাম। আমার গন্তব্য কোথায় আমি তা চিন্তা করে ফেলেছি।

আমি হাটতে হাটতে নীলক্ষেতে চলে আসলাম। উদ্দেশ্য ফুটপাত থেকে ২টা বই কিনতে হবে। কিন্তু যে বই খুজছি সেটা পাবো কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি খুজছি মেডিকেল ডাইরেক্টরি ধরনের কোন বই। যেটাতে সহজ বাংলায় কিছু ওষুধের নাম লেখা থাকবে। আগামী পরশু একটা ফার্মাসিউটিক্যালসে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ পোস্টে ইন্টারভিউ। কিছু পড়াশোনা করা খুব দরকার হয়ে পড়েছে। আমি অর্ধেক নীলক্ষেত খুঁজে বই না পেয়ে হতাশ হয়ে আবার হাটা ধরলাম। এবার আমি আসলেই জানি না আমার গন্তব্য কোথায়। আমি মিরপুর রোড ধরে হাঁটছি। দুপুরের কড়া রোদ মাথায় নিয়ে এলোমেলো পা ফেলছি। যতদূর চোখ যায় পৃথিবী আলোয় উদ্ভাসিত। কিন্তু আমার সামনে ঘোর অন্ধকার। আগামী কিছুদিনের মধ্যে যেকোন উপায়ে একটা চাকরী জোগাড় করতে না পারলে মেস ছেড়ে ফুটপাতে নামতে হতে পারে।

দিশেহারা একটা ভাব নিয়ে আমি ধানমন্ডি লেকের পাড়ে এসে বসলাম। ঘামে শরীর ভিজে গেছে। সাথে লেগেছে প্রচন্ড ক্ষুধা। একটা বাদাম ওয়ালাকে ডেকে ৫ টাকার বাদাম নিলাম। মামার বাসায় যাবার ইচ্ছাটা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। শফিকের টাকাটা আসলেই খুব তাড়াতাড়ি দেওয়া দরকার। বেচারা নাহলে আনিকার কাছে আচ্ছা ধোলাই খাবে।

গত ২টা বছর একসাথে মেসে থাকার সুবাদে পরিচয়। সহজ সরল একটা মানুষ। আমাদের মধ্যে কেবল একটা বিষয়ে মিল। শফিক আর আমি দুজনেই ঢাকা ভার্সিটির ছাত্র। এছাড়া পৃথিবীর আর সব ব্যাপারে আমাদের মধ্যে উত্তর মেরু-দক্ষিন মেরু দূরত্বের ব্যবধান। এই মানুষটা যে প্রেম করতে পারে তা বিশ্বাস করার কোন কারণ আমার ছিলনা। তবুও একদিন বিশ্বাস করতে হলো। নিজের চোখকে তো আর অবিশ্বাস করা যায় না।

সেদিন আমার ডেইলি রুটিন অনুযায়ী হাটতে হাটতে শিশুপার্কের সামনে দিয়ে আসছিলাম। উল্টা দিক থেকে আসা একটা যুগল মূর্তি দেখে কিছুক্ষন অবাক হলাম। শফিক একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে বলতে আসছে। দুজনের হাতে ২টা আইসক্রিম। শফিকের আইসক্রিম যে গলে গলে ওর হাতে পড়ছে তা ওর খেয়ালেই নেই। আমাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় আমি ইচ্ছা করেই ডাক দিলাম।

আরে শফিক না?? কোথায় যাচ্ছিস??

শফিক আমাকে দেখে বেশ অপ্রস্তুত হয়ে বললো, এই মানে আর কি। একটু হাটছি।

মেয়েটা যে কিছুটা বিরক্ত তা বুঝতে পারছি। মেয়েটাকে আরেকটু বিরক্ত করতে আর শফিককে আরেকটু ভড়কে দেবার জন্য একটা কাজ করলাম। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা এক মুড়িওয়ালার কাছ থেকে কাগজের টিস্যু নিয়ে শফিকের হাতে দিয়ে বললাম, হাতটা ভালো করে মুছে নে। আর আইসক্রিমটা না খেলে হাতে গলানোর মানে কি??

হতভম্ব শফিকের হাতে একগাদা কাগজের টিস্যু ধরিয়ে দিয়ে আমি হনহন করে হেঁটে চলে গেলাম। পেছনে ফিরে না তাকালেও দিব্যি বুঝতে পারলাম যে ওরা আমার দিকেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে রাতে শফিক নুরানি হোটেলের ২টা স্পেশাল কাচ্চি নিয়ে রুমে ঢুকলো। নিজেই প্লেট সাজিয়ে একটা প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে লাজুক হেসে বললো,

নে, এর বেশী কিছু দিয়ে আর সেলিব্রেট করতে পারবো না।

আমি ওর দিকে না তাকিয়েই বললাম, কতদিন ধরে এভাবে সর্বনাশ করছিস??

ও ভ্রু কুচকে বললো, সর্বনাশ?? কার???

আমি হেসে দিলাম। খাবারের প্লেট আর কাচ্চি টেনে নিয়ে বললাম, আইসক্রিম গুলোর।

এবার ওর কপাল সোজা হলো। মুখে আবার সেই লাজুক হাসি। এইতো মাত্র ১৭ দিন। এর মধ্যে মাত্র ৩ দিন বের হয়েছিলাম। আজতো তোর সাথে দেখা হয়ে গেলো।

কিন্তু তোর প্রেমিকা তো মনে হয় আমাকে পছন্দ করেনি। আন্দাজে ঢিল ছুড়লাম। কিন্তু ঢিলটা যে জায়গামত গিয়ে লাগবে তা বুঝিনি। শফিকের দিকে তাকিয়ে দেখি ওর মুখ সাদা হয়ে গেছে। ও আমতা আমতা করে বললো, না, তা কেন?? তা কেন??

ওর শেষ কেনো টার মধ্যে থাকা হতাশার সুরটা আমার কানে বড্ড বেসুরো হয়ে বাজলো। আমি আর কথা বাড়ালাম না। শুধু বললাম, এরা কাচ্চিটা দারুন বানায়। কি বলিস।

শফিক মিনমিন করে বললো, হুম।

আমি জানি না ওর প্রেমিকা আমাকে পছন্দ করেনা বলেই কি ও আমার প্রতি বেশী আন্তরিকতা দেখায় যাতে আমি কষ্ট না পাই, নাকি এটা ওর বন্ধুর প্রতি ভালোবাসা। তবে আজ ও আমাকে অনেক বড় একটা অপমানের হাত থেকে বাচিয়েছে এতে কোন সন্দেহ নেই। আযানের শব্দের সাথে সাথে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোনের শব্দে চমকে উঠলাম। ফোন ধরতেই ওপাশ থেকে শফিক হড়বড় করে বলে উঠলো, তানভীর, তুই কোথায়?? মেসে আসতে তোর কতক্ষন লাগবে?? পারলে তাড়াতাড়ি আসিস।

তোর কি হয়েছে রে??? তোর মোবাইল কোথায়??? এটা কার নাম্বার???

তুই আগে মেসে আয় তারপড় বলবো। রাখি।

শফিক লাইনটা কেটে দিলো। আমার নিজের উপর রাগ লাগছে। ওর কী সমস্যা হয়েছে সেটা জিজ্ঞেস না করে কি সব কথা জানতে চাইলাম। একটা অস্থির মন নিয়ে আমি মেসের পথ ধরলাম। সারাটা সময় একটা চিন্তায় মন আচ্ছন্ন হয়ে থাকলো। আনিকার সাথে কিছু হয়নি তো ওর???

আমি যখন মেসে ঢুকলাম তখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা। হঠাৎ বাতাস বন্ধ হয়ে কেমন গুমোট একটা পরিবেশ। কে জানে আমার রুমের পরিবেশ এখন কেমন। সারাটা পথ শফিককে নিয়ে চিন্তা করেছি। কিন্তু স্থির কোন কিছু ঠিক করতে পারিনি। রুমের লাইট জ্বলছে। তারমানে শফিক রুমেই আছে। এখন মনে মনে প্রস্তুত হয়েই আছি শফিকের গল্প শোনার জন্য। রুমে ঢুকে দেখি শফিক খালি গায়ে লুঙ্গি পরে বিছানায় উপুর হয়ে শুয়ে আছে। চোখ বন্ধ। ও ঘুম কিনা ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। যখন কোন ধরনের শব্দ করা এখন ঠিক হবে কিনা ভাবছি, তখনই শফিক ভারী গলায় বলে উঠলো, তুই গোসল না করে রুমে ঢুকবি না। তোর গা থেকে পাঠার গন্ধ আসছে।

মনে মনে খুশি হলাম যে শফিক স্বাভাবিক ভাবে কথা বলছে। কিন্তু গলায় একটা আহত ভাব ফুটিয়ে বললাম, আমি তো পাঁঠাই রে আমার গা থেকে কি আর মৃগনাভীর গন্ধ পাবি?

শফিক কিছু বললো না। শুধু পা দোলাতে লাগলো। আমি কাপড় নিয়ে গোসল করার জন্য বাথরুমে যাবার ঠিক আগ মূহুর্তে কারেন্ট চলে গেলো। এত বড় হয়ে যাবার পরও অন্ধকারে আমার বাথরুমে যেতে ভয় লাগে। অনেক ভেবে এর একটা কারণ আমার মাথায় এসেছে। সেটা হলো আমাকে ছোট বেলায় দুষ্টামির শাস্তি হিসাবে বাথরুমে আটকে রাখা হত লাইট নিভিয়ে। সেই থেকে ভয়টা আমার মনের মধ্যে ঢুকে গেছে পুরোপুরি। কোন রকমে গোসল শেষ করে রুমে এলাম। গোসলের কারণে গরম এখন অনেক কম লাগছে। রুমে এসে শফিককে জিজ্ঞেস করলাম,

কি রে তুই অন্য নাম্বার থেকে ফোন দিয়ে এত তাড়াতাড়ি মেসে আসতে বললি কেন?? কোন সমস্যা???

তানভীর, তোর কাছে সিগারেট আছে???

হঠাৎ এভাবে শফিক সিগারেট চাওয়ায় আমি বেশ অবাক হলাম। যে মানুষ সকাল বেলা সিগারেট ছুঁয়েও দেখলো না, সে এখন নিজে থেকে সেধে সিগারেট চাচ্ছে। আমার বুকের মধ্যে একটা ধাক্কার মত লাগলো। এজন্য না যে ও সিগারেট চেয়েছে। বরং গলার স্বরটা আমাকে চিন্তায় ফেলে দিলো। কেমন যেন বহুদূর থেকে ভেসে আসা একটা হতাশ সুর। আমি শান্ত ভাবে বললাম, তুই তো সিগারেট ছেড়ে দেবার পথে আছিস তাই না???

আমি ছাড়ছি একটা কিছু। হয়তো ছেড়েই দিয়েছি। তবে সেটা সিগারেট না।

আমি ওর কথা বোঝার চেষ্টা করছি। কিন্তু ওর কথার ধরণ আমার ভালো লাগছে না। আমি এক ধরনের অস্থিরতা বোধ করা শুরু করলাম। হঠাৎ আমার খুব পানি পিপাসা পেল। আমি শফিককে বললাম, অন্ধকারে বসে থেকে কি করবি?? চল একটু হেঁটে আসি।

শফিক আবারো খুব ঠান্ডা স্বরে বললো, সিগারেট থাকলে একটা সিগারেট দে, তানভীর।

আমি অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে টেবিলের কাছে গিয়ে লাইটারটা খুঁজে পেলাম। লাইটার ধরিয়ে সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে শফিকের দিকে বাড়িয়ে দিলাম। নিজে একটা ধরিয়ে ওকে বললাম, আচ্ছা ঠিক করে বলতো কি হয়েছে তোর?? আনিকার সাথে ঝগড়া???

আনিকাকে আমি একটা চড় মেরেছি, তানভীর।

শফিকের নির্লিপ্ত উত্তর শুনে আমি স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। কথাটা হজম করতে আমার বড়ই কষ্ট হচ্ছে। আমি কি ঠিক শুনছি?? শফিকের মত শান্ত, সহজ-সরল একটা মানুষ এটা কিভাবে করতে পারে?? আমি সিগারেট ঠোঁটে দিতেও যেনো ভুলে গেছি। প্রচন্ড আতঙ্কে আমি অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে কিছু দেখার চেষ্টা করলাম। আমার চোখের সামনে শুধু বিষাদের একটা কালো ছায়া।

কতক্ষন কেটে গেলো জানি না। আঙুলে গরম ছ্যাকা লাগতেই তাকিয়ে দেখি সিগারেট পুড়ে তার শেষ বিন্দুতে এসে ঠেকেছে। খুব আস্তে করে জিজ্ঞেস করলাম, কিভাবে তুই এই কাজটা করতে পারলি??? আমার কথার কোন উত্তর এলো না দেখে আবার জিজ্ঞেস করলাম, শফিক, তুই এই কাজটা কেনো করলি?? এবারো সব নিশ্চুপ। আমি একটু ভালো করে ওর বিছানার দিকে তাকিয়ে দেখলাম শফিক বিছানায় নেই। আমার আবার সেই অস্থিরতা শুরু হল। আমি বুঝতে পারছি খুব খারাপ একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু কিভাবে কী হবে সেটা এখনো বুঝতে পারছি না। আমি শফিক শফিক বলে দুবার চিৎকার দিলাম। কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। আমার মন খারাপ হওয়া শুরু হলো। আমার জন্য শফিককে খুব সমস্যার ভিতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না। আমি কারো জন্য কিছুই করতে পারছি না। বাবা-মা, ভাই, বোন সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আর আমি তাকিয়ে আছি অন্ধকার ভবিষ্যতের দিকে। আগামী পরশু আমার ইন্টারভিউ। এবার যেভাবেই হোক আমাকে একটা কিছু করতেই হবে। কিন্তু আমি নিজের মনকে শান্ত করতে পারছিনা। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি আকাশ পাতাল ভাবছি। আমার দুচোখের পাতা ভারী হয়ে আসছে। আমি কি ঘুমিয়ে যাচ্ছি??

এভাবে কতক্ষন কেটেছে নিজেও জানি না। চোখ মেলে দেখি সেই অন্ধকার। মোবাইলে দেখলাম রাত সাড়ে ১১টা। ঘরে বাতি জ্বলছে না। কিন্তু কারেন্ট আছে বুঝতে পারছি। তাহলে ঘরের বাতি কে নেভালো?? শফিক এসেছিলো কি??? আমি আবার ডাক দিলাম। শফিক, খেয়েছিস?? এ্যাই শফিক?? কোন উত্তর নেই। নাহ। ব্যাপারটা খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে। আমি বিছানা ছেড়ে উঠে বাইরে বের হলাম। দরজার সামনে পাশের রুমের রতন ভাইয়ের সাথে দেখা। আমি রতন ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম শফিকের কথা। রতন ভাই, শফিককে দেখেছেন???

হুম। একটু আগেই আবার বাইরে গেলো।

আবার বাইরে গেলো মানে?? ও কত বার বাইরে গেছে??

তা ঠিক বলতে পারবো না। তবে আমি তো গত ১ ঘন্টার মধ্যে দেখলাম প্রায় ১০ বার বাইরে গেলো আর আসলো। মাঝে মাঝে বিড়বিড় করে নিজের মনে কি যেনো বলছে। জিজ্ঞেস করলে কোন কথার উত্তর দিলো না। তুমি কিছু জানো নাকি?? কিছু হয়েছে??

না, মানে আমি তো কিছু জানি না। কোন রকমে আমি রতন ভাইয়ের কথা এড়িয়ে গেলাম। ঠিক এই সময় শফিক বাসায় এসে ঢুকলো। ওকে দেখে আমি বেশ ভয় পেয়ে গেলাম। কেমন শূন্য দৃষ্টি। উদভ্রান্তের মত আচরণ। মাথার চুল এলোমেলো। চোখ দুটো বেশ লাল। নিজের মনে কি যেন বলছে। আমাকে দেখে একটা কেমন যেন ঝিম ধরা হাসি দিলো। তারপর আমাকে আর রতন ভাইকে পাশ কাটিয়ে রুমে ঢুকে গেলো। আমি রতন ভাইকে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলাম। আমার আগে শফিকের সাথে কথা বলা দরকার এবং সেটা এখুনি। আমি ওর সাথে কথা শুরু করলাম।

শফিক, এ্যাই শফিক? কি হয়েছে তোর?? খেয়েছিস??

শফিক আমার কথা শুনতে পেয়েছে কিনা বুঝতে পারলাম না। তবে ও আমার দিকে না তাকিয়েই একটা উত্তর দিলো।

উহু। ফোন বন্ধ পাচ্ছি বারবার।

কার ফোন বন্ধ পাচ্ছিস??? আর তুই নাকি গত ১ঘন্টায় ১০ বারের মত বাইরে গিয়েছিস?? কোথায় যাচ্ছিস এত বার??

এবার ও আমার দিকে তাকালো। মনে হলো মনে মনে কি যেন একটা হিসাব করছে। তারপর বললো,

তাহলে তোকে ঘটনা খুলেই বলি। বুঝলি, আন্নির ফোন বন্ধ পাচ্ছি। ধর আমি সন্ধ্যা থেকে মোড়ের ফোনের দোকানে এ পর্যন্ত ৫০ বারের বেশী ফোন করতে গেছি। মজার কথা কি জানিস দোকানদার ব্যাটা এখন আমার ভয়ে দোকান বন্ধ করে দিয়ে বাড়ী চলে গেছে। বলতো কেন??? যদি বলতে পারিস তাহলে এখনি তোকে নুরানি হোটেলের কাচ্চি খাওয়াবো।

আমি ঠিক বুঝতে পারছি না শফিক স্বাভাবিক কিনা। তবে আমি দোকানদারের চলে যাবার কারণ বুঝতে পেরেছি। তারপরও শফিকের কাছে থেকে শোনার জন্য বললাম, যা তোর কাচ্চি আজ আর খাওয়ানো লাগলো না। আমি পারছি না।

শফিক মুখ ভোঁতা করে বললো, আমি তোকে অনেক বুদ্ধিমান বলে জানতাম। আজ আনিকাকেও তাই বলেছিলাম যে তুই প্রচন্ড বুদ্ধিমান একটা ছেলে। কিন্তু তুই আসলে বেকুব। না, তুই বেকুব না, তুই মহা বেকুব। আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের মত বেকুব দ্য গ্রেট।

আনিকার কথা শুনে আমার কেমন যেন জিদ চেপে গেলো। কেন গেলো আমি তা নিজেও জানি না। আমি স্থির চোখে শফিকের দিকে তাকালাম। তারপর বলা শুরু করলাম। দেখ শফিক, কেউ যদি একটু পরপর দোকানে যেয়ে একটা বন্ধ ফোনে ফোন করতে চাই তাহলে দোকানদার কি খুশি হবে। তুই নিশ্চয় এবার যেয়ে আর ফোন করতে পারিস নি। দোকানদার তোকে ফোন করতেই দেয়নি। তাই না??? দোকানদার তোর মুখের উপর দরজা বন্ধ করে সাটার টেনে দিয়েছে। কি?? কথা সত্য না???

শফিকের চোখ বড় বড় হয়ে গেছে। ও আমার দিকে একটা রাগত দৃষ্টি দিয়ে বললো, তাহলে প্রথমবার বললি না কেন??? শালা ভাব ধরিস না?? তোর ভাবের কেথা পুড়ি। আমি জানি তুই অসাধারণ একটা মানুষ। শুধু আফসোস যে আনিকা বুঝলো না। তবে আমি বাজি ধরে বলতে পারি আনিকা যদি একবার তোর সাথে কথা বলে তাহলে তোর সম্পর্কে ওর ধারণা পালটে যাবে।

আমি পুরো ঘটনা জানার জন্য বললাম, আজ আনিকার সাথে তোর কি হয়েছে খুলে বলতো।

শফিক বললো, হুম বলছি। আজ দুপুরে ওর সাথে আমার দেখা হলো নিউমার্কেটে। আমাদের কথা ছিলো যে আমরা আজকে স্যুটের কাপড় কিনে অর্ডার দেবো। নিউমার্কেটে ওর নাকি পরিচিত কোন দোকান আছে। এদিকে আমার কাছে তো কোন টাকা নেই। আমি ওকে সেটা বলতেও পারছি না। ভাবছি কিভাবে ম্যানেজ করা যায়। দেখা হবার সাথে সাথে ও আমাকে দোকানে নিয়ে যেতে চাইলো। আমি ফুচকা খাবার কথা বলে ওকে নিয়ে একটা দোকানে বসলাম। উদ্দেশ্য ছিলো ওকে বুঝিয়ে বলা। কিন্তু খাবার অর্ডার দিয়েই ও বলা শুরু করলো যে ও ঠিক করে রেখেছে কেমন কালারের কাপড় কিনবে, কি ডিজাইন ঠিক করবে ইত্যাদি। এদিকে আমিতো ভিতরে ভিতরে শেষ। ওর উৎসাহ আমাকে আরো বেশী ভয় পাইয়ে দিচ্ছে। তুই জানিস না। ও পুরো বাচ্চাদের মত। তখন যদি আমি সত্যি কথাটা বলে ফেলতাম তাহলে ও খাবারের দোকানের মধ্যেই কিছু একটা উল্টা পাল্টা করতো। আমি তখন নতুন বুদ্ধি করলাম। আমি ঠিক করলাম যে দোকানে যেয়ে কোন কিছুই পছন্দ করবো না। তাহলে তো আর আমার কাপড় কিনতে হবে না। একথা ভেবে আমি খুশি মনে দোকানে গেলাম।

আমি বেশ মজা পাচ্ছি এমন একটা ভাব নিয়ে বললাম, তারপর।

তারপর, দোকানে যেয়ে আমরা বেশ কিছু কাপড় দেখলাম। কয়েকটা ওর খুব পছন্দ হলো। কিন্তু আমি পছন্দ করলাম না। দেখলাম যে আমি পছন্দ করছি না দেখে ও বেশ বিরক্ত হচ্ছে। কারণ কাপড় গুলো পছন্দ করার মতই ছিলো। আমি বেশ অস্বস্তিতে পড়ে গেলাম। পরে সেলসম্যান একটা স্যাম্পল দেখিয়ে বললো, এটা ওদের দোকানে এখন নেই। আগামী সপ্তাহে আসবে। এই কথা শুনে আমি কোন কিছু না ভেবেই বলে ফেললাম যে এটা আমার পছন্দ হয়েছে। বলার পরে ভাবলাম যে যাক এখন তো আর টাকা দিতে হচ্ছেনা। এক সপ্তাহ সময় তো পাওয়া যাচ্ছে। আমি বেশ নিশ্চিন্তে আরাম করে চেয়ারে বসে থাকলাম। এরপর সেলসম্যান আর আন্নির মধ্যে এরকম কথা বার্তা হলো।

আন্নিঃ এটা আমারো পছন্দ হয়েছে। আচ্ছা সব কিছু মিলে এটার প্রাইস কত পড়বে??

সেলসম্যানঃ বানানোর খরচ সহ সাড়ে ৯ হাজার।

আন্নিঃ হুম। আমরা সাড়ে ৫ হাজার এডভান্স করে যাচ্ছি। আপনি ওর মাপ নিয়ে রাখেন। বাকি টাকা ডেলিভারির সময় দিয়ে কাপড় নিয়ে যাব।

কথাবার্তার এই পর্যায়ে আমার কেমন কেমন জানি করতে লাগলো। এসি দোকানে বসেও আমি খুব ঘামতে থাকলাম। আন্নি কে এখন কি বলবো সেটাই তো বুঝে পাচ্ছি না। ও যেভাবে সব কিছু ঠিক করে ফেলেছে তাতে আজ আমার প্রেস্টিজের ফালুদা না, ক্ষীর হয়ে যাবার সম্ভবনা দেখতে পাচ্ছি। আমি কোনমতে আন্নিকে বললাম, আন্নি, আমি একটু আসছি। বলেই পকেট থেকে মোবাইল বের করে কল্পনায় তোর সাথে কথা বলতে বলতে দোকান থেকে বের হয়ে গেলাম। আন্নির চোখের সামনে থেকে সরে এসে আমি আন্নিকে ফোন দিলাম। ওকে এখুনি দোকান থেকে বের করে আনতে হবে। ওকে শুধু বললাম, আন্নি তুমি দোকান থেকে বাইরে এসো। আন্নি বাইরে আসলো। এরপর যা হলো সেটা তোকে বলতে চাচ্ছি না। তবে শেষটা হলো এভাবে,

আন্নিঃ যখন এই ঘটনাটা ঘটলো তখনি তুমি আমাকে ফোন করে জানালে না কেন??? তোমার মোবাইলটা কি তোমাকে অভিনয় করার জন্য দেয়া হয়েছে??? শফিক চুপ করে থাকবা না। উত্তর দাও। তুমি যে এতটা ফালতু তাতো জানতাম না। এই ১ বছরে আমি তোমাকে ভালো রাখার জন্য সব কিছু করেছি আর তুমি আমার টাকা দাতা হাতেম তাই হয়ে তোমার ঐ বেয়াদব বন্ধুটার প্রয়োজনে উৎসর্গ করে দিলে??? নিজের টাকা দেবার ক্ষমতা নেই অন্যের টাকায় দাতাগিরি।

আমি মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছি। মাথায় রক্ত চড়ে যাচ্ছে। হাজার হলেও আমি পুরুষ। শালা জন্মগত ভাবেই তো আমার মধ্যে একটা জেদের বীজ লুকানো আছে। আমি নিজের অসহায়ত্ব মানতে পারছিলাম না। আর্থিক অস্বচ্ছলতা, আন্নির এইসব কথা, খোঁচাখুঁচি আমাকে পাগল করে তুলছিলো। আমার সেসময়ের ভেতরের অবস্থা তোকে বুঝানো যাবে না রে। আমি শুনে যাচ্ছি। আন্নি বলে যাচ্ছে,

শফিক, তুমি কালকেই ঐ মেস ছেড়ে দিবা। যদি ঐ মেস না ছাড়ো তাহলে আমাকে ছাড়তে হবে।

আমি আর সহ্য করতে পারলাম না।  মোবাইলটা রাস্তায় আছাড় দিয়ে ভাঙলাম। কয়েকটা টুকরো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরলো ওগুলো। আমার মনে হলো মোবাইলের টুকরো নয়, আমার মনটাই যেনো এভাবে টুকরো টুকরো হয়ে গেলো। আমি কিছু না ভেবেই ওর গালে একটা চড় মেরে বসলাম। ও ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলো। আমি যেভাবে ছিলাম সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকলাম। আমার চোখের দৃষ্টি একসময় ঝাপসা হতে হতে আমি সামনের কিছু আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। হঠাৎ কারো ধাক্কা খেয়ে আমি বাস্তবে ফিরলাম। চোখ মুছে যখন সামনে তাকালাম তখন আমি আর আন্নি কে খুঁজে পেলাম না। আমি পুরো নিউমার্কেট ৩ বার চক্কর দিলাম। কোথাও ওকে দেখলাম না। মোবাইলের দোকান থেকে ফোন দিলাম। ফোন অফ । সেই ফোন এখনো সে অন করেনি। সন্ধ্যা থেকে আমি যে কতবার চেষ্টা করলাম কিন্তু ফোন আর খোলা পেলাম না।

আমি কোন কথা বলতে পারছিনা। চোখ তুলে শফিকের দিকে তাকাতে পারছিনা। আমি জানি ও আনিকাকে কতটা ভালোবাসে। কিন্তু আজ ও যা করেছে তাও মেনে নিতে পারছিনা। না তাকিয়েও আমি বুঝতে পারছি শফিক কাঁদছে। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বাচ্চাদের মত করে কাঁদছে। আমি চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। রুমে একটা টিউব বাতি জ্বলছে। আমাদের জীবনে এটাই এখন একমাত্র আলোর উৎস। মন খারাপের দিনগুলো জ্যামিতিক হারে তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে যাচ্ছে। আমি এখন আর দিনের হিসাব রাখিনা। তবে একটা দিনের হিসাব আমাকে রাখতেই হচ্ছে। আগামী রবিবার আমার ইন্টারভিয়্যু। আগামী ২ মাসের মধ্যে আমার আর কোথাও ইন্টারভিয়্যুর জন্য কোন আমন্ত্রণ নেই। এটাই আমার শেষ সুযোগ। আমি ঠিক করেছিলাম চাকরীটা হলে আমি শফিককে ফোন করে একটা গান শোনাবো। সবাই ফোন করে তার ভালোবাসার মানুষকে গান শোনায়। আমার যেহেতু কেউ নেই তাই আমি ঠিক করেছি আমি শফিককেই গানটা শোনাবো।

চাকরীটা আমি পেয়ে গেছি শফিক শুনছিস

এখন আর কেউ আটকাতে পারবেনা

নুরানি হোটেলের কাচ্চি আমরা প্রতিদিনই খাবো

কষ্ট করে আর রান্না করতে হবেনা।

হঠাৎ দরজা খোলার শব্দ শুনে চমকে তাকালাম। তাকিয়ে দেখি শফিক হনহন করে হেঁটে চলে যাচ্ছে। এত রাতে কোথায় যাচ্ছে?? আমি কিছু না বুঝে কাপড় পড়ে বাইরে বের হলাম। যেটুকু সময় কাপড় পড়তে লাগলো অতটুকু সময়ের মধ্যেই শফিক হাওয়া হয়ে গেছে। আমি আমাদের গলির মোড় পর্যন্ত গেলাম। কিন্তু শফিককে পেলাম না। রাত সাড়ে বারোটার সময় আমি ওকে কোথায় খুঁজবো?? চিন্তিত মনে রুমে ফিরে আসলাম। আজ আর ঘুম হবে বলে মনে হয় না। পানি খেয়ে বিছানায় যেতেই মনে হলো আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি। মাথার মধ্যে তখনো একটা চিন্তায় ঘুরছে, শফিক কোথায় গেলো??? এত রাতে ও কোথায় গেলো??

আজ রবিবার। সকাল ১১টায় আমার সেই অতি আকাঙ্ক্ষিত চাকরীর ইন্টারভিয়্যু। এখন বাজছে ৯টা। আমাকে যেতে হবে পুরানা পল্টনে কোম্পানির অফিসে। ঢাকা শহরে সকাল বেলা অফিস টাইমের জ্যামের কথা মাথায় রাখলে আমার সাড়ে ৯টার মধ্যে বাসা থেকে বের হয়ে যাওয়া উচিত। সেই হিসাবে আমার হাতে রেডি হওয়ার জন্য সময় আছে মাত্র আধাঘন্টা। কিন্তু আমার সেই দিকে খেয়াল নেই। ঘুম থেকে উঠে আমি বিছানায় বসে প্রথম যে কথাটা মনে করেছি সেটা হলো আজ রবিবার। কথাটা মনে হবার সাথে সাথেই আমার মাথায় চাকরীর ইন্টারভিয়্যু কথাটা আসা উচিত ছিল। কিন্তু সেটা না এসে আমার মাথায় প্রথম এসেছে হুমায়ূনের ‘আজ রবিবার’ নামের নাটকটার কথা। নাটকের কথাটা মাথায় আসার কারণ হলো রাতে আমি একটা অদ্ভুত স্বপ্ন দেখেছি। আমি দেখছি যে আমার রুমে একটা বিশাল কফিন এসেছে। কফিনের সাথে সাথে নাটকের বড় চাচার বেশে এসেছেন আমার বড়মামা। উনি একজনকে কফিন চিকিৎসা দেবেন। কাকে দেওয়া হবে সেটা ঠিক করবেন আমাদের মেসের ম্যানেজার মতলব ভাই। উনি হায়েনার মত চোখ করে সবার দিকে তাকাচ্ছেন। আমি নিশ্চিত যে উনি আমাকেই কফিনের ভেতর ঢুকাবেন। এইতো উনি আমার দিকেই এগিয়ে আসছেন। উনার লোমশ হাত আমার হাত দুটো ধরার চেষ্টা করছে। আরে!! কি আশ্চর্য উনার প্রত্যেকটা হাতে ৭টা করে আঙ্গুল। সেখানে বিশাল বড় বড় নখ। আমি পিছনে সড়ে যাবার চেষ্টা করছি কিন্তু রতন ভাই আমাকে বাঁধা দিচ্ছে। মতলব ভাই আমাকে ধরে ফেলেছেন। এখন আমাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে কফিনের দিকে। বড়মামা হাসি হাসি মুখ করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু তার চোখে কেমন একটা বুনো উল্লাস। আমাকে নিয়ে কী করা হবে আমি জানি না। আমার ভীষণ ভয় করছে। আমি সাহায্যের জন্য সবার দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু কাউকে দেখছি না। এই সময় শফিকের থাকা খুব দরকার ছিল। কিন্তু সে কেন নেই??? আমি শফিক বলে চিৎকার করার আগ মূহুর্তে দেখলাম শফিক সবাইকে ঠেলে নিজেই কফিনের ভিতর ঢুকে গেলো। কফিনের দরজা বন্ধ হবার ঠিক আগে আমি ওর চোখের দিকে তাকালাম। ও স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সেই চোখে ভালোবাসার জল আর আমার জন্য তীব্র মায়া। কফিনের দরজা বন্ধ হয়ে গেল। ভিতর থেকে শফিক নাটকের আনিসের মত চিকন গলায় বলছে, তানভীর, আমার কিছু হয়ে গেলে আনিকাকে বলিস আমি ওকে ফোন করার জন্য মোড়ের দোকানদারের পা পর্যন্ত ধরতে গিয়েছিলাম। আমার গলা দিয়ে স্বর বের হচ্ছে না। আমি ফ্যাসফ্যাস করে শুধু বার দুয়েক শফিক, শফিক বলে ডাকলাম। এই ডাকাডাকির মাঝেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। তারপর থেকে বিছানায় উঠে বসে আমি খালি নাটকটার কথায় ভাবছি। শফিকের কথা মনে হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু আমি ভয়ে ওর কথা মনে করতে চাচ্ছিনা। গত দুদিন ওর কোন খবর নেই। ওর সাথে মোবাইলও নেই যে ফোন করে খবর নেব। ওর পরিচিত কয়েকজন কে ফোন করেছিলাম। কিন্তু কোন হদিস পাইনি। কেন যেন মনে হচ্ছে ও ভালো নেই। একদম ভালো নেই।

বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে পৌনে দশটায় বাসা থেকে বের হলাম। আমার ধারণা যেতে যেতে ঘন্টা খানেক লাগবে। কিন্তু আমার ধারণাকে ভুল প্রমাণ করে আমি সোয়া দশটার দিকেই অফিসে পৌছে গেলাম। সবার আগে না হলেও ইন্টারভিয়্যু দিতে আসা প্রথম ১০ জনের মধ্যে থাকবো বলে মনে করেছি। কিন্তু এবার আর আমার ধারণা ঠিক হলো না। আমি ওয়েটিং রুমে গিজগিজে মানুষ দেখে খুবই অবাক হলাম। বসার জায়গা পর্যন্ত নাই। এক কোনায় একজন মহিলা একটা রেজিস্ট্রার খাতা নিয়ে চাকরি প্রাথীদের নাম লিখে সিরিয়াল দিচ্ছে। আমি গিয়ে নাম বলার পর উনি আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিলেন। নিজের সিরিয়াল দেখলাম ৭৩। সিরিয়াল হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। উনি আমাকে বললেন, আপনি কি আর কিছু বলবেন??

জ্বী মানে জানতে চাচ্ছিলাম যে এই পোস্টে কতজন নেবে??

সেটাতো আমি বলতে পারছি না।

ও। আচ্ছা এরা বেতন কেমন দেবে সেটা তো বলতে পারবেন। এবার উনি খুবই কঠিন একটা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন।

জ্বী না। সেটাও আমি বলতে পারছি না। আপনার এত জানার ইচ্ছা থাকলে ভাইভার টেবিলে বসে জিজ্ঞেস করে নেবেন।

আমি সরাসরি উনার চোখের দিকে তাকালাম। খুব ইচ্ছা করছে উনাকে ভড়কে দিতে। ঠান্ডা গলায় মুখে একটা রহস্যময় হাসি এনে বললাম, জ্বী সেটা আমি জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব কে ফোন করেই জেনে নিতে পারবো। এই ওষুধে সাথে সাথে কাজ হলো। মহিলা লবন ছিটানো জোঁক না একেবারে লবনের বস্তায় ডোবানো জোঁকের মত চুপসে গেলেন। মিনমিন করে বললেন,

জ্বী মানে তানভীর সাহেব দেখুন আমি খুব সামান্য পোস্টে চাকরী করি। ভেতরের খবরতো আর আমার জানার কথা না। আচ্ছা আপনি কি এমডি স্যারের রেফারেন্সে এসেছেন???

এইবার আমিই অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম। কি বলবো বুঝতে পারছি না। জনাব রফিকুল ইসালাম সাহেব যে এই কোম্পানির এমডি তা আমি কিভাবে জানবো। আমি নামটা অফিসের মেইন গেট দিয়ে ঢোকার মুখে একটা গাছের গায়ে নাম ফলকে দেখেছি। কোন কিছু না ভেবেই নামটা বলেছি শুধু আন্দাজের উপর ঢিল ছুঁড়ে। আমার সেই ঢিল এক্কেবারে জায়গামত পড়েছে। ঢিল জায়গা মত পড়লে সবাই খুশি হয় কিন্তু আমার বেলায় হয়েছে উল্টা। ঢিল ছুঁড়ে আমার নিজেরই ব্যাথা পাবার মত অবস্থা। আমি কোন কিছু না বলে চুপ করে এদিক সেদিক তাকিয়ে প্রবল আত্নবিশ্বাসের সাথে একটা হাসি দিলাম। মহিলা কি বুঝলেন জানি না। উনিও একটা হাসি দিয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতে যাবেন এমন সময় পিছন থেকে কে জেনো বলে উঠলো, কি ব্যাপার??? একজনের সিরিয়াল দিতে এত সময় লাগে নাকি??? মহিলা আমাকে বসতে বলে বললেন, আমি একটু পরে আপনার সাথে কথা বলছি। আপনি বসুন। আমি কথা না বাড়িয়ে চিন্তিত মনে এক কোনায় দাঁড়িয়ে থাকলাম।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আকাশ-পাতাল ভাবছি। শফিকের কথা মনে পড়ছে। কোথায় আছে, কেমন আছে কিছুই জানা যাচ্ছেনা। বাবা-মার কথা মনে পড়ছে। এই চাকরীটা আমার জন্য কত বেশী গুরুত্বপূর্ণ সেটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ কাধে একজনের হাতের ছোঁয়ায় আমার ধ্যান ভাঙল। তাকিয়ে দেখি অপরিচিত একজন আমার দিকে তাকিয়ে একটা মুচকি হাসি দিল। তার চোখে-মুখে বেশ ব্যস্ত একটা ভাব, হাতে কি যেন একটা বই। সালামের উত্তরে মানুষ সালাম দেয়। কিছু জিজ্ঞাসা করলে তার উত্তরে কথা বলে। এপর্যন্ত আমি জানি। কিন্তু মুচকি হাসির উত্তরে কি ধরনের হাসি দিতে হবে সেটা এখন বুঝতে পারছি না। আমার মুচকি হাসি আসছে না। আমি কোন মতে একটা শুকনো হাসি দিলাম। সে কথা শুরু করলো,

ভাই মনে হয় ইন্টারভিয়্যু দিতে এসেছেন??

উত্তরে আমার হাসি হাসি আর চিন্তিত মুখের একটা কোলাজ চেহারায় একে বলা উচিত ছিল জ্বী ভাই আমি ইন্টারভিয়্যু দিতে এসেছি। আমার সিরিয়াল ৭৩। আপনার??

আমি এসবের ধার দিয়েও গেলাম না। আমি উনার দিকে তাকিয়ে একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে বললাম, ভাই, আমি তো শাকিরার কনসার্ট দেখতে এসেছিলাম কিন্তু জেরার্ড পিকের সাথে ভালো সম্পর্ক না থাকার জন্য টিকিট পাইনি। আমি আবার রিয়াল ফ্যান কিনা। তা আপনি কি টিকিট পেয়েছেন??

ভদ্রলোক বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। ঠিক বুঝতে পারছেন না আমি এটা কি বললাম। উনার ফর্সা গাল পাকা টমেটোর মত লাল হতে শুরু করেছে। ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে। আমি বুঝতে পারছি যে উনি রেগে যেতে শুরু করেছেন। এখনি উনাকে থামানো দরকার। বেচারা ইন্টারভিয়্যুর আগে এমন একটা মানসিক অবস্থায় থাকুক আমি সেটা চাইছি না। আমি এবার খুব গম্ভীর ভাবে জিজ্ঞেস করলাম, ব্রাদার এই কোম্পানির সব ওষুধের নাম কি জানা আছে?? এরা কিন্তু জিজ্ঞেস করতে পারে।

আমার কথায় কাজ হলো। তার ভ্রু সোজা হল। সে বেশ অসহায় ভাবে বললো, না রে ভাই তা আর পারলাম কই?? আমি এদের গ্যাস্ট্রিকের ওষুধের নাম ভুলে গেছি। আপনার জানা আছে কিনা সেটাই জানতে এসেছিলাম।

আমিও উনার মত একটা অসহায় ভাব নিয়ে বললাম আমিও ভুলে গেছি রে ভাই। তবে যাবার আগে আপনাকে একটা তথ্য দিয়ে যাই। গ্যাস্ট্রিকের জন্য একটা ব্যাকটেরিয়া দায়ী বলে বের করা হয়েছে। তার নাম কি আপনার জানা আছে?? তার নাম হলো এইচ ফুলস্টপ পাইলোরি। যিনি এই আবিষ্কার করেছিলেন তিনি এটা প্রমাণের জন্য এক গ্লাস পাইলোরি পানি দিয়ে গুলিয়ে খেয়েছিলেন।

উনার চোখ আবার বড় বড় হয়ে গেছে। ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে। আমি এখানে থাকা আর নিরাপদ বোধ করছি না। আমি সেখান থেকে চলে গেলাম।

অন্যপাশে যাবার ঠিক মাঝখানে সেই সিরিয়াল মহিলা আমাকে দেখতে পেয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে বললেন,

এই যে তানভীর সাহেব, কোথায় ছিলেন??? আমি আপনাকে খুঁজছি। রেফারেন্সে যারা এসেছেন তাদের ভাইভা অন্যরুমে হবে। তাদের জন্য কোন সিরিয়াল লাগবে না। আপনি আমার সাথে আসুন। কাউকে কিছু বলবেন না।

আমি গলা খাধে নামিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললাম, আপনার কি মাথা খারাপ হয়েছে?? এখন শুধু দেয়াল না চেয়ার-টেবিলেরও কান গজিয়েছে।

যথারীতি ভদ্রমহিলার ভ্রুও কুচকে যাচ্ছে। আচ্ছা এটা হচ্ছে কী?? আমি সবার ভ্রু কুঁচকে দিচ্ছি কেন??? আজ কি ভ্রু কুঁচকানো দিবস নাকি??

আমি উনার সাথে করিডোরের মাথায় একটা রুমে গিয়ে ঢুকলাম। ওখানে আরেকজন মহিলা বসে আছেন। তবে উনার হাতে সিরিয়াল দেবার কোন খাতা নেই। এখানে বসার জায়গা পাওয়া গেলো। আমি একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিয়ে আরাম করে বসলাম। সবাই আমার দিকে খুব বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকাচ্ছে। আমি ঠিক কারণটা বুঝতে পারছি না। একটু পরে আরেকজনকে নিয়ে সেই আগের মহিলা আবার ঢুকলেন। এবারো একই ভাবে সবাই তার দিকে বিরক্তিকর একটা দৃষ্টি দিলো। আমি মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। যাক সমস্যা আমার না। এটা হলো রেফারেন্স প্রার্থির সংখ্যা বেড়ে যাবার প্রতিক্রিয়া। কিন্তু আমার স্বস্তির ভাব বেশীক্ষন স্থায়ী হলো না। এই রুমের টেবিলে বসে থাকা মহিলা আমার হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে নাম, ঠিকানা, সিরিয়াল নাম্বার আর কার রেফারেন্সে এসেছেন সেটা লিখে ফেলুন। একটু পরে এমডি স্যার নিজেই আপনাদের ভাইভা নেবেন।

আমি এবার ঘামতে শুরু করলাম। আমিতো আসলে কারো রেফারেন্সে আসিনি। আমার শুধু জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব এই নাম ছাড়া আর কারো নাম মনে নেই। এখন আমি কি করবো। আমার খুব ইচ্ছা করছে এখান থেকে উঠে চলে যেতে। বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়ার কোন ইচ্ছা আমার মধ্যে এখন নেই। আমি কাগজ হাতে চুপ করে বসে আছি। হঠাৎ আমার চোখে কেন যেন শফিকের চেহারা ভাসতে লাগলো। আমি কাগজে সব কিছু লিখে রেফারেন্সের জায়গায় লিখলাম, জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব।

আনিকার গত দুইদিন খুব কষ্টে কেটেছে। শফিকের সাথে একবছরের সম্পর্কে সে এটুকু জেনেছে যে ছেলেটা খুব বোকা হলেও মানুষ হিসাবে খুব ভালো। শফিকের সাথে এমন আচরণ করা তার ঠিক হয়েছে কিনা সেটা নিয়ে সে যতবার ভেবছে ততবার তার চোখে ভেসে উঠেছে শফিকের তাকে চড় মারার দৃশ্য। সে কিছুতেই এটা মন থেকে মেনে নিতে পারছেনা। আবার তার নিজের সেদিনের সেই অদ্ভুত আচরণও তার পছন্দ হচ্ছেনা। এমন একটা দোটানার মধ্যে পড়ে সে কি করবে স্থির করতে পারছেনা। তার একবার মনে হচ্ছে শফিকের খবর নেয়া দরকার। আবার পরক্ষনেই মনে হচ্ছে এটা সে কিছুতেই করবেনা। সে জানে শফিক ফোনে তাকে অনেকবার ট্রাই করবে। কিন্তু সে আর ফোন অন করবে না বলে ঠিক করেছে। অনেক কষ্ট করে টাকা জমিয়ে সে শফিকের জন্য একটা স্যুটের কাপড় কিনবে বলে ভেবেছিলো। কিন্তু টাকাটা শফিক তার রুমমেটের জন্য খরচ করে ফেলবে এটা সে কিছুতেই মেনে নিতে পারেনি সেদিন। আজ তার একটু একটু খারাপ লাগছে। মনে হচ্ছে সেদিন এভাবে কথাগুলো না বললেও পারতো সে। মোবাইলে শফিকের সাথে যোগাযোগ করার কোন উপায় নেই। একমাত্র উপার শফিকের মেসে যাওয়া। আনিকা ঠিক করতে পারছেনা সে কি আজই শফিকের মেসে যাবে নাকি শফিককে আরো একটু শাস্তি দেবে। নিজের সাথে অনেক যুদ্ধ করে শেষ পর্যন্ত সে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। এই সিদ্ধান্তের সাথে সাথে সে অবশ্য আরেকটা বিষয়েও মনস্থির করেছে। শফিকের সাথে সে দেখা করতে মেসে যাবে শফিকের জন্য স্যুট বানিয়ে নিয়ে। আনিকা সব কিছু মনে মনে গুছিয়ে হোস্টেল থেকে বের হলো। তাকে আজ অনেক কাজ করতে হবে। প্রথমে যেতে হবে ইশানাদের বাসায়। পরে সিমির বাসায়। এই দুটো টিউশনি থেকে যেকোন একটা কিছু বলে এইমাসের টিউশনির টাকা এডভান্স নিতে হবে। এরপরে যেতে হবে নিউমার্কেট। সুট্যের কাপড় এসেছে কিনা দেখতে হবে। যদি আসে তাহলে টাকা এডভান্স করে আসবে। তবে এটা নিয়ে একটা সমস্যা আছে। সমস্যাটা হলো কাপড়ের মাপ। সেদিন শফিকের মাপ দিয়ে আসা হয়নি। এখন শফিকের ড্রেসের মাপ সে কোথায় পাবে?? মাপ ছাড়া কাপড় বানালে তারপর যদি উল্টা-পাল্টা হয়।

আনিকা এখন এসেছে নিউমার্কেটে। তার মন খুব ভালো। দুটো টিউশনি থেকেই সে একমাসের টাকা এডভান্স পেয়েছে। সে এখন বসে আছে কাপড়ের দোকানে। স্যুটের সেই কাপড় এখনো আসেনি। তবে আর এক দু দিনের মধ্যেই চলে আসবে। সে টাকা এডভান্স করেছে। অপেক্ষা করছে সেদিন দোকানে যে লোকটা ছিলো তার জন্য। তার কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তার শফিকের কথা মনে আছে কিনা। যদি থাকে তাহলে সে বানিয়ে দিতে পারবে কিনা। আনিকা বুঝতে পারছে ব্যাপারটা খুব ছেলেমানুষী হচ্ছে। কিন্তু তার এই ছেলেমানুষি করতে খুবই ভালো লাগছে। কেন ভালো লাগছে সে নিজেও জানে না। ঐ তো দোকানদার চলে এসেছে।

ভাই, কেমন আছেন?

জ্বী আপা ভালো। আজ কি অর্ডার দিতে এসেছেন??

জ্বী।

কিন্তু ভাইয়াকে দেখছি না যে?? উনার জন্যই তো বানানোর কথা ছিল মনে হয়।

জ্বী। তা ঠিক। তবে আমি ঠিক করেছি ওর মাপ ছাড়াই স্যুট বানাবো। এটা অনেকটা সারপ্রাইজ দেবার মত। আপনার কি ওর কথা মনে আছে? মানে আপনি কি পারবেন ওকে কল্পনা করে একটা স্যুট বানাতে?

আপা, এইটা কি বলেন?? মাপ নিয়েও অনেক সময় আমাদের উনিশ-বিশ হয়ে যায়। আর মাপ ছাড়া বানানোতো সম্ভবই না।

ভাই, কাপড়তো আমার তাইনা। মাপ উনিশ-বিশ না হয়ে যদি দশ-বিশও হয় আমার কোন সমস্যা নাই। আপনি শুধু একটা মিডিয়াম সাইজের মানুষের যে মাপ হয় তেমন এমটা মাপ দিয়ে স্যুট বানাবেন। সমস্যা হলে আমি আপনাকে কিছুই বলবো না।

আনিকা দেখছে দোকানের প্রতিটি মানুষ তার কথায় খুব অবাক হয়েছে। তাকে পাগল ভাবছে কিনা কে জানে। ভাবলে ভাবুক। আজ সে আসলেই পাগল হয়ে গেছে।

দোকানদার তাদের রিসিটে সবকিছু লিখে আনিকাকে একটা সই করতে বললো। আনিকা দেখলো সেখানে লেখা আছে, মাপছাড়া স্যুট একপিস। ফিট না হলে কতৃপক্ষ দায়ী নহে। আনিকা খুশি মনে সই করে টাকা দিয়ে রিসিট নিয়ে বের হয়ে আসলো। বাইরে এসে সে দেখলো ঝুম বৃষ্টি হচ্ছে। তার চোখে খুশির অশ্রু চিকচিক করছে। তার এখন খুব কাঁদতে ইচ্ছা করছে। ভালোবাসার মানুষের জন্য কিছু করতে পারার আনন্দে তার হৃদয় পূর্ণ। সে ঝুম বৃষ্টিতে রাস্তায় নেমে গেলো। তার মনে হচ্ছে আজকের এই বৃষ্টি শুধুই তার। শুধুই তার জন্য।

একে একে সবাই ইন্টারভিয়্যু দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছে। আমি ইন্টারভিয়্যু রুম থেকে বের হওয়া প্রতিটি মানুষের চোখের দিকে তাকাচ্ছি। কিন্তু সবাই কেমন যেন একটা অনুভূতিহীন মুখ নিয়ে রুম থেকে বের হচ্ছে। এখন আর মাত্র তিনজন মানুষ রুমে আছে। এতক্ষন আমি বসে বসে নিজের মনে অনেক রাজা-উজির মারলাম। কিন্তু তাতে কোন কাজ হবে বলে মনে হচ্ছে না। ভাবতে ভাবতেই আমার ডাক এলো। আমি আমার ফাইলটা হাতে নিয়ে রুমের দরজায় দাঁড়িয়ে আছি। রুমে ৫ জন মানুষ বসে আছেন। তার মধ্যে মাঝখানে একজন বেশ বয়স্ক লোক। উনিই সম্ভবত জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব। আমাকে ভিতরে এসে বসতে বলা হলো। আমি চেয়ারে বসে ঘামতে থাকলাম। আমার হঠাৎ তীব্র পানি পিপাসা পেলো। আমার ইন্টারভিয়্যু শুরু হলো। প্রশ্ন করলেন একদম ডান কোনার চেয়ারে বসা একজন মানুষ।

মিস্টার তানভীর, আপনার কি এই ধরনের জবে পূর্বে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে???

জ্বী না। বিজ্ঞপ্তিতে অভিজ্ঞতা চাওয়া হয়নি বলেই আমি আবেদন করেছি।

এবার অন্য একজন বললেন, আপনি জব এপ্লিকেশনে লিখেছেন আপনি মাস্টার্স করেছেন পলিটিক্যাল সায়েন্সে। এই জবের সাথে পলিটিক্যাল সায়েন্সের কোন ভূমিকা আছে বলে কি আপনি মনে করেন???

আমি উনার দিকে তাকিয়ে বললাম, এই জবের সাথে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় এমন কোন সাব্জেক্টের সম্পর্ক থাকলে সেটা হলো ফার্মেসি। আর যে একটা সাব্জেক্টের সাথে এর সম্পর্ক সবথেকে বেশী সেটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয় না। সেটা হলো মেডিকেল সায়েন্স। আমার ধারণা এই চাকরীর ক্ষেত্রে সারাদিন কাজ করার ধৈর্য্য, ব্যবহার এবং চিকিৎসক সমাজকে প্রভাবিত করে নিজেদের প্রোডাক্ট তাদের প্রেসক্রিপশনে লেখানোটাই হলো প্রধান যোগ্যতা। যার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রির ভূমিকা সামান্য।

এতক্ষন মাঝের বুড়ো ভদ্রলোক আমার দিকে একমনে তাকিয়ে ছিলেন। আমার বলা শেষ হলে উনার ঠোঁটে একটা হাসি ভেসে উঠেই মিলিয়ে গেলো। এবার আমার দিকে এমন একটা প্রশ্ন এলো যেটার জন্য আমি এত চিন্তিত ছিলাম। একেবারে বাম কোনায় বসা বেটে মত একজন মানুষ আমাকে হঠাৎ করে জিজ্ঞেস করলেন,

তানভীর সাহেব, আপনি লিখেছেন যে আপনি আমাদের এমডি জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেবের রেফারেন্সে এসেছেন। উনি কি আপনাকে চেনেন? আপনি কিসের মাধ্যমে রেফারেন্স নিয়েছেন?

আমি অপমানিত হবার জন্য মনে মনে নিজেকে প্রস্তুত করে ফেললাম। আমি প্রশ্নকর্তার দিকে তাকালাম। একবার মাঝের ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তারপর মাথা উঁচু করে স্পষ্ট গলায় বললাম,

আমি জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেবের রেফারেন্সে আসিনি। আমি উনাকে চিনিও না। আমি বাইরের চত্বরের একটা গাছের নাম ফলকে উনার নাম দেখেছি। সেখানে লেখা ছিল, হরিতকী চারা। রোপণ করিয়াছেন, জনাব রফিকুল ইসলাম, তাং ১৪/০৩/২০১০। কিন্তু চারাটা আসলে হরিতকীর চারা নয়। সেটা একটা বহেরা গাছের চারা। সিরিয়াল যিনি দিচ্ছিলেন উনাকে আমি শুধু জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব কথাটা বলেছিলাম। কেন বলেছিলাম সেটা বলতে চাচ্ছিনা। এরপরে ঘটনাচক্রে আমি এ পর্যন্ত এসেছি। আমি জানি আমার কাজটা করা ঠিক হয়নি। তবে নিরুপায় হয়ে মানুষ অনেক কিছু করে যা তার স্বভাব-বিরুদ্ধ।

রুমে পিন-পতন নিরবতা। একটা পিন পড়লেও শোনা যাবে এমন নিস্তব্ধতা থেকেই মনে হয় এই শব্দের উৎপত্তি। তবে রুমে পিন পড়লে সেই শব্দ পাওয়া যাবে না আমি নিশ্চিত। কারণ বেশ শব্দ করে একটা এসি চলছে। রুমের মানুষ গুলো একে অন্যের মুখের দিকে তাকাচ্ছে। যিনি প্রশ্ন করেছিলেন তিনি ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। মাঝের ভদ্রলোক এতক্ষন একটা কথাও বলেননি। এবার তিনি বললেন,

তানভীর সাহেব, আপনি নিশ্চিত যে গাছটা বহেরা গাছ??

জ্বী আমি নিশ্চিত।

আমি বুঝে গেছি এখানে আমার আর কোন আশা নেই। আশাহীন মানুষের ভয়-ডর কম থাকে বলে জানতাম। এখন আমি একটুও ভয় পাচ্ছিনা। সত্যি কথাটা বলে ফেলার পরে নিজেকে খুব হালকা লাগছে। এবার মাঝের ভদ্রলোক আমাকে বললেন, তানভীর আপনাকে অনেক ধন্যবাদ। আপনি আসতে পারেন।

আমি আপনাদেরকেও ধন্যবাদ বলে উঠে চলে আসছিলাম। দরজা থেকে কি মনে করে পিছনে ফিরে বুড়ো ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে বললাম, জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব, আমি আন্তরিক ভাবে দুঃখিত। আমি ক্ষমা প্রার্থি। গাছের বাংলা নামের সাথে যদি বৈজ্ঞানিক নাম যোগ করে দেন তবে অনেক ভালো হয়।

সাদা চুলে মাথা ঢেকে যাওয়া মানুষটা আমাকে বললেন, ইয়াং ম্যান আমি জনাব রফিকুল ইসলাম নই। আমি তার বাবা। জনাব রফিকুল ইসলাম সাহেব হলো উনি। আমি উনার আঙুলের নির্দেশিত দিকে তাকিয়ে দেখলাম একেবারে বাম কোনায় বসা বেটে মত লোকটার মুখে মিটিমিটি হাসি।

প্রবল ঘোর আর প্রচন্ড হতবাক একটা অবস্থায় আমি বের হয়ে আসলাম। আসার সময় মনে হলো সিরিয়াল দেওয়া মহিলা আমাকে কিছু বলছেন। কিন্তু আমার কানে কিছুই ঢুকছে না। বাইরে বের হয়ে দেখি আকাশ ভেঙে বৃষ্টি নেমেছে। আমি সেই প্রবল বৃষ্টির মাঝে পথে নামলাম। আমার এই চাকরীটা হবেনা আমি জেনে গেছি।

আমি বাসায় ফিরলাম শীতে কাঁপতে কাঁপতে। কাপড় পালটে বিছানায় গিয়ে আমি কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। আমার কেন যেন খুব শীত লাগছে। আমি বুঝতে পারছি আমার প্রচন্ড জ্বর এসেছে। এখন আমার দরকার একটা শান্তির ঘুম। আমি ঘুমে তলিয়ে যাচ্ছি। হঠাৎ আমার মনে হলো আমার আনিকা কে খুঁজে বের করতে হবে। আমার একটা কথা আনিকা কে জানানোর বাকি আছে। শফিক মোড়ের ফোনের দোকানদারের পা ধরার মত অবস্থায় চলে গিয়েছিল ওকে ফোন করার জন্য। কথাটা ওকে জানানো খুব জরুরী।

ঠিক কতক্ষন ঘুমিয়েছি বলতে পারবো না। ঘুমের মাঝে আমি রতন ভাইয়ের গলা শুনতে পাচ্ছিলাম। খুব ব্যস্ত হয়ে মানুষ যখন কাউকে ডাকে তখন তার কন্ঠে যে তীব্র আকুতি ঝড়ে পরে অনেকটা সেরকম। আমি ধড়মড় করে উঠে বসলাম। নিশ্চিত কোথাও একটা গন্ডগোল হয়েছে। লাইট জ্বালিয়ে দরজা খুলে আধবোজা চোখে আমি যা দেখলাম তাতে আমার মাথা প্রায় খারাপ হয়ে যাওয়ার অবস্থা। রতন ভাই আর লুঙ্গি পড়া একটা লোক শফিককে ধরে ধরে নিয়ে আসছে। শফিকের ডান হাতটা বেঢপ ভাবে ফুলে আছে। সারা শরীরে জখমের দাগ। নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। মনে হচ্ছে সে মাত্রই বক্সিং এর বিশ্বচ্যাম্পিয়নশীপ ম্যাচে বেদম মার খেয়ে ফিরে এসেছে। সে এক ভয়াবহ অবস্থা। শফিককে কোন মতে খাটে শুইয়ে দেয়া হলো। ওর এখন কথা বলার মত কোন অবস্থা নেই। কথা বলার মত অবস্থা আসলে আমাদের কারোরই নেই। এখন খুব দ্রুত একটা কিছুর ব্যবস্থা করতে হবে। মোবাইলে তাকিয়ে দেখি রাত ৩টা ১০। এত রাতে আমি সিএনজি বা গাড়ি ম্যানেজ করবো কিভাবে?? দিশেহারা ভাবে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি এমন সময় দরজায় মতলব ভাইকে দেখা গেল। হৈ-চৈ শুনে উনি দেখতে এসেছেন ব্যাপারটা কি হয়েছে। ঘটনা দেখে উনি চোখ বড় বড় করে শুধু বলতে থাকলেন, একি!! একি!! কিভাবে? কথা বলার ফাঁকেই দেখলাম উনি মোবাইল বের করে কাকে যেন ফোন করছেন। শফিক একটু আগে যাও একটু আধটু কথা বলার চেষ্টা করছিলো, এখন তাও করছে না। নির্জীব হয়ে পড়ে আছে। মতলব ভাই ফোন করার ১৫ মিনিটের মাথায় একটা সিএনজির শব্দ শুনতে পেলাম। উনি রুমে এসে শুধু বললেন,

রতন, তুমি আমার সাথে শফিককে নিয়ে সিএনজিতে ওঠো। তানভীর, তুমি রিকশাওয়ালার রিকশায় করে ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সিতে চলে আসো। কুইক।

রতন ভাই, মতলব ভাই আর রিকশাওয়ালা মিলে শফিকের প্রায় অচেতন দেহটা সিএনজিতে উঠালো। ঘটনার আকস্মিকতায় আমি কিছু জিজ্ঞেস করতেও ভুলে গেছি। রিকশায় উঠে আমি একটু ধাতস্থ হলাম। সিএনজি নিয়ে উনারা চলে গেছেন ঢাকা মেডিকেলে। আমি রিকশায় করে যাচ্ছি। একটা সিগারেট ধরিয়ে আমি রিকশাওয়ালার কাছে ঘটনা জানতে চাইলাম।

মামা, কি হইছে এইবার কও।

কি আর কমু মামা। দ্যাশের মানুষ আর মানুষ নাই। ৪ জন মিইল্যা উনারে কি মাইরটাই না মারলো। শালার দ্যাশ অহন ডাকাইত আর ছিনতাইয়ে ভইর‍্যা গ্যাছে।

তুমি ওরে পাইলা কই??

ঘটনা তো মামা আপনাগো বাসার সামনের মুড়ার এট্টু আগের রাস্তায় হইছে। আমি রিস্কা জমা দিমু কইয়া আইতেছি। আচানক দেখি ঐ মামারে ঘিইরা ৪ জইন। কি কতা বারতি হইছে জানি না। চউক্ষের পাতা ফেলানির আগেই দেহি আমগো মামা ওগো এগডার মুহের মইধ্যে দিছে এক ঠুয়া। ঐ ব্যাটা তো মাগো কইয়া মাটিত বইয়া পরছে। হের বাদে ৩ জন মিইল্যা আমাগো মামারে পিডাইছে। ওগো কাছে ছুরি আছিল। তই ছুরি মারে নাইক্যা। রাস্তার থন একটা লুহার পাইপ লইয়া চোখ বুইজ্যা মারছে। আমি ডরে আগায় নাই। পরে হের কাছে গিয়া দেহি এই অবস্থা। কুনু মতে রিস্কায় বহাইয়া হেরে জিগায় জিগায় আপনাগো ঘর পরযন্ত নিছি।

আমি এতক্ষন চুপচাপ কথা শুনছিলাম। এবার আমি ভালো করে রিকশাওয়ালার দিকে তাকালাম। ছিপছিপে শরীরের একটা মানুষ। আজ সে যদি শফিককে এভাবে না নিয়ে আসতো তাহলে কী হতো সেটা ভাবতেও আমার গায়ে কাটা দিচ্ছে। তার কথা গুলোর মধ্যে থেকে একটা কথা আমার কানে বেজেই যাচ্ছে। সে শফিকের কথা উল্লেখ করার সময় বারবার বলছিলো, আমাগো মামা, আমাগো মামা। এত অল্প সময়ের মধ্যে মানুষটা আমাদেরকে তার নিজের একজন মনে করে ফেলেছে। আমি অভিভূত হয়ে যাচ্ছি। আমার কেন যেন মনে হতে লাগলো যে আমাদের দেশের এই অশিক্ষিত মানুষগুলোই সত্যিকারের খাঁটি মনের মানুষ। আমরা শিক্ষিতরাই তাদেরকে খারাপ করি। নিজেদের শিক্ষার জোরে আমরা তাদেরকে ব্যবহার করি নিজেদের প্রয়োজনে।

মামা, আইয়া পড়ছি। আমি এইহানে খাড়াইলাম। আপনে ভিত্রে যান।

রিকশাওয়ালার কথায় তাকিয়ে দেখি আমি ঢাকা মেডিকেলের ইমার্জেন্সির সামনে।

রিকশাওয়ালাকে টাকা দেবার জন্য আমি পকেটে হাত দিলাম। পকেটে হাত দিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। আমি মানিব্যাগ আনতে ভুলে গেছি। মোবাইলের খোঁজে অন্য পকেটে হাত দিলাম। সেখানে কিছুই নেই। আমি মোবাইল আনতেও ভুলে গেছি। এখন কি করবো??? মতলব ভাই ও রতন ভাই ইমার্জেন্সিতে আছেন বলে মনে হয়। আমার উচিত হবে রিকশাওয়ালাকে বলে ইমার্জেন্সি থেকে টাকা এনে দেওয়া। কিন্তু আমি সেটা না করে রিকশাতেই বসে আছি। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। কাকে খুঁজছি আমি নিজেও জানি না। আমার বিহ্বলতা কাটছেনা। রিকশাওয়ালা মুখের ঘাম মুছে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সে চিন্তা করছে আমি এখনো রিকশায় বসে আছি কেন। আমারতো ছুটে হাসপাতালের ভিতরে যাওয়া উচিত। আমি তার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করলাম। সেই হাসির মধ্যে অসহায় ভাব কতটা ছিল আমি জানি না। রিকশাওয়ালা কি বুঝলো তাও জানি না। কিন্তু সে যা বললো তাতে আমার ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ার মত অবস্থা হলো। সে আমার দিকে তাকিয়ে একটু মাথা কাত করে বললো,

মামা, আপনে ভিত্রে যান। আমি এইহানে ইট্টু জিরাই লই। আপনে আইস্যা আমারে কইয়েন ঐ মামায় কেমুন আছে। হের খবর না লইয়া যাইতে পরানডা পুড়তাছে।

আমি এই রাতে তার আচরণে ২য় বারের মত অবাক হলাম। তবে এবার অবাক হবার সাথে সাথে একটা শ্রদ্ধার ভাব এসে আমার মনের অনেকখানি জায়গা দখল করে নিলো। আমি এলোমেলো পায়ে হাসপাতালে ঢুকলাম। আমি বুঝতে পারছি আমি টলছি, জ্বরে গা পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমার এখন নিজের দিকে তাকানোর সময় নেই। আমার দুচোখ এখন মতলব ভাই ও রতন ভাইকে খুঁজছে।  ইমার্জেন্সিতে ঢুকতেই এপ্রন পড়া ডাক্তারদের ছোটাছুটি নজরে পড়লো। একটা সময় এই এপ্রন পড়া মানুষগুলোকে দেখলে খুব হিংসা হতো। খুব ইচ্ছা হত আমার গায়েও একটা সাদা এপ্রন থাকবে। আমি ঘাড়ে একটা স্টেথো ঝুলিয়ে হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হেঁটে যাবো। রোগী, রোগীর এটেন্ডেন্ট সবাই আমার দিকে তাকিয়ে থাকবে। সবার চোখে একটা মুগ্ধতা দেখে আমি নিজেই মুগ্ধ হয়ে যাবো। কিন্তু ইদানিং আর তেমন একটা হিংসা হয়না। সাধারণ মানুষের চোখে ডাক্তারদের অবস্থান এতটাই নিম্নগামী যে, এই এপ্রন পরা মানুষগুলোকে দেখলে এখন খুব করুণা হয়। ইমার্জেন্সি রুমের ভিতর দাঁড়িয়ে আমার উচিত মতলব ভাই, রতন ভাই বা শফিককে খোঁজা। কিন্তু আমি তা না করে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ডাক্তারদের কাজকর্ম দেখছি। এটা কি হচ্ছে?? আমি কি জ্বরের ঘোরে চিন্তা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি নাকি? নিজেকে মনে মনে কয়েকটা অশ্রাব্য গালি দিলাম। খুব দ্রুত পুরো রুমে চোখ বুলালাম। কিন্তু ওদের কাউকে দেখলাম না। এবার আমার টেনশন শুরু হলো। আমি ব্যস্ত হয়ে টেবিলে বসা একজন ডাক্তারের কাছে যে যেয়ে জিজ্ঞেস করলাম,

এক্সকিউজ মি, আমি একজন রোগীকে খুঁজছি। একটু আগে উনাকে ইমার্জেন্সিতে আনা হয়েছে।

ছেলেটা তার হাতের ফাইল থেকে চোখ না তুলেই বললো, খুঁজে দেখেন এখানে আছে কিনা।

আমার মেজাজ খারাপ হতে শুরু করেছে। মনে মনে বললাম, আরে গাধা এখানে যদি থাকবে তো তোকে জিজ্ঞেস করতে যাবো কেন?? মনের কথা মনে রেখে মুখে বললাম, জ্বী উনি এখানে নেই। একটু যদি বলতে পারতেন যে উনাকে অন্য কোথাও নেয়া হয়েছে কিনা।

এবার সে চোখ তুলে আমাকে দেখলো। খুব ঠান্ডা গলায় বললো, ভাই, গত ১০ মিনিটে এই ইমার্জেন্সিতে ১৫ জন রোগী এসেছে। প্রতি মিনিটে  এক দশমিক পাঁচ জন। আমরা নাইট করছি কাগজে কলমে ১২ জন। কিন্তু বাস্তবে ডিউটিতে আছে মাত্র ৫জন। এবার বলেন আমাদের পক্ষে কোন রোগীর কথা মনে রাখা কি সম্ভব???

ছেলেটার এই প্রশ্নের উত্তর আমার পক্ষে দেওয়া সম্ভব হলো না। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। হতাশা আর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া একজোড়া চোখ। আমি শুধু জিজ্ঞেস করলাম, কাউকে যদি ভর্তি করানো হয় তাহলে সেই খবরটা কোথা থেকে জানা যাবে?

আপনি এই রুমের বাইরে যেয়ে হাতের ডানদিকে একটা ডেস্ক দেখতে পাবেন। ওখানে একজনের থাকার কথা যে রোগী ভর্তি করে লিখে রাখেন।

আমি ধন্যবাদ জানিয়ে বাইরে বের হয়ে আসলাম। কথামত হাতের ডানদিকে ডেস্ক পেলাম কিন্তু কোন মানুষ পেলাম না। এবার আমার নিজেকে খুবই অসহায় মনে হতে লাগলো। এখন আমি শফিককে কোথায় খুঁজে পাবো। এই পুরো হাসপাতালে কাউকে খুঁজে পাওয়া কোন ভাবেই সম্ভব না। দেশের সবথেকে বিখ্যাত হাসপাতালের এই করুন অবস্থা। একটু আগে ঘাম দিয়ে ছেড়ে যাওয়া জ্বর আবার ফিরে আসতে শুরু করেছে। শরীর ঠান্ডায় জমে যাচ্ছে। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁপছি। হঠাৎ করেই চোখ ভীষণ জ্বালা করছে। আমার সামনে সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে। আমি কি তবে জ্ঞান হারাচ্ছি??? আমি বুঝতে পারছি যে আমি পড়ে যাচ্ছি। ঠিক শেষ মুহুর্তে কেউ একজন এসে আমাকে ধরে ফেললো। আমি তাকে চোখে দেখছি না। কিন্তু আমি পরম নিশ্চিন্তে তার হাতের উপর আমার শরীরটা ছেড়ে দিলাম। আমার নিজেকে খুব হালকা লাগছে। চেতনা হারানোর একেবারে শেষ প্রান্তে এসে আমি শুনতে পেলাম কেউ বলছে, উনাকে মাটিতে শুইয়ে দেন। মাটিতে শুইয়ে দেন। আমি কিভাবে যেনো তার কন্ঠটা চিনতে পারলাম। এটা ইমার্জেন্সির সেই হতাশ চোখের ছেলেটা।

মোতালেব সাহেব খুব চিন্তিত মুখে ব্লাড ব্যাংকের সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। শফিকের জন্য ২ ব্যাগ এ পজিটিভ রক্ত লাগবে। রতনকে ওটির সামনে বসিয়ে রেখে উনি এখানে এসেছেন। ইমার্জেন্সি থেকে সরাসরি শফিককে ওটিতে পাঠানো হয়েছে। তার নাকি দেহের ভিতরে রক্তক্ষরণ হচ্ছে। ওটি থেকে মাত্রই বলা হয়েছে যে রোগীর অবস্থা বিশেষ সুবিধার না। খুব দ্রুত তার রক্ত লাগবে। মোতালেব সাহেব তার পরিচিত কয়েকজনকে ফোন করেছেন। কিন্তু বিশেষ লাভ হয়নি। শেষ ভরসা হিসাবে তিনি সন্ধানীর সামনে এসে দাড়িয়েছেন। তার মাথা কাজ করছে না। কিন্তু তানভীরের উপর তার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তিনি মনে মনে তানভীরকে এ পর্যন্ত শ’খানেক গালি দিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু তার মনে হচ্ছে গালির পরিমাণ কম হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত তানভীরের কোন খবর নেই। রিকশায় আসতে এত সময় কিছুতেই লাগার কথা না। সব থেকে বড় কথা তিনি অনেকবার তানভীরকে ফোন দিয়েছেন। মোবাইলে রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। তিনি সন্ধানীর বাইরের দরজায় নক করে দাঁড়িয়ে আছেন। ভিতরে আলো জ্বলছে। এটা একটা আশার কথা। একটা ছায়াও দেখা যাচ্ছে। কিছুক্ষন পর ঘুমঘুম চোখে একটা ছেলে দরজা খুলে দিলো। কন্ঠে বেশ বিরক্তি নিয়ে সে জিজ্ঞেস করলো,

কি চাই??

মোতালেব সাহেবের খুব ইচ্ছা করছে বলতে যে উনি এখন এই দুপুর রাতে সন্ধানীতে এসেছেন খোশগল্প করার জন্য। কি আজব কথা। এই ছেলের কি একফোটা বুদ্ধি নেই যে সে বুঝতে পারছেনা যে মোতালেব সাহেব রক্তের জন্য এসেছেন। এরা যে কী বুদ্ধি নিয়ে মেডিকেলে পড়তে আসে। তার রাগ হচ্ছে। কিন্তু এখন রাগ করলে হবেনা। তিনি বেশ ব্যস্ত হয়ে বললেন,

জ্বী, আমার পেশেন্টের জন্য এ পজিটিভ রক্ত দরকার। সে ওটিতে আছে। আমি সব জায়গায় দেখেছি কিন্তু পাইনি। শেষ ভরসা হিসাবে আপনাদের এখানে এসেছি।

ঠিক আছে। আপনার কয় ব্যাগ লাগবে??

জ্বী দুই ব্যাগ।

আপনি একটু দাড়ান আমি দেখে বলছি।

ছেলেটা দেখে এসে জানালো যে তাদের এখানে একব্যাগ পাওয়া যাবে। কিন্তু সেটাও আবার রক্তের বিনিময়ে রক্ত। অর্থাৎ মোতালেব সাহেবকে এখন নিজের রক্ত দিয়ে তবে একব্যাগ রক্ত নিয়ে যেতে হবে। মোতালেব সাহেব রতনকে ফোন করে সব জানিয়ে আসতে বলে রক্ত দেবার টেবিলে শুয়ে পড়লেন। তিনি শুয়ে শুয়ে দেখছেন ছেলেটা ব্লাড রিকুইজিশন স্লিপ দেখে রেজিস্ট্রারে সব কিছু লিখে রাখছে। রতন চলে এসেছে। ছেলেটা রতনের হাতে রক্তের ব্যাগ ধরিয়ে দিলো। রতন চলে গেলেই তার রক্ত দেবার পালা। মোতালেব সাহেব এর আগে একবার রক্ত দেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দিতে পারেননি। তিনি শুয়ে শুয়ে সেই কথা মনে করতে লাগলেন।

শমরিতা হাসপাতালের ঘটনা। মোতালেব সাহেবের রক্তের গ্রুপ বি পজিটিভ। তার এক নিকট আত্নীয়ার শ্বশুরের জন্য রক্ত দিতে এসেছেন তিনি। হাসি হাসি মুখ করে তিনি বেডে শুয়ে পড়লেন। তার পাশে তার আত্নীয়া এবং তার শ্বশুর বাড়ির লোকজন। তিনি এমন একটা ভাব করছেন যেনো এটা কোন ব্যাপারই না। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো তার হাতে ব্লাড প্রেসার কাফ বাঁধার পর থেকে। হঠাৎ তার খুব ভয় লাগতে শুরু করলো। তিনি ঘামতে শুরু করলেন। যিনি রক্ত নেবেন তিনি ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকলেন। শেষ পর্যন্ত মোতালেব সাহেব খুব জোরের সাথে বললেন তিনি প্রস্তুত। তখন সে ব্লাডব্যাগের সুই মোতালেব সাহেবের ডান হাতে পুশ করলো। হঠাৎ মোতালেব সাহেব চোখে অন্ধকার দেখা শুরু করলেন। তার খুব ঘন ঘন হাই উঠতে লাগলো। তিনি ঘেমে অস্থির হয়ে গেলেন। এবং ঠিক ৩ মিনিটের মাথায় তিনি জ্ঞান হারালেন। তার যখন জ্ঞান ফিরলো তখন তিনি দেখলেন তার সেই আত্নীয়া মুখ কালো করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। এরপর থেকে তিনি আর কোনদিন লজ্জায় সেই আত্নীয়ার বাসায় যাননি।

এখন আবার তিনি ঘামতে শুরু করেছেন। তার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আবার এদিকে তার বাথরুমের বেগ পেয়েছে। তিনি প্রচন্ড অস্বস্তি নিয়ে ছেলেটার জন্য অপেক্ষা করছেন। ছেলেটা উঠে তার দিকে এগিয়ে আসতেই সেই অস্বস্তি এক ভয়াবহ আতঙ্কে রূপ নিলো। তার খুব ইচ্ছা করছে বিছানা থেকে উঠে একদৌড়ে পালিয়ে যেতে। কিন্তু তিনি পারছেন না। কে যেন তার পা ২টা কে নিশ্চল করে দিয়েছে। ছেলেটা কাছে এসে জিজ্ঞেস করছে,

কি ব্যাপার?? আপনি ঘামছেন কেন?? মোতালেব সাহেব, আগে কখনো রক্ত দিয়েছেন???

মোতালেব সাহেব কোন কথা বলতে পারছেন না। ছেলেটা জিজ্ঞেস করেই যাচ্ছে, আপনি এমন করছেন কেন?? আগে কখনো রক্ত দিয়েছেন কি??? মোতালেব সাহেব, এই যে মোতালেব সাহেব।

মোতালেব সাহেব অনেক কষ্টে মুখ দিয়ে শব্দ বের করলেন। মুরগীর বাচ্চার মত চিঁচিঁ করে বললেন,

পানি! একটু পানি খাবো।

ছেলেটা খুব অবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে। মোতালেব সাহেব এখন চোখে ঝাপসা দেখছেন। তিনি বুঝতে পারছেন ছেলেটা পাশের রুমে চলে যাচ্ছে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে তাকে রক্ত দিতে হবেনা। তবে কি তিনি বেঁচে যাচ্ছেন?? তিনি এখন বেশ নিশ্চিন্ত বোধ করছেন। তার খুব ঘুম পাচ্ছে। হঠাৎ তার মনে হলো শফিক ওটিতে। ওর জন্য এখনো একব্যাগ রক্ত লাগবে। তিনি ব্যস্ত হয়ে উঠে বসতে যাচ্ছেন। কিন্তু পারছেন না। শরীর কেন যেন সায় দিচ্ছেনা। তিনি অনেক জোরে ডেকে উঠলেন, রতন ও রতন।

রতনের মাথায় কিছুই ঢুকছে না। সে একব্যাগ রক্ত নিয়ে ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কতক্ষন দাঁড়িয়ে আছে তার নিজেরও জানা নেই। তার মাথায় আসছে না যে তাকে ওটির দরজায় নক করতে হবে। সে রক্তের ব্যাগ হাতে ঠায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভাবছে তানভীরের কথা। ছেলেটা গেলো কোথায়? এমন তো তার করার কথা না। তাহলে কী শফিকের মতো ওরও কোন বিপদ হলো? হঠাৎ ওটির দরজা খুলে একজন সিস্টার বের হয়ে আসলেন।

কি ব্যাপার?? ব্লাড ব্যাগ হাতে এভাবে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? আপনার পেশেন্টের অবস্থা তো ভালো না। আরেক ব্যাগ রক্ত কই??

সিস্টারের ধমকে রতনের হুশ ফিরেছে। সে আমতা আমতা করে কেবল বলতে পারলো

জ্বী মানে আমাকে না মানে আমরা একব্যাগ জোগাড় করতে পেরেছি।

সিস্টার ভ্রু দুটো উপরে তুলে বেশ অবাক হয়ে বললো, এতক্ষন ধরে মাত্র একব্যাগ রক্ত জোগাড় করেছেন?? তাও আবার রক্ত নিয়ে না জানিয়ে ওটির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন। আপনাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে নাকি??

রতনের মাথা তখন খারাপ না হলেও একটু পর ঠিকই খারাপ হয়ে গেলো যখন সে দেখলো দুটা ছেলে মোতালেব সাহেব কে ধরে ধরে ওটির সামনে নিয়ে আসছে। সে বুঝতে পারছে না আজ হচ্ছেটা কী?? ছেলে দুটার একটা কে সে সন্ধানী তে দেখেছে। ওর হাত থেকেই সে কিছুক্ষন আগে রক্ত নিয়ে এসেছে।  তারা মোতালেব সাহেব কে ধরে ওটির সামনের বেঞ্চে শুইয়ে দিলো। মোতালেব সাহেবের চোখ বন্ধ। সন্ধানীর ছেলেটা রতনকে উদ্দেশ্য করে বললো,

মোতালেব সাহেব তো আপনার সাথেই এসেছেন তাই না?

রতন শুধু মাথা নেড়ে সম্মতি জানানোর মত একটা ভঙ্গী করলো। তার মুখ থেকে কথা বের হচ্ছে না। সে শুধু মনে মনে বলছে ইয়া আল্লাহ্‌ রক্ষা কর। এই বিপদ থেকে রক্ষা কর। সে খুব চেষ্টা করছে বিপদে পরলে যে দোয়াটা পড়তে হয় তা মনে করতে। কিন্তু সে অর্ধেক মনে করার পর বাকিটা মনে করতে পারছেনা। তার মনে হচ্ছে লক্ষন খুবই খারাপ।

ছেলেটা বলে যাচ্ছে, আমি আশিক, মেডিকেলের থার্ড ইয়ার। ও আমার বন্ধু ইমরান। আপনাদের দুই ব্যাগ এ পজিটিভ রক্তের দরকার ছিল। একব্যাগ সন্ধানী থেকে দেয়া হয়েছে। ইমরান আরেক ব্যাগ দেবে।

রতন এমন ভাবে তাকাচ্ছে যে সে কিছুই শুনতে পাচ্ছেনা। সে প্রায় ফিসফিস করার মত করে মোতালেব সাহেবের দিকে আঙ্গুল তুলে বললো, উনার কি হয়েছে???

তেমন কিছু না। এটাকে আমাদের মেডিকেলের ভাষায় বলে ভেসোভ্যাগাল এ্যাটাক। উনি একটু পরেই ঠিক হয়ে যাবেন। উনার সেন্স আছে। চিন্তার কিছু নেই।

রতন বুঝতে পারছে চিন্তার আসলেই কিছু নেই। মোতালেব সাহেব একটু পর ঠিক হয়ে যাবেন। রক্ত জোগাড় হয়ে গেছে। তার আপাতত দুঃশ্চিন্তা না করলেও চলবে। সে যেই একটু বুকে চেপে থাকা উৎকন্ঠার বাতাসটা নিঃশ্বাসের সাথে বের করে দিতে যাবে ঠিক তখনই ওটির দরজা খুলে একজন ডাক্তার বের হয়ে আসলেন। সে সরাসরি রতনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

শফিক নামে রোগীর সাথে কি আপনি এসেছেন?

রতন খুব ভীত গলায় বললো, হ্যাঁ। এরপরের কথা শুনে তার মনের ভয় প্রচন্ড ভয়াবহ এক আতঙ্কে রূপ নিলো। ডাক্তার খুব ধীর স্থির ভাবে বললেন, আপনার রোগী অপারেশন টেবিলেই কোমা তে চলে গেছে। আপনারা প্রায় ২ ঘন্টার মধ্যে দুই ব্যাগ রক্ত পর্যন্ত যোগাড় করতে পারলেন না?? আপনারা কি করলেন বলেন তো??? এখন তার জন্য খুব জরুরী হচ্ছে আইসিইউ আর রক্ত। আপনারা খবর নিয়ে দেখেন এখানে সিট খালি আছে কিনা। সিট খালি থাকার সম্ভাবনা একেবারেই নেই। তবুও একবার চেষ্টা করে দেখতে পারেন। অপারেশন শেষ। তার ডান হাতের দুটা হাড় ভেঙে প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়েছিল। সেজন্যই এ অবস্থা। আপনারা তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করেন। এবার দেরী করলে রোগী কিন্তু বাঁচবে না। আর এই ওষুধটা এখুনি লাগবে। নিয়ে আসেন।

ওষুধের নাম লেখা কাগজটা হাতে ধরিয়ে দিয়ে ডাক্তার ভিতরে চলে যেতেই রতন মোতালেব সাহেবের পায়ের কাছে বসে পড়লো। তার সারা শরীর কাঁপছে। সে এখন কিভাবে এত কিছু সামাল দেবে। সে খুব অসহায় চোখে আশিকের দিকে তাকালো। আশিক কি বুঝলো কে জানে। সে ইমরানকে বললো, তুই রক্ত দিয়ে সন্ধানীতে অপেক্ষা কর। আমি নিচে কথা বলে দেখি আইসিইউ খালি পাওয়া যায় কিনা। এরপর রতনের হাত ধরে বললো, ভাই, মাথা ঠান্ডা করেন। ওষুধটা এখুনি নিয়ে আসেন। আর আপনাকে অনেক কিছু সামাল দিতে হবে। আমাদের যতটুকু সাধ্য আমরা সাহায্য করবো। রতন উথলে ওঠা কান্না চেপে খুব আর্দ্র চোখে আশিকের দিকে তাকালো। তার চোখে কৃতজ্ঞতার অশ্রু চিকচিক করছে। সে চোখ মুছে ফার্মেসির উদ্দেশ্যে পা বাড়ালো। হঠাৎ তার বাকি অর্ধেক দোয়া মনে পড়ে গেলো। সে একমনে দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে নিচে নামলো।

আমি কতক্ষন ঘুমিয়েছি বা অজ্ঞান হয়েছিলাম আমি জানি না। চোখ মেলে তাকাতেই প্রথমে চোখে পড়লো একটা মহিলার মুখ। উনি কিছুটা আমার দিকে ঝুঁকে এলেন। মুখটাকে গম্ভীর রেখেই বললেন,

এত জ্বর নিয়ে হাসপাতালের বারান্দায় কি করছিলেন???

আমি একটু মুচকি হাসলাম। বুঝতে পারছি উনি সিস্টার। চোখ মেলে দেখলাম আমি একটা ওয়ার্ডে মেঝেতে পাটির উপর শুয়ে আছি। আমার মাথার পাশে একটা বিড়াল নিশ্চিন্তে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়ছে। আমি বিড়ালটাকে ভয় দেখানোর জন্য হাত নাড়লাম। সে একফোটা ভয় পেয়েছে বলে মনে হলো না। হয়তো সে বুঝে গেছে পাটিতে শুয়ে থাকা এই দুই পেয়ে জীবটা বড়ই অসহায়। অসহায় শব্দটা মাথায় আসতেই আমার শফিকের কথা মনে হয়ে গেলো। আমার শফিককের কাছে যাবার কথা ছিল। আমি মোতালেব ভাই, রতন ভাইকে খুঁজছিলাম। সব কিছু মনে হতেই আমি নিজের উপর বেশ বিরক্ত হলাম। এই সামান্য জ্বর আমি সহ্য করতে পারলাম না। আমি হাতে ভর দিয়ে উঠার চেষ্টা করলাম। যদিও খুব ক্লান্ত লাগছে তবুও আমাকে এখন উঠতেই হবে। আমি উঠে বসতেই সেই সিস্টার বলে উঠলেন,

আপনি কি এখন যেতে পারবেন?? আপনার সিটে এখুনি একটা রোগী আসবে।

আমি অবাক হয়ে তার কথা শুনছি। আমি তো মেঝেতে ছিলাম। এটা আবার কিভাবে সিট হয়? কথাটা উনাকে জিজ্ঞেস করতে যেয়েও করলাম না। শুধু জানতে চাইলাম,

সিস্টার একটু বলবেন ক’টা বাজে?

এখন ভোর ৫টা।

আমি হঠাৎ করেই আতংকিত বোধ করা শুরু করলাম। এতটা সময়ে কত কিছু হয়ে গেছে। আমি খুব দ্রুত উঠে বের হয়ে আসলাম। আমার এখন অনেক কাজ। আমার শফিকের খবর নিতে হবে। মোতালেব ভাইদেরকে খুঁজে বের করতে হবে। কিন্তু আমি সেইসব না করে হাসপাতালের বাইরে বের হয়ে আসলাম। আমার চোখ এখন সেই রিকশাওয়ালাকে খুঁজছে। সকালের এই হীম হীম ভোরে আমি তাকে খুঁজে পেলাম না। পুবের আকাশ ফর্সা হতে শুরু করেছে। আমি দাঁড়িয়ে আছি শহীদ মিনারের পাশের গেটে। তখনি আমি বুঝতে পারলাম আমি ভুল গেট দিয়ে বের হয়েছি। আজ সবকিছুই ভুল হয়ে যাচ্ছে কেন??? আজ কি তবে ভুল দিবস? আমাকে এখন সব ভুল শুদ্ধ করতে হবে। আমি ইমার্জেন্সি গেটের উদ্দেশ্য পা বাড়ালাম। মনে মনে বলছি, শফিক আমি আসছি। আমি আসছি।

আমি ইমার্জেন্সি গেটের সামনে এসে এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। আমার চোখ শুধু একটা পরিচিত ছিপছিপে শরীরকে খুঁজছে। যে রিকশায় বসে রেস্ট নেবার কথা বলেছিলো। আমি তাকে দেখছি না। নিজের ভিতরে অপরাধ বোধটা কাজ করার আগেই আমার চোখ একজন পরিচিত মানুষ খুঁজে পেলো। আমি ইমার্জেন্সির সামনের একটা ফার্মেসিতে একজনকে দাঁড়ানো দেখলাম। রতন ভাই!!! সে রতন ভাই না হয়ে যায়ই না। আমি প্রবল খুশীতে সবকিছু ভুলে তার কাছে যেয়ে ভোরের হালকা কুয়াশা মাখা বাতাস ফুসফুসে ভর্তি করে সবটুকু জোর গলায় এনে চিৎকার করে উঠলাম, রতন ভাই!! আপনাকে পেয়ে গেছি রতন ভাই!! উনি চমকে আমার দিকে তাকালেন। উনার চোখ ক্ষনিকের আনন্দে জ্বলজ্বল করে আবার সাথেসাথেই নিভে গেলো। উনি করুন চোখে আমার দিকে তাকিয়ে শুধু একটা কথায় বললেন, তুমি এতক্ষন কোথায় ছিলে??? কোথায়??? তুমি থাকলে এতবড় বিপদ আজ হতো না। উনার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। উনার কথা শুনে আমার গায়ে আবার কাটা দিয়ে উঠলো। তবে কি শফিক? নাহ, এসব আমি কী ভাবছি?? আরে ধুর!! আমি রতন ভাইকে ভয়ে কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছিনা। ওষুধ কেনা শেষে উনি হাসপাতালের পথ ধরলেন। আমি উনার পাশে হাটছি। রতন ভাই বলে যাচ্ছেন, তানভীর, শফিক কোমায় চলে গেছে। ওকে এখনি আইসিইউতে নিতে হবে। জানি না এখানে সিট পাওয়া যাবে কিনা। উনার কথা শুনে আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। হঠাৎ নিজের ভিতর থেকে কে যেনো বলে উঠলো, তানভীর, শফিককে বাঁচাতে হবে। নিজেকে শক্ত রাখো। আমি রতন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে গাঢ় স্বরে বললাম, আমাকে নিয়ে চলেন শফিকের কাছে।

ওটির সামনে পৌছে দেখলাম শফিককে মাত্র বের করে আনা হয়েছে। ওর পাশে ২টা অচেনা ছেলে। তাদের একজনের হাতে রক্তের ব্যাগ। মতলব ভাই চোখ বড় বড় করে শফিকের দিকে তাকিয়ে আছে। অক্সিজেন মাস্ক পড়ানো, বাম হাতে রক্তের নল লাগানো আর ডানহাতের কব্জি থেকে কাঁধের নিচের অংশ পর্যন্ত প্লাস্টারে মোড়া। শফিককে দেখে আমার আবারো শীত শীত লাগছে। কিন্তু এখন একদম ভয় পাওয়া যাবেনা। আমি খুব দ্রুত পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছি। সব কিছু শুনে যা বুঝলাম তা হলো শফিককে আইসিইউতে নিতে হবে কিন্তু ঢাকা মেডিকেলে সিট খালি নেই। এমনকি সরকারী কোন হাসপাতালে সিট পাওয়া যায়নি। আশিক আর ইমরান অনেক চেষ্টা করে হলি-ফ্যামিলিতে সিট পেয়েছে। তবে রোগীকে এখনই না নিয়ে গেলে সেটাও হাতছাড়া হতে পারে। বেসরকারি মেডিকেলে প্রতিদিনের খরচ হিসাব করে আমি ঘামতে শুরু করলাম। কিন্তু এছাড়া আর কিছুই করার নেই। এখন শফিককে নিয়ে যেতে হবে। আশিক একটা এ্যাম্বুলেন্সও ঠিক করে রেখেছে। রতন ভাইয়ের নাম্বার রেখে দিয়েছে যেনো ঢাকা মেডিকেলে কোন সিট খালি হলে শফিককে নিয়ে আসতে পারি। আমি এবার ভালো করে ছেলে দুটোর দিকে তাকালাম। হালকা-পাতলা গড়নের দেহ। চোখে এক অদ্ভুত দীপ্তি। কি ঠান্ডা মাথায় এরা সব কিছু সামাল দিচ্ছে। আমরা তাদের কেউ না। কোন পরিচয় ছিলো না আজ রাতের আগেও। তবুও এদেরকেই মনে হচ্ছে সবথেকে কাছের আত্নীয়। কেমন করে পারে এরা??? কিভাবে তাদের মনে সম্পূর্ণ অজানা কারও প্রতি এত গভীর মায়া জন্মায়??? এটা কি শুধুই মানুষ হিসাবে তাদের মানবিক আবেগের প্রকাশ?? নাকি ডাক্তার হতে যাওয়ার প্রবল আকাঙ্খা তাদেরকে এতটা মানবিক করে তোলে??? কিন্তু এই তরুণ চিকিৎসকরাই বা কেনো পরবর্তী জীবনে এতটা নেতিবাচক মানসিকতা প্রদর্শন করে??? এটা কি শুধুই তাদের দোষ?? এতে কি আমাদের সমাজ বা রাষ্ট্রব্যবস্থার বিন্দুমাত্র অবদান নেই??? এই মহান পেশার এত অনিন্দ্য সুন্দর মানসিকতা কেন হারিয়ে যায়??? আমি জানি না। আমি শুধু বুঝতে পারছি এই এপ্রন পড়া মানুষগুলোর প্রতি আমার আগের সেই হিংসা আবার ফিরে আসছে।

মতলব ভাইয়ের ডাকে বাস্তবে ফিরে এলাম।

তানভীর, তুমি আর রতন এ্যাম্বুলেন্সের সাথে যাও। আমি একটু বাসায় যাচ্ছি। শরীরটা ভালো লাগছেনা।

আমি মতলব ভাইয়ের দিকে তাকালাম। এই একরাতের ঝড় উনার বয়স অনেকখানি বাড়িয়ে দিয়েছে। গাল দুটোকে মনে হচ্ছে অনেকখানি ঝুলে নিচে নেমে এসেছে। এতটা হতাশ আমি উনাকে কখনো দেখিনি। আমি আর কোন কথা না বলে এ্যাম্বুলেন্সে উঠলাম। রতন ভাইকে টাকার কথা জিজ্ঞেস করবো কিনা ভাবছি। কত খরচা পাতি হবে তার কোন আন্দাজ করতে পারছিনা। নিজে কিছুই দিতে পারবো না এটুকু বুঝতে পারছি। আমি শফিকের দিকে তাকালাম। কি নিশ্চিন্তে সে ঘুমিয়ে আছে। সব কষ্টের পাথরগুলো আমাদের বুকে বেঁধে দিয়ে সে দুনিয়ার কোলাহল থেকে মুক্ত। আমরা তিনজন এখন সেই পাথরগুলো সরানোর আপ্রাণ চেষ্টা করছি। হঠাৎ শফিকের উপর আমার খুব রাগ হলো। ইচ্ছা করছে বাড়ি দিয়ে ওর বাম হাতটাও ভেঙে দিতে। ভাবতে ভাবতেই আমরা হাসপাতালে পৌছে গেলাম।

ইমার্জেন্সি ডাক্তার ঢাকা মেডিকেলের কাগজ পত্র দেখে সিট বরাদ্দ করে দিলেন। কিন্তু সমস্যা শুরু হলো আসল জায়গায়। ডিপোজিট হিসাবে ক্যাশ কাউন্টারে বসা লোকটা দশ হাজার টাকা দাবী করে বসলেন। অনেক বুঝানোর চেষ্টা করলাম। কিন্তু উনার এক কথা উপর মহলের আদেশ। টাকা জমা ছাড়া ভর্তি করা যাবেনা। আমার কাছে নেই ফুটা পয়সা। আরে পয়সা থাকবে কোথা থেকে? আমার কাছে তো মানিব্যাগই নেই। এ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া দেবার পর রতন ভাইয়ের কাছে এখন আছে সাকুল্যে তিনশত বিরানব্বই টাকা। আমি আর রতন ভাই খুব মন খারাপ করে কাউন্টারের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ আমার মাথায় গতদিনের চাকরীর ইন্টারভিয়্যুর কথা মনে পরে গেলো। আমি রতন ভাইকে উনার মোবাইল দিতে বললাম। উনি কিছুটা বিরক্ত হয়ে মোবাইল দিলেন। আমি মোবাইল নিয়ে সোজা ইমার্জেন্সির সামনে চলে আসলাম। আসার আগে উল্টা পাশের দরজায় থাকা নেমপ্লেট থেকে একটা নাম পড়ে ফেললাম। জনাব এনামুল হক। এবার আর সেই ভুল করিনি। নিচে লেখা উনার পদবীটাও আমি জেনে নিয়েছি। আবার যখন কাউন্টারে পৌছালাম তখন আমার চেহারার ভাবই পালটে গেছে। কাউন্টারের লোকটা যাতে শুনতে পায় সেভাবে মোবাইলে কথা বলা শুরু করলাম,

জ্বী, এনামুল চাচা, আমি তানভীর বলছি আপনার হাসপাতালের কাউন্টার থেকে। জ্বী চাচা মানে শফিককে তো নিয়ে এসেছি কিন্তু আসার সময় ভুলে মানিব্যাগ আনতে মনে নেই। এখন কাউন্টারের লোককে অনেক বলেও ভর্তি করতে পারলাম না। এত ছোট ব্যাপারে আপনাকে বিরক্ত করতে চাইনি। কিন্তু না পেরে ফোন করতেই হল। আমি কথাগুলো বলছি আর একদৃষ্টিতে লোকটার দিকে তাকিয়ে আছি। আমার চোখের পলক পরছে না। আমি বুঝতে পারছি আমার এই অভিনয়টুকুর বিশ্বাসযোগ্যতার উপর শফিকের জীবন-মরণ নির্ভর করছে। লোকটার ভ্রু হালকা কুঁচকে গেছে। তারমানে সে কিছুটা হলেও নাড়া খেয়েছে। এবার তাকে প্রবল ভাবে নাড়িয়ে দিতে হবে। যাকে বলে একেবারে ঘুটা দেওয়া। আমি এবার সেই ঘুটা দেবার কাজ শুরু করলাম। আমি ফোনটা কান থেকে নামিয়ে বুকে চেপে ধরে বেশ কঠিন গলায় উনাকে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই আপনার নামটা বলেন। আপনাদের ডাইরেক্টর এনামুল হক মানে আমার এনামুল চাচা আপনার নাম জানতে চাচ্ছেন।

আমার ঘুটায় কাজ হয়েছে। ভদ্রলোক আমার আচরণে বেশ বিভ্রান্ত হয়ে শুধু বললেন, ভাই এই কথা আগে বলবেন না? আগে তো এই কথা বলতে হয়। আমি বেশ গম্ভীর ভাবে বললাম আমি এটা বুঝিনি একটা মানুষের জীবনের চেয়ে আপনাদের কাছে ডিপোজিটের মূল্য বেশী হয়ে যাবে। ভদ্রলোক আর কোন কথা না বলে কাগজ-পত্র সব ঠিক করে দিলেন। গেটপাশ দেবার সময় একটার জায়গায় তিনটা দিয়ে বললেন, সবাইকে একটা দেয়া হয়। আপনাদের জন্য তিনটা। উত্তরে আমি একটা মুচকি হাসি দিলাম।

শফিককে নিয়ে লিফটে উঠার পর আমি রতন ভাইয়ের দিকে তাকালাম। উনি মুখ গোমড়া করে আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তানভীর, তোমার চাচা যে এত বড় হাসপাতালের ডাইরেক্টর আগে বলো নাই কেন??? আমি উনার দিকে তাকিয়ে লাজুক একটা হাসি দিয়ে বললাম, আমি নিজেও কি জানতাম নাকি আমার এই নামে কোন চাচা আছে??? এবার উনার চোখ দুটা হলো দেখার মত। গোল গোল চোখ দুটা পারলে কোটর থেকে ছিটকে বের হয়ে আসে। উনি প্রবল বিস্ময়ে প্রায় চিৎকার করে বলে উঠলেন, মানে এতক্ষন যা করলে সব মিথ্যা?? সব চাপাবাজি?? তুমি, তুমি । রতন ভাই তোতলাচ্ছেন। বাকি কথা শেষ হবার আগেই লিফটের ভিতরে থাকা যান্ত্রিক মহিলা ঘোষণা করলেন, সেকেন্ড ফ্লোর।

শফিককে আইসিইউতে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি নিশ্চিন্ত হলাম। এখন ওর কপালে যা আছে তাই হবে। রতন ভাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়েছি। যাবার আগে উনি আমার হাতে ১০০ টাকার একটা নোট ধরিয়ে দিয়ে কিছু খেয়ে নিতে বলেছেন। আমি এই মূহুর্তে সবথেকে বেশী বোধ করছি সিগারেটের অভাব। হাসপাতাল দেখতে দেখতে আমি নিচে নেমে গেলাম। রাস্তায় দাঁড়িয়ে পাউরুটি কলা খেয়ে একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরালাম। সিগারেটের ধোয়া টেনে আমি ভাবতে শুরু করলাম। টাকার চিন্তায় মাথা খারাপ হয়ে যাবার অবস্থা হচ্ছে। টাকা জোগাড় করতে না পারলে শেষে কি হবে সেটাও বুঝতে পারছিনা। আবার আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। আমি উদাস চোখে আকাশ দেখছি। আজ সোমবার। আজকের দিনটা যেনো কালকের মত শরীর খারাপ আর ভুল দিবস না হয় সেই দোয়া করতে হবে। হঠাৎ আমার আনিকার কথা মনে হলো। শফিকের আন্নি। আমার কেনো যেনো মনে হচ্ছে শফিকের এই নিরব অভিমান শুধু এই মেয়েটাই ভাঙতে পারে। আমি আনিকাকে ভাবতে শুরু করলাম। মনে মনে ওকে খুঁজতে শুরু করলাম। আনিকা, আপনি কোথায়?? এখন আপনাকেই আমাদের সব থেকে বেশী দরকার।

আনিকা সাজতে বসবে বলে ভাবছে। আজ তার মন বেশ ভালো। শফিকের স্যুটের ডেলিভারি আগামী রবিবারে। এই কটা দিন তার যে কিভাবে কাটবে সেটাই সে বুঝতে পারছেনা। তার মনে হচ্ছে কতদিন শফিকের সাথে কথা হয়না। সে নিজেও মোবাইল অন করবে না বলে ঠিক করেছে। তার রুমমেটের মোবাইল থেকে বাসায় কথা বলে আপাতত কাজ চালিয়ে নিচ্ছে। তবে খুব বেশী দিন আর পারবে বলে মনে হচ্ছেনা। সে অপেক্ষা করছে আগামী রবিবারের। সে ঠিক করেছে সেদিন যত গরমই থাকুক শফিককে স্যুট পরিয়ে সে রিকশায় করে ঘুরবে। আচ্ছা আজকে মেহেদি লাগাতে গিয়ে তার হাত কাঁপছে কেন?? কেনো যেনো অন্যদিনের মত সুন্দর নকশা হচ্ছেনা। আনিকার মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। তার খুব ইচ্ছা করছে শফিককে ফোন করে বলতে, তুমি আমার চোখে ঘুম হয়ে যাও এই মন খারাপের রাতে। তার এখন কিছুই ভালো লাগছেনা। তার শফিকের সাথে কথা বলতেই হবে। সে ঠিক করেছে কাল সে শফিকের মেসে যাবে। সে বুঝতে পারছে শফিককে ছাড়া তার পক্ষে এখন থাকা সম্ভব হবেনা। চোখের কোণে ভালোবাসার জল নিয়ে হাত ধুয়ে সে বিছানায় শুয়ে পরলো। মনে মনে বলছে, শফিক আমি কালই আবার ফিরে আসছি।

রাতের বেলা রতন ভাই যখন এলেন তখন আমি আইসিইউর সামনের ফ্লোরে প্রায় ঘুমিয়ে পড়েছি। উনি আমার মোবাইল নিয়ে এসেছেন। মানিব্যাগও নিয়ে এসেছেন। আমি বুঝতে পারছি আমার বেশ জ্বর এসেছে। রতন ভাইকে মতলব ভাইয়ের কথা জিজ্ঞেস করলাম।

ভাই, মতলব ভাই কেমন আছেন??

রতন ভাই মুখ কুঁচকে বললেন আমি সকালে বাসায় যেয়ে উনাকে পায়নি। উনি আজ সকালে দেশে চলে গেছেন।

উত্তরটা শুনে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। এত বড় একটা বিপদ চোখের সামনে দেখে উনি কিভাবে পারলেন দেশে চলে যেতে? আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে বসে থাকলাম। বাইরে টিপটিপ বৃষ্টি পড়ছে। দূরে সোডিয়াম বাতির আলো আমার কাছে কেমন যেন নির্জীব মনে হচ্ছে। এই ঢাকা শহরে একা একা যারা বাস করছে তাদের কষ্টটা অন্যকেউ বুঝবে না। আমি টাকার চিন্তায় আবার দিশেহারা বোধ করছি। রতন ভাই আমাকে বললেন,

তানভীর, যেভাবেই পারো টাকার ব্যবস্থা করো। না হলে আমরা শফিককে বাঁচাতে পারবোনা। মোতালেব ভাইয়ের উপরে আশা করেছিলাম। উনি তো বিপদ দেখে গা ঢাকা দিয়েছেন। ফোন করলে বললেন জরুরী কাজে বাড়িতে এসেছেন। কবে ফিরবেন ঠিক নেই।

আমি উনার কথা শুনছি আবার শুনছিও না। শেষে উনাকে বললাম,

ভাই, আপনি থাকেন। আমি বাসায় যাচ্ছি। কাল দুপুরের দিকে চলে আসবো। রতন ভাই হঠাৎ আমার হাত ধরে বললেন, তানভীর, শফিক বাঁচবে তো???

আমি উনার কাঁধে হাত রেখে শুধু একটু হাসলাম। মনে মনে বললাম, আমি নিজেও তো এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজছি রতন ভাই। আমাদের শফিক বাঁচবে তো।

আনিকার প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হচ্ছে। সে অনেক কষ্ট করে শফিকদের মেস খুঁজে বের করেছে। সেই কখন থেকে দরজায় দাঁড়িয়ে সে নক করেই যাচ্ছে কিন্তু কেউ গেট খুলছেনা। সকাল ১০টা বাজছে। এত বেলা পর্যন্ত মানুষজন ঘুমায় নাকি??? এদেরতো কোন কাজ-কর্ম নেই। তাহলে??? আনিকা ভাবছে মাত্র সকাল অথচ রোদের তেজে সে ঘেমে ভিজে গেছে।

দরজায় কড়া নাড়ার প্রচন্ড শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। আমার কেন যেন মনে হচ্ছে মতলব ভাই ফিরে এসেছেন। আমি দরজা খুললেই দেখতে পাবো উনি দুইহাতে দুইটা বিশাল পোটলা হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। দরজা খোলার সাথে সাথেই উনি বলবেন, এই যে তানভীর, নাও তোমার ভাবীর হাতের পিঠা নিয়ে এসেছি। খেয়ে বলতে হবে কিন্তু কেমন হয়েছে। আমি শুধু একটা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে দরজা খুলতে গেলাম। দরজা খুলে আমি অবাক হয়ে দেখলাম আমার ধারণা একেবারেই ভুল। দরজায় একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমাদের মেসে মেয়ে?? আমি কিছু বুঝে উঠার আগেই উনি বললেন,

স্লামালাইকুম, আমি আনিকা। শফিক কি বাসায় আছে???

আমি চোখ ডলে ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, হুম উনি আনিকা। শফিকের আন্নি। আমি খুব খুশি হয়ে উনাকে ভিতরে আসতে বলার সাথে সাথেই আমার মনে হলো এখন কি হবে। শফিকের কথা শুনে এই মেয়ে কি করবে কে জানে। রুমে ঢুকে আনিকা আবারো জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা আপনিতো ওর বন্ধু তানভীর, তাই না?? শফিক কোথায়??? ও কি বাসায় নেই??

আমি শুধু বললাম, আনিকা, আপনি বসেন। আমি আসছি। উনাকে বসিয়ে রেখে কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে আমি কাপড় পাল্টানোর জন্য বাথরুমে চলে গেলাম। কাপড় পাল্টাচ্ছি আর ভাবছি আমি কিভাবে আনিকাকে ম্যানেজ করবো। তবে এটা চিন্তা করেও ভালো লাগছে যে এখন শফিকের জন্য যাকে বেশী দরকার ছিলো তাকে আমরা পেয়েছি। কেন যেনো মনে হচ্ছে শফিক বেঁচে যাবে। আমি মনে দুঃশ্চিন্তা আর আনন্দের একটা মিশ্র অনুভূতি নিয়ে রেডি হয়ে বের হয়ে আসলাম।

আসার পর আনিকাকে শুধু বললাম, আনিকা আমার সাথে চলেন। গত রবিবার শফিকের একটা ছোট্ট একসিডেন্ট হয়েছে। ও হাসপাতালে।  এটুকু বলেই আমি ঘুরে হাটা শুরু করলাম। আনিকার মুখের দিকে তাকানোর কোন সাহস আমার নেই।

পুরোটা রাস্তা মেয়েটা কোন কথা বলেনি। মাঝে মাঝে শুধু চাপা দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনেছি আমি। আকাশ কালো করে মেঘ করেছে। আজ মনে হয় আবার ঝুম বৃষ্টি হবে। আমরা আইসিইউতে পৌছে দেখি রতন ভাই সিস্টারের সাথে কথা বলছে। আমি আর আনিকা কাছে গেলাম। যেয়ে যেটা শুনলাম তা শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। শফিকের শ্বাস-কষ্ট হচ্ছে। ব্যাপারটা বেশী সুবিধার না। ওদিকে রতন ভাই আমাকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে বললেন, তানভীর বিল প্রায় হাজার পঁচিশ হয়ে গেছে। ওরা এখন টাকার জন্য চাপ দিচ্ছে। আমি কাল সকাল পর্যন্ত সময় নিয়েছি। কি করবো কিছুই তো বুঝতে পারছি না। এখানে তো ওকে রাখাও যাচ্ছেনা। কিছু একটা উপায় বের করো ভাই! কথার শেষের দিকে রতন ভাইয়ের গলা বুজে এলো। উনি অনেক কষ্টে নিজেকে সামলালেন। আমার মাথায় তখন টাকার চিন্তা নেই। আমি আনিকা কে দেখছি। সে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে আইসিইউর সামনের দরজায়। গ্লাসের ভিতর দিয়ে দেখার চেষ্টা করছে শফিককে। তার চোখ মুখ শক্ত। আমি রতন ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি একবার আশিককে ফোন করে দেখেন তো ঢাকা মেডিকেলে আইসিইউ পাওয়া যায় কিনা? রতন ভাই ফোন করলেন। কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোন রিসিভ করলো না। আমি আবার আনিকার দিকে তাকানোর জন্য ফিরলাম। কিন্তু কোথায় আনিকা??? মেয়েটা নেই। মাত্রই ওখানে দাঁড়ানো মেয়েটা কোথায় গেলো এক মুহুর্তে?? রতন ভাই রেলিং এ হাত রেখে মাথা নিচু করে আছেন। আমি উনাকে কিছু না বলেই আনিকা কে খুঁজতে বের হলাম। আইসিইউর সাথের সিড়ি দিয়ে নেমে অন্যদিনের মত সোজা না যেয়ে হাতের বামে গেলাম। আনিকা যদি বাসায় যাবার জন্য বের হয় তাহলে রিকশা নেবার জন্য তাকে এই দিকের গেটের কাছে আসতে হবে। আমি নামতে নামতেই ঝুম বৃষ্টি শুরু হলো। একতলার বারান্দা ধরে সামনে এগুতেই আমি একটা অদ্ভুত দৃশ্য দেখতে পেলাম। একটা মেয়ে এই ঝুম বৃষ্টির মাঝে একটা ভাঙ্গা দোলনায় বসে শব্দ করে কাঁদছে। মেয়েটাকে আমি চিনতে পেরেছি। মেয়েটা আনিকা। আমাদের শফিকের আন্নি।

আনিকা কাঁদছে। চিৎকার করে কাঁদতে পারলে তার আরো শান্তি লাগতো। কিন্তু সে চিৎকার করতে পারছেনা। তার গলা ধরে আসছে। ঝুম বৃষ্টির মাঝে তার চোখের পানিগুলো ধুয়ে চলে যাচ্ছে। আনিকার মনে হচ্ছে তার স্বপ্নের রঙ গুলোও এই প্রবল বারিধারায় মুছে যাচ্ছে কোন এক অজানা শোকে। তার জীবনের সব কষ্ট গুলো জড়ো হয়েছে আজকের এই অঝর শ্রাবনে। উপরে তাকিয়ে আকাশ দেখার চেষ্টা করেও সে পারছেনা। কারো কাছে তার নালিশ জানানোর কথা। কেন তার সাথে এমন হবে? কিন্তু যাকে নালিশ জানানো যায় শাস্তিটা তিনিই আনিকাকে দিয়েছেন। এখন আর তার কিচ্ছু বলার নেই। নির্বাক হয়ে যেতে পারলে খুব ভালো হত। অথবা মৃত কোন গোলাপের মত। তার অনেক কথা মনে পরে যাচ্ছে। অনেক অনেক কথা। তার অনেকদিনের শখ ছিলো শফিককে নিয়ে একদিন ঝুম বৃষ্টিতে নদীর পাড়ে হেঁটে বেড়াবে। কিন্তু সে সুযোগ আর পাবে কিনা সে জানেনা। তার মনে হচ্ছে শফিকের স্যুটের কথা। তার সাথে করা ঝগড়ার কথা। সে নিজেকে কোন ভাবেই ক্ষমা করতে পারছেনা।

আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মেয়েটার বৃষ্টিতে ভেজা দেখছি। শুধু আমি না। আসে পাশের অনেকেই দেখছে। সবাই বুঝতে পারছে প্রিয়জন হারানোর কষ্ট নিয়ে একটা মানুষ কতটা কঠিন সময় পার করছে। কতটা আবেগ জমে তৈরী হয়েছে আজকের এই জলধারা। আমি জানি না। আমার খুব ইচ্ছা করছে মেয়েটার মত বৃষ্টিতে নেমে যেতে। কিন্তু আমি পারছি না। আমার মাথায় ঘুরছে হাসপাতালের বিলের কথা। তবুও আমি বৃষ্টিতে নামলাম। পাগলীটাকে ফেরানো দরকার। শফিকের জন্য হলেও আনিকাকে এখন আমাদের খুব বেশী দরকার। আমি ধীর পায়ে আনিকার পাশে গিয়ে দাড়ালাম। সে বিড়বিড় করে কী যেনো বলছে। একটু খেয়াল করতেই বুঝলাম সে বলছে,

শফিক, তুমি ফিরে এসো। প্লিজ শফিক তুমি ফিরে এসো। প্লিজ। আমি আর কখনো তোমাকে বাজে কথা বলবো না। একটাবার আন্নি বলে ডাকো না বাবু। প্লিজ বাবু। শুধু একবার। আমি তোমার জন্য কাল সাজতে বসেছিলাম। একটা বার এসে দেখে যাওনা বাবুটা। প্লিজ বেবি। প্লিজ শফিক। প্লিজ।

আমার চোখ বেয়ে টপটপ করে পানি পড়ছে। আমি সান্তনা দিতে এসে নিজেই নিজেকে হারিয়ে ফেললাম। আমি আনিকার পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভিজে যাচ্ছি। আমার মাথায় আর কিছুই আসছে না। আনিকার সাথে গলা মিলিয়ে আমিও বলতে শুরু করলাম, শফিক রে!! বন্ধু, আর একবার ফিরে আয়। আর একবার তোকে নিয়ে কালা ভূনা দিয়ে ভাত খেতে ইচ্ছা করছে। এবারের কাচ্চির বিলটা না হয় আমিই দেবো। আমি বাচ্চাদের মত শব্দ করে কাঁদছি। আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছা করছে আল্লাহ্‌, শফিককে ফিরিয়ে দাও।

হঠাৎ আমার খেয়াল হলো আমার মোবাইল বাজছে। আমি বারান্দায় উঠে ভেজা হাতে মোবাইল বের করে দেখি রতন ভাইয়ের ফোন। আতংকের একটা চাপা স্রোত আমার শরীর বেয়ে নেমে গেলো। আমি কাপাকাপা হাতে ফোন ধরলাম। ওপাশ থেকে রতন ভাইয়ের উত্তেজিত গলা।

তানভীর, আশিক ফোন করেছিলো। কাল সকালে ঢাকা মেডিকেলে একটা সিট খালি হবে। এখন যেভাবেই হোক রাতের মধ্যে আমাদের টাকা যোগাড় করে কাল শফিককে এখান থেকে নিয়ে যেতে হবে। তুমি দেখো কিছু করতে পারো কিনা। আমি এত কষ্টের মাঝেও একটু আশার আলো দেখলাম। আমি আনিকার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ওকে খবরটা দিলাম। ভেজা কাপড়ে দুজনে ফিরে চললাম আইসিইউর পথে।

রাত ৮টা। আনিকা এখনো আইসিইউর সামনে বসে আছে। আমি আর রতন ভাই হাজার ভেবেও কোন কুল কিনারা করতে পারছিনা। আগামীকাল সকালে নিয়ে গেলে সম্ভাব্য বিল আসবে ৩০ হাজারের উপরে। এতটাকা একসাথে কিভাবে যোগাড় করবো ভেবে পাচ্ছিনা। একবার মনে হচ্ছে শেষ চেষ্টা হিসাবে বড় মামার বাসায় যাই। কিন্তু সাথে সাথেই চিন্তাটা বাতিল করে দিলাম। আমি জানি সেখানে যাওয়া সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু না। সময় চলে যাচ্ছে। আমি আর রতন ভাই বিভিন্ন জায়গায় ফোন দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। কিন্তু কিছুতেই কোন লাভ হচ্ছেনা। আনিকাও কয়েক জায়গায় ফোন দিলো কিন্তু কোন সাড়া পেলো না।

আমার সিগারেট শেষ হয়ে গেছে। আমি সিগারেট কিনতে হাসপাতালের বাইরে এসে দাড়িয়েছি। একটা চায়ের অর্ডার দিয়ে সিগারেট ধরালাম। হঠাৎ কাঁধে একটা হাতের স্পর্শে চমকে উঠলাম। পিছনে ফিরে দেখি মতলব ভাই একটা ট্রাভেল ব্যাগ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি ভূত দেখার মত চমকে উঠলাম। আমার মুখ দিয়ে কথা বের হচ্ছেনা। মতলব ভাই বললেন,

তানভীর, আর একটা চায়ের অর্ডার দাও। শফিকের কি জ্ঞান ফিরেছে??? সিগারেট তাড়াতাড়ি শেষ করে চলো।

আমি সিগারেট ফেলে, চা ফেলে উনার হাত ধরে টান দিলাম। উত্তেজনায় আমার চিন্তাশক্তি লোপ পেয়েছে। আমি মতলব ভাইকে নিয়ে যখন আইসিইউর সামনে তখন রতন ভাই মাত্র ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করেছেন। মতলব ভাইকে দেখে তিনি আমার চেয়েও বেশী অবাক হলেন। রতন ভাই হা করা মুখে শুধু একটা কথায় বললেন,

আপনি গেলেনই বা কেনো আর আসলেনই বা কেনো???

মতলব ভাই কোন কথা বললেন না। ট্রাভেল ব্যাগ থেকে প্রথমে একটা প্যান্ট বের করলেন। তারপর প্যান্টের পকেট থেকে বের করলেন ৫০০ টাকার ২টা বান্ডিল। আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, এখানে ৫০ হাজার আছে।

আমি হা করে টাকাটার দিকে তাকিয়ে আছি। রতন ভাই প্রবল অবিশ্বাসী চোখে একবার মতলব ভাই আর একবার টাকার দিকে তাকাচ্ছে। আনিকা এতক্ষন মাথা নিচু করে বসে ছিলো। সে হঠাৎ উঠে দাঁড়ালো। আমি দুইহাতে দুই বান্ডিল টাকা নিয়ে মতলব ভাইকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। একটু পরে উনাকে ছেড়ে আমি টাকা গুলো ব্যাগে রাখছি এমন সময় আনিকা মতলব ভাইকে অবাক করে দিয়ে উনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে বসলো। মতলব ভাই চমকে উঠে শুধু বলতে থাকলেন, একি?? একি?? তুমি কে???

আমি বললাম, মোতালেব ভাই, ও আনিকা। আমাদের শফিকের আন্নি। মোতালেব ভাই আনিকার মাথায় হাত রেখে হঠাৎ শব্দ করে কেঁদে উঠলেন। আমি আকাশের দিকে তাকিয়ে কান্না লুকানোর চেষ্টা করছি। মেঘের ফাঁক দিয়ে একটা মস্ত বড় চাঁদ উঁকি দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছিনা। আবেগের জল আমার দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে।

শফিককে ঢাকা মেডিকেলে আনার দুইদিন পর আজ ওর জ্ঞান ফিরেছে। এখন সে আছে হাসপাতালের কেবিনে। জ্ঞান ফেরার সময় ওর কাছে শুধু আমি ছিলাম। জ্ঞান ফিরে পেয়ে কেবিনে আসার পরে সে আমার কাছে প্রথম যে কথাটা জানতে চেয়েছে তা হলো আমি আনিকাকে ঐ মোড়ের দোকানদারের পা ধরার কথা বলেছি কিনা। আমি বলিনি শুনে সে খুবই মর্মাহত হয়েছে। আহত চোখে সে জানতে চেয়েছে তার এই অসুস্থতার কথা আনিকাকে বলা হয়েছে কিনা। এটার উত্তরেও আমি না বলেছি। তখন সে খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চেয়েছে তার খোঁজ আনিকা কখনো করেছিলো কিনা?? আমি এবারো না বলেছি। ইচ্ছা করেই আমি ওকে মিথ্যা কথা বলেছি। এমনকি শফিকের যে জ্ঞান ফিরেছে এই খবরটাও আমি কাউকে জানাইনি। আমার খুব ইচ্ছা করছে সবাইকে প্রবল আনন্দ দিতে। প্রচন্ড আকাঙ্ক্ষিত কোন জিনিস যখন হাজার চেয়ে না পাওয়ার পরে হঠাৎ করে হাতের কাছে পাওয়া যায় তখনকার সেই অপার্থিব আনন্দের কোন তুলনা হয়না। আমি আমার খুব কাছের এই মানুষগুলোকে সেই আনন্দ থেকে বঞ্চিত করতে চাচ্ছিনা। শফিককে দেখে এখন আমার খুব মায়া হচ্ছে। বেচারা একদম শুকিয়ে গেছে। সে মুখ শুকনো করে বিছানায় শুয়ে আছে। আর একটু পরপর তার বেয়ারা ভাবে বেড়ে ওঠা দাড়িতে বাম হাত দিয়ে চুলকাচ্ছে। মাঝে মাঝে আমাকে বলছে তার পিঠ চুলকে দিতে। আমি তার সেবা যত্ন করতে করতে ভাবছি আনিকা কেন এখনো ফোন দিচ্ছেনা। মেয়েটা প্রতিদিন হাসপাতালে ঢুকেই আমাকে ফোন দেয়। কিছু লাগবে কিনা জিজ্ঞেস করে। আমি ওর ফোনের অপেক্ষা করছি।

একটু পরেই আনিকা ফোন করলো।

ভাইয়া, কিছু লাগবে আপনার??? পানি আনতে হবে??

আমি কন্ঠ যথাসম্ভব গম্ভীর করে বললাম, আনিকা তুমি কেবিন নাম্বার ২০ এ চলে আসো। তিনতালায় কেবিন ব্লকে। হাতের বামে। সে খুব উৎকন্ঠা নিয়ে জিজ্ঞেস করলো, ভাইয়া খারাপ কিছু হয়েছে কী???

আমি খুব ঠান্ডা গলায় বললাম, তুমি তাড়াতাড়ি আসো।

আমি জানি ওর আসতে ১০ মিনিট মত লাগবে। শফিকের একটু তন্দ্রা মত এসেছে। আমি রুমের লাইট নিভিয়ে দিলাম। জানালার পর্দা টেনে দিলাম। ঠিক ৮ মিনিটের মধ্যে আনিকা ছুটতে ছুটতে কেবিনে ঢুকলো। আমি ইশারায় শান্ত হতে বলে ওকে বসিয়ে, আসছি বলে রুম থেকে বের হয়ে আসলাম। আমি ওদের মিলনের এই অসাধারণ মুহুর্তে থাকতে চাচ্ছিনা। আমি জানি কিছুক্ষন পরেই শফিক জেগে উঠবে। কিছু কিছু মুহুর্তের জন্ম হয় শুধু দুজনের জন্য। সেখানে ৩য় জনের থাকা অপরাধের পর্যায়ে পরে। এতবড় অপরাধ করতে আমার মন চাচ্ছেনা।

আমি গেটের বাইরে এসে রিকশা খুঁজছি। হঠাৎ পরিচিত একটা চেহারা চোখে পড়লো। সেদিনের সেই রিকশাওয়ালা। আমি কিছু বলার আগেই সে এগিয়ে এলো আমার দিকে।

পরিশিষ্টঃ

হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাবার দিন আনিকা শফিকের জন্য বানানো স্যুট নিয়ে এসেছিলো। প্রবল বৃষ্টির মধ্যে শফিক সেই স্যুট পরে রাস্তায় নেমেছে। শুকিয়ে যাওয়ায় স্যুট তার গায়ে খুবই ঢোলা হয়েছে। তার উপর ডানহাত কাঁধের সাথে ঝুলানো থাকায় শফিককে দেখাচ্ছে কাকতাড়ুয়ার মত। সবাই খুব অবাক হয়ে দেখছে ঝুম বৃষ্টিতে একটা রূপবতী তরুণী একটা বেঢপ স্যুট পড়া ছেলের সাথে ভিজে ভিজে হেঁটে যাচ্ছে। সেই সবাই এর মধ্যে আমিও আছি। কিন্তু আমার কাছে দৃশ্যটা অন্যদের মত লাগছেনা। আমার মনে হচ্ছে এত কষ্টের জীবনেও স্বপ্ন থাকে। স্বপ্নেরা এভাবেই হেঁটে যায় অলস দুপুরে।

latest video

news via inbox

Nulla turp dis cursus. Integer liberos  euismod pretium faucibua

Leave A Comment