আঁধারের অপ্সরী

Published On: May 20, 2013By Tags: , , Views: 87

ট্রেনটা যখন প্লাটফরমের শেষ মাথায় এসে পৌছালো তখনও তন্দ্রাচ্ছন্ন ভাবটা কাটেনি আমার। আড়মোড়া ভেঙ্গে হাই তুলে জানালা দিয়ে আকাশের দিকে তাকাতেই মন ভালো হয়ে গেল। কি চমৎকার শেষ বিকেলের আলো। গোধূলী বেলার গ্রাম-বাংলার সৌন্দর্য্য যে দেখেনি তার এই জীবনই বৃথা। সাথে আরও একটা কথা মনে হল। এই আলোতে নাকি মেয়েদের খুব সুন্দর লাগে। এই কথা মনে হতেই কিনা জানি না আমার চোখ ট্রেনের জানালা দিয়ে উঁকিঝুঁকি দেয়া শুরু করেছে। নাহ তেমন কাউকে দেখতে পাচ্ছি না। হঠাৎ কুলির ডাকে আমার নারী মুখ খোঁজার ধ্যান ভাঙল।

-স্যার, নামবেন না?? পুরা ট্রেনের মাইনষ্যে তো নাইম্যা গেছে। কুলি লাগবো?

– এ্যা, হ্যাঁ, না আসলে। আমি নিজেই বুঝে পাচ্ছি না আমি কি বলছি।

-স্যাররে কি কেউ নিতে আইবো? সেই তখন থেইক্যা কারে জানি বিছরাইতাছেন।

এইবার আমি পুরো ঘটনার মধ্যে প্রবেশ করলাম। এবং প্রবেশ করা মাত্র মোটামুটি আঁতকে উঠলাম। ট্রেনের কামড়ায় আমি ছাড়া আর কেউ নেই। ওদিকে আমাকে মন্ত্রমুগ্ধ করে রেখে সূর্য্য মামা কখন যে তার শ্বশুর বাড়ি বেড়াতে চলে গেছে তা আমার চোখেই পড়েনি। আমার মাথার উপরের তাকে দুটা বড়সড় ব্যাগ। পায়ের কাছে একটা হ্যান্ড ব্যাগ। ট্রেনের জানালার ওপাশে মাঝ বয়সী একজন কুলি আমার এই অদ্ভুত আচরণে বেশ সন্দেহ নিয়েই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। দূর দিগন্তে এতক্ষন হালকা আলো থাকলেও এখন বেশ গাঢ় অন্ধকার। সেই গাঢ় অন্ধকার ভেদ করেই আমাকে যেতে হবে স্টেশন থেকে প্রায় মাইল পাঁচেক দূরের শুভপুর উপজেলায়। সবকিছু মনে হতেই আমি মোটামুটি ভাবে বেশ ঝামেলার মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম। ঝামেলার মধ্যে পরা মাত্র ঝামেলাগুলোর তালিকা করা এবং সেই অনুযায়ী সমাধান করা আমার ছোটবেলার অভ্যাস। এখন সেই কাজটাই আমাকে করতে হবে। এইসব ভাবতে ভাবতেই আবার কুলির ডাক।

-স্যার, আপনে কি ভুল ট্রেনে আইসেন?

-না ভুল ট্রেনে আসিনি। ঠিক ট্রেনেই এসেছি। আপনি আসুন। আমার সাথে বড় বড় দুটা ব্যাগ আছে।

এতক্ষণে তার মুখে একটা হালকা হাসির রেখা দেখা গেল। হয়তো আজকের জন্য এই শেষ ট্রেনে উপার্জনের শেষ সুযোগ পেয়ে সে বেশ খুশি। ট্রেনের জানালা দিয়ে একটা টং দোকানের ৬০ পাওয়ারের বাল্বের হালকা আলোয় লোকটাকে একনজর দেখলাম। বেশ শক্ত-সামর্থ্য চেহারা। খুব দ্রুতই সে ব্যাগ দুটো কাঁধে ঝুলিয়ে নিয়ে বললো

-নামেন স্যার। আপনে যাইবেন কই?

-আমি শুভপুর যাবো।

-ও মা। শুভপুর কার বাড়ি?

-শুভপুর চেয়ারম্যান বাড়ি।

নামতে নামতে ঝামেলাগুলোর তালিকা করে ফেললাম। ঝামেলা নাম্বার এক – চা এবং ফ্লেক্সির দোকান খুঁজে বের করতে হবে। ঝামেলা নাম্বার দুই – মামুনকে ফোন করে জানাতে হবে আমি পৌঁছে গেছি। ঝামেলা নাম্বার তিন – আমি এইখানে প্রথম এসেছি এবং আমাকে মাইল পাঁচেক যাবার ব্যবস্থা করতে হবে।

হাটছি আর চারিদিকে দেখতে দেখতে ঝামেলা নিয়ে ভাবছি। সন্ধ্যার হালকা অন্ধকারে পার্বতীনগর ষ্টেশনটাকে কেমন যেন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। ট্রেন স্টেশনে সাধারণত বেশ কয়েকটা টং দোকান থাকে। এখানে মাত্র দুটা। তাও আবার দুই মাথায়। আমরা আছি স্টেশনের মাঝ বরাবর। কোনদিক থেকে বের হব আমি জানি না। তবে যেদিক থেকেই বের হইনা কেন আমার এখন এককাপ চা খুব জরুরি হয়ে পরেছে। মোবাইলেও রিচার্জ করতে হবে। চিন্তায় আবার বাঁধা পরলো কুলির কথায়।

-স্যার, জিগাইতেছিলাম যে শুভপুর কার বাড়ি যাইবেন।

-চেয়ারম্যান বাড়ি।

-আপনে কি চেয়ারম্যান সাবের কাছে আইছেন? উনাগো আত্মীয়?

-নাহ। আমি আসলে যাবো চেয়ারম্যান বাড়ির কাছে যে কালি মন্দির আছে তার পাশে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। ওইখান কার ডাক্তার আমার বন্ধু। আমি ওর কাছেই আসছি।

– ও আপনি মামুন স্যারের কাছে যাইবেন।

কুলির মুখে মামুনের নাম শুনে আমি ঝট করে ফিরে তাকালাম। লোকটার মুখে একটা হালকা হাসি। সে মামুনকে কিভাবে চেনে তা আন্দাজ করার চেষ্টা করছি। সাথে সাথে বেশ কৌতূহলও হচ্ছে যে মাত্র ৬ মাস এসেই মামুন বেশ নাম করে ফেলেছে কিভাবে। তাকে কোন কিছু জিজ্ঞেস না করে শুধু বললাম – হু।

– স্যার, আমার বাসা স্যারের কোয়ার্টারের পাশেই। স্যার খুব ভালা মানুষ।

– আচ্ছা? ভালো কথা আমার একটু ফ্লেক্সি করা লাগবে আর চা-ও খাওয়া লাগবে।

– কুনু অসুবিধা নাই স্যার। ঐ যে মজিবরের দোকান। সব ব্যবস্থা আছে। তয় স্যার ইট্টু তাড়াতাড়ি করন লাগবো। বেশী দেরী করলে আবার ভ্যান পাইবেন না। লাস টেরেন অনেকক্ষন আগে আইছে তো। ভ্যান ওয়ালারা ক্ষেপ লইয়া বাড়িত গ্যাছে গা।

এতক্ষনে আমার মাথায় আসলো যে আমাকে এখান থেকে প্রায় ৫ মাইল দূরে যেতে হবে। এবং এটা ঢাকা শহর নয় যে যানবাহনের তেমন অসুবিধা হবে না। টং দোকানে পৌছে দুটো চায়ের অর্ডার দিলাম। চা আসলে একটা কাপ লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিলাম। সে খুব একটা অবাক হয়েছে বলে মনে হল না। কোন কথা না বলেই সে কাপ নিলো। কিন্তু তার অবাক হবার কারণ ছিল। এই মফস্বলের স্টেশনে যাত্রীরা টং দোকানে বসে কুলির সাথে চা খাবে এমনটা সরারচর হবার কথা নয়। তাহলে লোকটা কেন অবাক হল না? ভাবতে ভাবতেই আবার সে বলে উঠলো-

– স্যার চা লন। খাইতে পারেন কি না দেহেন। দেরী হইয়া গেলে ভ্যান পামু না।

– আপনিও তো ওদিকেই যাবেন নাকি?

– জ্বী স্যার। আইজক্যার মত কাম শেষ।

– তাহলে তো আপনি আমার ভ্যানেই যেতে পারবেন।

এবারে তার মুখটা আরও উজ্জ্বল হয়ে উঠলো। হয়তো এমন একটা কিছুই সে আশা করছিলো আমার কাছে। দ্রুত চা শেষ করলাম। ফ্লেক্সি করে বের হয়ে আসলাম স্টেশন থেকে। দূরের আকাশ বেশ অন্ধকার। বিকেলেও মেঘ তেমন ছিলনা। এখন আকাশ বেশ কালো। তারা দেখা যাচ্ছে না। চাঁদও নয়। স্টেশনের বাইরে সবকিছু কেমন যেন চুপচাপ। কুলি লোকটা ভ্যানওয়ালার সাথে কথা বলছে। সবঠিক করে সে এসে বললো ‘স্যার, লন যাই’। ভ্যানে উঠে বসলাম। চলা শুরু হতেই আকাশ কেঁপে উঠলো মেঘের গর্জনে। শুরু হল শুভপুরে আমার প্রথম রাত।

ভ্যানে উঠে মামুনকে ফোন দিয়ে বললাম আমি আসছি। রাতের খাবারের মেন্যু খিচুড়ি আর ডিম ভাজি জেনে খিদেটা বেশ জানান দিয়ে উঠলো। ভ্যান যাচ্ছে বেশ দ্রুতগতিতে। কখনো পাকা রাস্তা আবার কখনো কাঁচা। দুলুনিতে তেমন একটা অসুবিধা হচ্ছে না। কুলি লোকটা বেশ কিছুক্ষন কোন কথা বলছে না দেখে আমি আলোচনা শুরু করলাম। মানুষকে পর্যবেক্ষন করা আমার খুব প্রিয় শখের একটা। কারো সম্পর্কে সে বলার আগেই কোন কিছু বুঝে নিতে এবং তাকে সেটা বলে চমকে দিতে ছোটবেলা থেকেই খুব ভালো লাগে। সাইকোলজির প্রতি এই আগ্রহ তৈরী হয়েছিল কিশোর বয়সেই।

-কুলি ভাই, আপনার নাম কি?

-জ্বে আমার নাম হাশমত আলী স্যার।

-হাশমত ভাই, আপনাদের ডাক্তার সাহেব কেমন চিকিৎসা দেন?

-কার কথা কন? মামুন স্যারের কথা? হের মত মানুষ হয় না। খুব ভালা ডাক্তর। কারো লগে খারাপ ব্যবহার করে নাই কুনুদিন। গেরামের সবতে তারে ভালা পায়। আমার লগে মাঝে মইধ্যে গেরামের দোকানে দেখা হইলে গপ করে।

-হুম। শুধু তো গপ করে বলে মনে হয় না। মাঝে মধ্যে চা-নাস্তাও খাওয়ায় নাকি?

-জ্বে স্যার। তয় আপনে কেমনে জানলেন?

-খুব সহজ হাশমত ভাই। আমি যখন আপনার দিকে চায়ের কাপ বাড়িয়ে দিলাম তখন আপনি বিনা সংকোচে কোন কথা না বলে আমার দিকে না তাকিয়ে কাপটা হাতে নিলেন। তারমানে আপনি এমন ব্যবহার পেয়ে অভ্যস্ত। আর আমি যেহেতু মামুনের বন্ধু কাজেই আপনি ভেবেছেন আমিও ওর মতই।

-স্যার, আপনের মাথায় অনেক বুদ্ধি।

-অনেক না হাশমত ভাই। অল্প বুদ্ধি। ভালো কথা আমাদের যেতে কতক্ষন লাগবে?

-তা ঘন্টা দেড়-দুই তো লাগবোই। স্যারের কি কষ্ট হইতেছে?

-নাহ। মাথার উপরের এই মেঘ নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা হচ্ছে। সাথে বেশকিছু বই আছে তো। বৃষ্টি হলে ভিজে যাবে।

-স্যার কি মামুন স্যারের মত ম্যালা বই পড়েন? হ্যারে ডাকতে গেলেই দেহি উনি পড়তাছেন। আপনাগো পড়া কি শেষ হয় নাই স্যার?

-হা হা হা। হাশমত ভাই, ডাক্তারদের পড়া জীবনেও শেষ হয় না।

আবার বেশ খানিকক্ষনের নিরবতা। খুব হালকা বৃষ্টির ফোঁটা গায়ে পরছে। মাঝে মাঝে দূর থেকে কুকুরের ডাক ভেসে আসছে। ভ্যান এখন চলছে একটা বড় দীঘির পাশ দিয়ে। অন্ধকারে সবকিছুর মত দীঘির পানিও কালো। আমি দেখছি। মন্ত্রমুগ্ধের মত দেখছি। অসম্ভব ভালো লাগা নিয়ে উপভোগ করছি আসল গ্রামের সৌন্দর্য্য। ভাবনায় আবার বাঁধা পরলো হাশমতের কথায়।

-স্যারের কি কষ্ট হইতেছে?

-নাহ হাশমত ভাই। আমার এই রাতের বেলার প্রকৃতি বেশ ভালো লাগে। এজন্য মাঝে মাঝে আমি অনেকরাত পর্যন্ত বাইরে থাকি।

-স্যার, একটা কথা কইতাম যদি কিছু মনে না লন।

-বলে ফেলেন। কোন সমস্যা নাই।

-না মানে আফনেরা শিক্ষিত মানুষ। আমাগো কথা বিশ্বাস করবার নাও পারেন।

-হাশমত ভাই যা বলতে চাচ্ছেন বলে ফেলেন।

-না কথা হইলো যে আপনে তো অনেক রাইত বাইরে থাকেন কইলেন তাই কইতে চাইতেছিলাম যে কোয়ার্টারের কাছেই তো ওই কালি মন্দির।

-হুম। তো কি হয়েছে?

-স্যার মনে কিছু নিয়েন না। রাইতের কালে মন্দিরের আশে পাশে যাইয়েন না।

আমি খুব একটা অবাক না হয়ে বেশ কৌতুহলের সাথে জিজ্ঞেস করলাম,

-কেনো? কালি মন্দিরে কি সমস্যা?

-না মাইনে, বহুত বছরের পুরানা ভাঙা মন্দির। চারপাশে জঙ্গল। সাপ-খোপ থাকে ম্যালা।

-হাশমত ভাই, আপনি আসলে কি বলতে চাচ্ছিলেন সেটা বলেন। সাপ-খোপের জন্য আপনি কথা শুরু করেন নাই। আসলে কি সমস্যা ঐ মন্দিরে?

-স্যার সমস্যা হইলো গিয়া ঐ মন্দিরে রাইতের কালে কেউ গেলে উল্টা-পালটা জিনিস দেহে। আমাগো চেয়ারম্যানের বড় মাইয়া- আহারে কি সুন্দর পরীর লাহান চেহারা- মাইয়াডা ছুডু কালে একবার রাইতের বেলা হারায় গেছিল। সকালে ওরে ওইহানে মাটিতে পইড়া থাকতে পাওন গেছিলো। হের পর থেইক্যা মাইয়াডা জানি কেমুন হইয়া গেছে। বিয়ার বয়স হইছে আগেই। তয় কেউ তারে বিয়া করবো না। হের লগে জ্বীন থাকে সবসময়।

-তাই নাকি? তা আপনারা কেমন করে বোঝেন যে তার সাথে সবসময় জ্বীন থাকে? সে কি বলেছে এই কথা?

-না স্যার সে কারো লগে তেমন কথা কয় না। তয় সে মাইনষের মনের কথা কইয়া দিতে পারে। জ্বীন হের কানে কানে মাইনষের মনের কথা কয় আর সে মুখে কয়।

-আপনি নিজে দেখেছেন?

-আমি তো আমি স্যার, এই অঞ্চলের ব্যাকতে জানে এই কিচ্ছা। এর লাইগায় মাইয়াডার কুনু সম্বন্ধ আহে না। আহারে কি সুন্দর চেহারা। শুধু চেহারা না স্যার, তার ব্যবহারও খুব ভালা। কারো কুনু ক্ষতি করে নাই এপর্যন্ত।

-ব্যস এই আপনার কালি মন্দিরের কাহিনী। শুধু এ পর্যন্ত একজনের এমন হয়েছে?

-জ্বে না স্যার। গত দুই বছর ধইরা ওই হানে কেউ গেলে আর জীবিত ফিইর‍্যা আসে না। গত বছর মরছিলো বেপারী বাড়ির বড় পোলা। আর মাস দুয়েক আগে মরছে কাদের আলী।

-কিভাবে মরেছে কেউ জানে না??

-কেমতে জানবো স্যার? হেগো লাশ পাওয়া গেছে মন্দিরের পাশের ডোবার মইধ্যে।

-তাহলে মন্দিরের সাথে এর কি সম্পর্ক?

-স্যার যেইদিন সকালে লাশ পাওয়া গেছে তার আগের রাইতে মন্দিরের ঘন্টা বাজছে অনেক সময় নিয়া। কেউ ঐখানে যায় না। তাইলে এত রাইতে ঘন্টা বাজাইলো ক্যাডা আপনেই কন? আর তারও বড় কথা হইলো সকালে মন্দিরের ভিত্রে কালি মূর্তির কাছের মেঝেতে রক্ত পইড়া থাকতে দ্যাখছে সকলে।

-দুই বারই কি একই ঘটনা হইছে?

-না স্যার। পরথমবার বার ঘন্টা বাজে নাই। তয় ঐ রাইতে চেয়ারম্যানের বড় মাইয়াডা খুব হাসতাছিলো। আমার বাসা কাছে বইলা আমি শুনছি। আমার বউ ও শুনছে। আরও কয়েকজন শুনছে।

-পুলিশ কি করছে?

-হে হে হে। পুলিশ? হেরা কিছু করবার পারে নাকি? জ্বীনের লগে পুলিশ কি করবো স্যার? কেরামত ওঝা কইছে কামডা যে জ্বীন করছে সেই জ্বীন কেরামত ওঝার কাছে আইস্যা বইলা গেছে।

প্রবল বিষ্ময় নিয়ে আমি হাসমত আলীর কথা শুনে যাচ্ছি। থট রিডিং আমার খুব পছন্দের একটা বিষয়। মেয়েটার সামনে যাবার জন্য একটা তীব্র ইচ্ছা এখন আমাকে পেয়ে বসেছে। এর কথায় কি তাহলে মামুন আমাকে ফোনে বলেছিলো?

তাও মাস দুয়েক আগের কথা। হঠাৎ একদিন মামুন আমাকে ফোন করে বললো,

-তানভীর, দোস্ত কি খবর? পিজির লাইব্রেরী বলে ভাজা ভাজা করে ফেলেছিস?

-আরে ধুর! পড়া তেমন আগাচ্ছে না দোস্ত। তোর খবর বল। কেমন লাগছে বিসিএস জব? এলাকা কেমন?

-আমার কপাল ভালো দোস্ত। এলাকা খুব ভালো। রাজনৈতিক ঝামেলা একদম নেই। একজন চেয়ারম্যান আছেন বেশ বয়স্ক। সবাই তার কথায় উঠে-বসে। উনি অল্প শিক্ষিত হলেও মানুষ খুব ভালো। বেশ খোঁজ খবর নিচ্ছেন। মাঝে মাঝে তার বাসায় খেতে ডাকেন। উনার দুই মেয়ে। ছোটটাকে মাঝে মাঝে পড়া দেখিয়ে দেয়।

-মামুন, কাহিনী কিরে?? আমি তোকে এলাকা সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম আর তুই চেয়ারম্যান তার মেয়ে এদের বর্ণনায় চলে গেলি? কি ব্যাপার? প্রেমে পড়ে যাসনি তো?

-আরে ধুর! তুই যে কি বলিস? মেয়েটা মাত্র নাইনে পড়ে। তবে বড় মেয়েটা বিয়ের যোগ্য। কিন্তু মেয়েটার সমস্যা আছে।

-কি সমস্যা?

-বললে বিশ্বাস করবি না কাজেই বলতে চাচ্ছি না। শুধু শুধু ঝগড়া করতে ভালো লাগবে না। যদি সময় করতে পারিস তাহলে একবার নিজে এসে দেখে যাস। আর সাইকোলজি যেহেতু তোর খুব প্রিয় বিষয়, তোর কাছে খুব ভালো লাগবে।

-তাই নাকি? তা একটু খানি বল যে তার মধ্যে কি অস্বাভাবিকতা আছে?

-তার প্রথম অস্বাভাবিকতা সে অসম্ভব সুন্দরী। এমনটা সরারচর চোখে পরে না। আর শেষটা হল সে তোর দিকে তাকিয়ে তোর মনের কথা বলে দিতে পারবে।

-মামুন, কি আজব কথা বলছিস?

-এজন্যই তো বললাম বিশ্বাস করবি না। পারলে এসে দেখে যাস। এলাকাটা এমনিতেও সুন্দর।

-আচ্ছা। দেখি যদি সময় করতে পারি।

এই হল আমার শুভপুর গ্রামে আসার কাহিনী। গ্রামে বেড়ানোর চেয়ে, বন্ধুর সাথে কিছুদিন কাটানোর চেয়ে অজানা অচেনা এক অসম্ভব রূপবতী মেয়ের অদ্ভুত ক্ষমতা দেখার জন্য আমি ছুটে এসেছি আমার সব কাজ ফেলে এই শুভপুরে।

হঠাৎ মেঘের গর্জনে বাস্তবে ফিরে এলাম। হাসমত আলী বলছে,

-স্যার শুভপুর আইস্যা পরছি। আর মিনিট দশ পরেই চেয়ারম্যান বাড়ি।

-হু। বলে চুপ করে রইলাম।

কিছুক্ষন পর একটা দমকা হাওয়া এসে শরীর ঠান্ডা করে দিল। হঠাৎ মনের মধ্যে কে যেন বলে উঠলো, ‘শুভপুরে স্বাগতম ডাঃ তানভীর’। প্রবল বিষ্ময়ে আমি হাতের বা পাশে তাকিয়ে দেখলাম বড় বড় অক্ষরে লেখা চেয়ারম্যান বাড়ি। বারান্দায় একটা নারী মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। টিউবলাইট পিছনে থাকায় আবছা দেখা যাচ্ছে। চেহারা বোঝা যাচ্ছে না। আমার সাড়া গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।

ফিসফিস করে হাসমত আলী বললো- স্যার ওইটা চেয়ারম্যানের বড় মাইয়া।

 

ইয়াকুব সাহেব ভীষণ চিন্তায় পরে গেছেন। কিছুতেই হিসাব মিলাতে পারছেন না। এইটা কি হল? তার সামনের টেবিলে একটা দাবার বোর্ড। বোর্ডের পাশে একটা বই খোলা। বইয়ের নাম ‘দাবা খেলার নিয়ম-কানুন ও বিশ্ব খেতাবী লড়াই’। ইয়াকুব সাহেব নিয়ম-কানুনের পাট চুকিয়ে এসেছেন বহুবছর। কিন্তু খেতাবী লড়াইয়ের এই অংশটা তার কাছে আজো ঠিক পরিস্কার হল না। প্রতিরাতে নিয়ম করে তিনি ঘন্টা দুই দাবার চর্চা করেন। এটা তার বহুদিনের পুরানো অভ্যাস। মাঝে মাঝে আজিজ মেম্বার আসেন, হাইস্কুলের অংকের শিক্ষক বিশ্বনাথবাবু আসেন। তাদের সাথে খেলেন ইয়াকুব সাহেব। কিন্তু ঠিক তেমন একটা জুত পাননা। খেলোয়াড় হিসাবে এরা খুবই নবিস। ইয়াকুব সাহেবকে তারা হারাতে পারেননি কখনো। ইয়াকুব সাহেব তাই দাবার বই দেখে দেখে বিখ্যাত খেলোয়াড়দের খেলাগুলো নিজে নিজেই খেলেন। আজো তেমনি একটা বিখ্যাত খেলা নিয়ে বসেছেন। ববি ফিশার কি বুঝে তার মন্ত্রী বিপক্ষ খেলোয়াড় মিখাইল তাল-কে একেবারেই বিনা বাধায় খেতে দিলেন তা কিছুতেই তার মাথায় আসছে না। এইটা নিয়ে ইয়াকুব সাহেব ভীষণ চিন্তা করছেন। তার ভ্রু একবার কুঁচকে যাচ্ছে আবার একবার সোজা হচ্ছে। এইভাবে আধাঘন্টা পার হয়ে গেল কিন্তু ফিশারের চালের রহস্য বের করতে পারছেন না। তার খুব ইচ্ছা করছে মতিকে পাঠিয়ে মামুন ডাক্তারকে ডেকে আনতে। মামুন আসলে সুন্দর করে বুঝিয়ে দিতে পারতো। এই ছেলেটাকে তিনি খুব পছন্দ করেন। তার মত নিবেদিত প্রাণ ডাক্তার শুভপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এসেছে বলে তিনি মনে করতে পারেন না। তবে ইয়াকুব সাহেবের ধারণা তরুণ ডাক্তার বলে সে রোগীদের এতটা যত্ন নিয়ে দেখে। বয়স হলে এই সেবার মানসিকতা থাকবে না এটা তিনি চোখ বন্ধ করে লিখে দিতে পারেন। কিন্তু সমস্যা হল মামুনকে এখন ডাকতে পাঠানো যাবে না। আজ তার একজন ডাক্তার বন্ধুর আসার কথা। এইসব কিছুই ইয়াকুব সাহেব জানেন। শুধু জানেনই না, তিনিই মামুনকে অনুরোধ করেছিলেন তার বন্ধু তানভীরকে শুভপুর আসতে বলার জন্য। এর পিছনের কারণটা তিনি মনে করতে চান না। তিনি ফিশারের দাবার চাল বুঝতে না পারলেও জীবনের খেলার চাল কারো থেকে কম বোঝেন না। আজ টানা ১৫ বছর ধরে তিনি শুভপুরের চেয়ারম্যান এমনি এমনি হননি। এইসব ভাবতে ভাবতে যখন তিনি দাবার বোর্ড উঠিয়ে রাখবেন বলে ঠিক করেছেন তখনি তার চোখ চলে গেল বাইরের বারান্দায়। এতক্ষন ওখানে তার বড় মেয়ে লুনা দাঁড়ানো ছিল। এখন কেউ নেই। লুনা যে ঘরের ভিতরে যায়নি তা তিনি নিশ্চিত। কারণ ঘরের ভিতরে যেতে হলে লুনাকে তার সামনে দিয়ে যেতে হবে। ইয়াকুব সাহেবের ভ্রু আবার কুঁচকে গেছে। দাবার বোর্ড রেখে তিনি বারান্দার দিকে পা বাড়ালেন। ঘড়ির কাটায় রাত সাড়ে ৯টা। বাইরে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। চারিদিক অন্ধকার। ইয়াকুব সাহেব প্রচন্ড অবাক হয়ে দেখলেন লুনা এই প্রবল বৃষ্টির মধ্যে উঠোনে দাঁড়িয়ে ভিজছে। মেয়েকে ডাকতে যেয়েও তিনি থেমে গেলেন। একটা কণ্ঠ তার মাথার মধ্যে বলে গেল ‘বাবা আমি ঠিক পনের মিনিট পরে উঠে আসবো। তুমি ভিতরে যেয়ে দাবার বোর্ডের কাছে যাও। ফিশার সাহেব খুব গভীর জলের মাছ। সে মন্ত্রী বির্সজন দিয়ে মিখাইল তালের নৌকাকে রাজার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গেল। একটু পরেই দেখবে দুই হাতি আর নৌকা নিয়ে সে কিস্তিমাত করে দেবে’। এই ঠান্ডার মধ্যেও ইয়াকুব সাহেব ঘেমে গেলেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারলেন এই কণ্ঠ আর কারো নয়। তার অতি আদরের বড় মেয়ে লুনার। ঘরের ভিতরে এসে ইয়াকুব সাহেব দাবার বোর্ডের কাছেও গেলেন না। আরাম কেদারায় গা এলিয়ে দিয়ে মতিকে ডেকে বললেন কাল বিকেলে যেয়ে ডাক্তার মামুনকে তার বন্ধু সহ রাতে তার বাসায় খাবার কথা বলে আসতে।

 

‘শুভপুরে স্বাগতম ডাক্তার তানভীর’- এই কথার মধ্যে ডুবে থাকা ভাবটা কেটে গেল হাসমত ভাইয়ের চিৎকারে।

-স্যার তাড়াতাড়ি নামেন। সব ভিইজ্যা গেল তো।

আমার তখন হুশ হল যে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নেমেছে। কখন যে ভ্যান মামুনের কোয়ার্টারের সামনে এসে পরেছে আমি খেয়ালই করিনি। আমার সমস্ত মন আছন্ন ছিল মনের মধ্যে বেজে যাওয়া ঐ কথাটা নিয়ে। বড় দুই ব্যাগের একটাতে আমার জামা কাপড়। আর একটাতে শুধু বই। আমি আসার আগে মামুন আমাকে বইয়ের একটা বিশাল লিস্ট শুনিয়ে বলেছিল সবগুলো নিয়ে আসতে। এখন বৃষ্টিতে বইগুলো ভিজে গেলে এত কষ্ট করে এতদূর টেনে আনাটাই বৃথা। খুব দ্রুত হাসমত ভাইয়ের সাথে হাত লাগিয়ে ব্যাগগুলো টেনে কোয়ার্টারের বারান্দায় তুললাম। ততক্ষণে মামুনও নিচে নেমে এসেছে। উপরে উঠতে উঠতে মামুনের সাথে কথা বলছি।

-স্যরি দোস্ত, তোকে রিসিভ করতে যেতে পারলাম না। ইভনিং ডিউটি ছিল। আজ আবার হাসপাতালে আমি একা।

-কেন? তুই ছাড়া কি এখানে কোন ডাক্তার নেই নাকি? স্টেশনে নামার পর থেকে মনে হচ্ছে শুভপুরে ডাক্তার মামুন ছাড়া আর কোন ডাক্তারই নেই।

-তুই খুব খেপেছিস মনে হচ্ছে? মামুনের গলার স্বর বেশ ম্রিয়মান।

আমি বুঝলাম ওর মন খারাপ হয়েছে। হালকা স্বরে মুখে হাসি এনে বললাম – আরে নাহ। আমি তো ভালোমতই চলে এলাম। হাসমত ভাই যথেষ্ট সাহায্য করেছে। কোন সমস্যা হয়নি। আসলে স্টেশনে নামার পর থেকে শুধু তোর প্রসংসা শুনছি তো তাই ভাবলাম তুই ছাড়া কি কেউ নেই নাকি।

এবার মামুনের মুখে পরিচিত হাসি দেখা গেল। ‘না মানে আমি ছাড়া আরও দুজন ডাক্তার আছেন। তবে তারা কেউই এখানে নিয়মিত থাকেন না। ৭৫ বেডের হাসপাতাল বলতে গেলে আমিই চালাই। তবুও কোন সমস্যা ছিলনা। তোকে আনতে যেতেই পারতাম কিন্তু গতরাতে ভর্তি হওয়া ঐ পাগলীটার জন্য আর হাসপাতাল ছাড়তে পারলাম না।

-তোদের এখানে মেন্টাল ইউনিট আছে নাকি?? কি সমস্যা ওর?

-ধীরে বন্ধু ধীরে। নিজের পছন্দের ফিন্ডের রোগীর কথা শুনলে গায়ে ভেজা কাপড় আর ব্যাগ ভর্তি ভেজা বইয়ের কথাও ভুলে যেতে হবে নাকি?

আমার এমন হচ্ছে কেন আমি বুঝতে পারছি না। এখানে আসার পর থেকে স্নায়ু খুব বেশি উত্তেজিত হয়ে আছে। নাহ, মাথা ঠান্ডা রাখতে হবে। রুমের ভিতরে বসে আমি রিলাক্স হবার চিন্তা করছি। মামুন ব্যাগ খুলে বইগুলো বের করছে। বাইরে তুমুল বৃষ্টি। দোতলার জানালা দিয়ে সামনে যতদূর চোখ যায় ফাঁকা মাঠ। আমি উঠে জানালার ধারে গেলাম। কিছুদূরে একটা দোতলা বাড়ি। দেখেই চিনলাম এটা চেয়ারম্যান বাড়ি। ডানপাশে ঘন কালো অন্ধকার। ওখানে কি আছে তা দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎ একটা দমকা হাওয়া এসে আরও একবার আমাকে ভিজিয়ে দিয়ে গেল। সাথে সাথেই শুনলাম ঘন্টার টুং টাং শব্দ। পরিচিত চাইম বেলের মত নয়। বেশ ভারি ঘন্টার শব্দ বলে মনে হল। বুঝলাম ডান দিকের ঐ ঘন অন্ধকারে ছাওয়া জায়গাটায় আছে সেই পুরানো কালী মন্দির।

পিঠে মামুনের হাতের ছোঁয়ায় চমকে উঠলাম।

মৃদু হেসে মামুন তোয়ালে হাতে দিয়ে বললো – যা, গোসল করে আয়। খিচুড়ি ঠান্ডা হয়ে গেল। আমি ডিম ভাজতে বসলাম।

কোন কথা না বলে ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সাড়ে ন’টা।

 

মতি মিয়ার মেজাজ খুব খারাপ হয়ে আছে। রাত সাড়ে ৯টা মানে শুভপুরের মত জায়গায় অনেক রাত। তারমধ্যে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি পড়ছে। এই রাতে কোথায় তাড়াতাড়ি চারটা খেয়ে বউকে নিয়ে কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমাবে তা না সে এখন বসে আসে চেয়ারম্যান সাহেবের কাছারি ঘরে। চেয়ারম্যানের বড় মেয়ে লুনা বৃষ্টিতে ভিজছে। মতি লুনাকে ভয় পায়। শুধু ভয় পায় বললে ভুল হবে অসম্ভব ভয় পায়। সে পারত পক্ষে লুনার সামনে পরতে চায় না। জ্বীনে ধরা মেয়ে বলে কথা। চোখের দিকে তাকালেই কেমন করে মনের সব কথা জেনে যায় মেয়েটা। জ্বীন ছাড়া এইকাজ কোন মানুষের পক্ষে সম্ভব বলে মতি বিশ্বাস করেনা। আজ ২০টা বছর সে চেয়ারম্যানের বাড়িতে কাজ করে। সেই ছোট্ট বেলায় এসেছিল সে ইয়াকুব চেয়ারম্যানের বাড়িতে। এখন তার বয়স ৩৫।। জন্মাবার পর থেকেই সে লুনাকে দেখছে। মেয়েটা যত বড় হচ্ছে চেহারা যেন আরও খোলতাই হচ্ছে। লুনার মত সুন্দরী শুভপুর তো শুভপুর আসে পাশের দশ গ্রামেও আছে বলে মতির মনে হয় না। বছর দুয়েক হল লুনাকে জ্বীনে ধরেছে। এরপর থেকে মেয়ের রূপ দেখলে মতির ডর লাগে। তার নিজের বউ করিমন বিবিও কম সুন্দরী না। কিন্তু এই জ্বীনে ধরা মেয়ের কাছে সবাই নস্যি। এমনকি একই মায়ের পেটের ছোট বোন মুনাও লুনার মত এত সুন্দরী না। মতি জানালার ফাঁক দিয়ে লুনাকে দেখছে। বৃষ্টিতে ভেজা লুনাকে সে যতই দেখছে ততই তার নিজের ঘরে যাবার ইচ্ছা তীব্রতর হচ্ছে। মতি ভয় পাচ্ছে। নিজের মনের কথা বুঝতে পেরে প্রচন্ড ভয়ে সে কুকড়ে যাচ্ছে। আজকে কোনভাবেই লুনার সামনে পরা যাবে না। এই মেয়ে তার চোখের দিকে তাকালেই মনের বাজে ইচ্ছাটার কথা জেনে যাবে। তখন যদি জ্বীন দিয়ে তাকে ভয় দেখায় তাহলেই মতি শেষ। লুনার সাথে যে জ্বীন থাকে সে যেইসেই জ্বীন না। কেরামত ওঝার মত কাবিল লোক এই জ্বীন তাড়াতে পারেনি। অবশ্য কেরামত ওঝার শেষ অস্ত্র শুকনো মরিচের গুড়া আর ঝাড়ুর বাড়ি দিয়ে মন্ত্র চিকিৎসা ইয়াকুব চেয়ারম্যান করতে দেননি। তিনি এই জ্বীনের ব্যাপারটা বিশ্বাস করেন না। তাইতো মামুন ডাক্তারের মাধ্যমে তার বন্ধুকে শহর থেকে নিয়ে এসেছেন। এই লোক নাকি মনের ডাক্তার। মতি মিয়া অবশ্য নিশ্চিত যে এই নতুন ডাক্তার দুইদিনের দিনেই জ্বীনের হাতে তাড়া খেয়ে শুভুপর ছেড়ে চলে যাবে। জ্বীন-ভূতের চিকিৎসা কি আর ডাক্তার দিয়ে হয়? মতি মিয়া মনের মধ্যে একটা অস্থিরতা নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। নাহ, আজ করিমন বিবি রাতে না ঘুমিয়ে পরলেই হয়।

 

গোসলের জন্য বালতি থেকে পানি নিয়ে গায়ে ঢালতেই অসাধারণ একটা অনুভূতি হল আমার। বৃষ্টির কারণে পানির ট্যাংকের পানি বেশ ঠান্ডা হয়ে আছে। এই দীর্ঘ ভ্রমণের ক্লান্তি প্রতি মগ পানি ঢালার সাথে সাথে কমে যাচ্ছে। এরই মধ্যে নাকে ভেসে আসছে ডিম ভাজার গন্ধ। নাহ, খিদেটা এখন বেশ চাগিয়ে উঠেছে। তাড়াতাড়ি গোসল শেষে বের হয়ে দেখি দুটো প্লেটে খিচুড়ি আর ডিমভাজি বেড়ে মামুন গ্লাসে পানি ভরছে। বাইরে বৃষ্টি বেশ কমে এসেছে। তবে দূরের আকাশে মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমক ঠিকই দেখা যাচ্ছে। চারিদিক এখন কেমন যেন শান্ত একটা ভাব। ঘুমানোর জন্য খুবই চমৎকার একটা রাত। কিন্তু আমার মস্তিষ্ক বেশ উত্তেজিত হয়ে আছে। মামুনের কাছ থেকে ঐ মেয়ে সম্পর্কে জানার একটা তীব্র আকাঙ্ক্ষা কাজ করছে আমার মধ্যে। কথাটা ঠিক কীভাবে তুলবো তা বুঝতে পারছি না। এই ভাবনার মধ্যেই মামুন খেতে ডাকলো। আমরা খেতে বসলাম। হঠাৎ মামুন কথা শুরু করলো।

-তোকে যে বইগুলো আনতে বলেছিলাম তার মধ্যে মনে হয় দুটো বই আনিসনি।

-হুম। আসলে খুঁজে পাইনি। আচ্ছা মামুন, ভালো কথা, হঠাৎ তোর শরৎচন্দ্রের উপন্যাস সমগ্র পড়তে ইচ্ছা হল যে। আমি যতদূর জানি তুই তো এই ধরণের উপন্যাস পড়ার ধৈর্য্য রাখিস না।

চোখ না তুলেই মামুন মিনমিন করে বললো, ‘না, মানে বইটা আসলে আমার জন্য না’।

ভ্রু কুঁচকে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ‘তো কার জন্য?’

এইবার মামুন আমার দিকে তাকিয়ে, বেশ স্পষ্ট করে বললো, ‘তানভীর খাওয়া শেষ কর। আজ আর কিছু জিজ্ঞেস করিস না। আমি কাল সকালে ডিউটি থেকে এসে তোকে কিছু কথা বলবো। আসলে তোকে আমার এখন খুব দরকার ছিল। এজন্যই তোকে আসতে বলেছিলাম। আমি খুব খুশি হয়েছি তুই এসেছিস। তবে এই রাতে আমি তোকে কিছু বলবো না। তুই ক্লান্ত। খেয়ে ঘুম দে। সকালে আমি থাকব না। তবে সমস্যা নেই। বুয়া আছে। সকালে বুয়া এসে তোর নাস্তা বানিয়ে দেবে। তবে চা টা মনে হয় তোকে সামনের ঐ টং দোকান থেকে খেয়ে আসতে হবে। ঘরে টি ব্যাগ শেষ হয়ে গেছে’।

একসাথে এতগুলো কথা শুনে আমি পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করতে লাগলাম। আমার প্রবল কৌতুহল হলেও আর কিছু জিজ্ঞেস করা ঠিক হবেনা এখন। তবে মামুনের সিরিয়াসনেস দেখে বুঝতে বাকি থাকলো না যে সমস্যা যেটাই হোক আর যাকে নিয়েই হোক না কেন বিষয়টা মামুনের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ। চুপচাপ খাওয়া শেষ করে দিনের শেষ সিগারেটটা ধরালাম। মামুনের দিকে সিগারেট বাড়িয়ে দিতেই ঐ মৃদু হেসে বললো, ‘গত দু মাস হল ছেড়ে দিয়েছি’।

ওর কথা শুনে আমি আকাশ থেকে পরলাম। মামুনের মত সিগারেটখোর সিগারেট ছেড়ে দিয়েছে? আমি বিস্মিত হতেও মনে হচ্ছে ভুলে গেছি। চোখ বড় বড় করে ওর দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখে বোঝার চেষ্টা করলাম ব্যাপারটা কি। আমি মামুনের মধ্যে কিছু জিনিস খুব স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। ছেলেটা অনেক বিষন্ন হয়ে গেছে। চোখের নিচে কালি। হয়তো রাতে না ঘুমানোর জন্য। বেশ শুকিয়েও গেছে। চোখ দেখে মনে হচ্ছে প্রবল এক হতাশা ওর ভিতরের আনন্দগুলোকে গলাটিপে মেরে ফেলেছে। আমি এখন আর ওর বন্ধু হিসাবে ওকে দেখছি না। এখন আমি ওকে দেখছি একজন সাইকোলোজিস্টের চোখ দিয়ে। আমার পর্যবেক্ষন আমাকে বলছে এই মূহুর্তে মামুনের সাথে একজন খুব কাছের মানুষের থাকা খুব দরকার। মামুন একটা সমস্যায় পড়েছে এবং সমস্যাটা বেশ জটিল।

সিগারেট টানতে টানতে আমি আমার নিয়ে আসা বইগুলো খুঁজতে থাকলাম। হঠাৎ ভারী গলায় মামুন জিজ্ঞেস করলো, ‘তানভীর?’

-হুম। বল।

– তুই মনে হয় আমাকে বিশ্বাস করিসনি।

– কোন ব্যাপারে?

– ওই যে একটা মেয়ের কথা তোকে বলেছিলাম না যে মনের কথা বলে দিতে পারে।

আমার ভ্রু কুঁচকে গেল। মনে মনে ভাবছি সমস্যাটা কি তবে এই মেয়েটাকে নিয়ে। এই ব্যাপারে কিছু জিজ্ঞেস না করে শুকনো গলায় বললাম, ‘এরকম মনে হল কেন তোর?’

-মনে হবার কারণ তোর সঙ্গে করে নিয়ে আসা কিছু বই আর কার্ড।

আমি বেশ সহজ ভাবেই বললাম, ‘আসলে আমি তোর কথাকে গুরুত্ব দিয়েছি বলেই কিন্তু প্যারাসাইকোলজির বই দুটো আর জেনার কার্ড সাথে করে এনেছি’।

-তানভীর আমি সাইকোলজির ছাত্র না হলেও জেনার কার্ড দিয়ে কি দেখা হয় সেটা কিন্তু আমি জানি।

-তুই জানিস সেটা তো ভালই। তবে আমি আমার মত করে দেখতে চাই। তোর কি কোন সমস্যা আছে?

আমার গলার স্বরে হয়তো কিছুটা রুক্ষতা ছিল। মামুন বেশ আহত গলায় বললো, ‘আমার কোন সমস্যা নেই। তবে এটুকু বলতে পারি জেনার কার্ড লাগবে না’।

আমি এবার বেশ কোমল গলায় বললাম, ‘দেখ মামুন ব্যাপারটা কি তোর ব্যক্তিগত কিছু? মানে আমি যদি মেয়েটার ইএসপি পাওয়ার আছে কিনা টেস্ট করি তাহলে কি তুই মাইন্ড করবি?’

মামুন ধরা গলায় অন্যদিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি মাইন্ড করবো না তানভীর। তবে জেনার কার্ড লাগবে না এটা বলতে পারি। তুই ওর চোখের দিকে তাকালেই ও তোর সাথে কথা বলা শুরু করবে’।

কথার শেষটায় মামুনের কণ্ঠ রীতিমত কান্নাভেজা বলে মনে হল। প্রবল বিস্ময়ে আমি বুঝতে শুরু করলাম যে আমার খুব কাছের এই বন্ধুটি মানবিক আবেগে ভেসে চলেছে। সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ছুড়ে ফেলে আমি ঘড়ির দিকে তাকালাম। রাত সাড়ে এগারোটা। মামুনের কাছে যেয়ে ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম,

-‘মেয়েটাকে খুব বেশী ভালোবেসে ফেলেছিস না? কি নাম মেয়েটার?’

মামুন ধরা পরে যাওয়া অপরাধীর মত মাথা নিচু করে বললো, ‘চন্দ্রাবতীর আকর্ষণ এড়াতে পারলাম না তানভীর’।

-কি নাম বললি? চন্দ্রা কি?

আমার মুখের কথা শেষ হবার সাথে সাথেই নিশুতি রাতের নিরবতা ভেঙ্গে দিয়ে একটা নারী কণ্ঠ খিলখিল করে হেসে উঠলো। আমার সমস্ত অস্তিত্বকে দ্বিতীয়বারের মত নাড়িয়ে দিয়ে কে যেন মনের মধ্যে বলে উঠলো, ‘চন্দ্রাবতী নামটা খুব সুন্দর তাই না ডাক্তার তানভীর?’

আমি অস্ফুষ্টে বলে উঠলাম, কে কে?

হাসমত আলীর মত মামুনও ফিসফিস করে বলে উঠলো, ‘ও লুনা। ইয়াকুব চেয়ারম্যানের বড় মেয়ে’।

 

সকাল থেকেই মতি মিয়ার মেজাজ খুব খারাপ। সে এখন বসে আছে কেরামত ওঝার ঘরের বারান্দায়। অনেকক্ষন ধরেই বসে আছে। কিন্তু কেরামতের খবর নাই। তার এক সাগরেদ এসে বলে গেছে কেরামত নাকি ধ্যানে আছে। অপেক্ষা করতে হবে। ওদিকে মতির হাতে সময় কম। তাকে যেতে হবে সদর বাজারে। আজ হাটবার। তার উপর আজ চেয়ারম্যান বাড়িতে মেহমান আসবে। সকাল সকাল তাকে সেজন্য বাজারে যেতে হচ্ছে। মতি নিজের রাগ কমানোর চেষ্টা করছে। মেজাজ খারাপের শুরু অবশ্য গতরাত থেকে। সেই হিসাবে এই সকালে মেজাজ ভালো হয়ে যাবার কথা। কিন্তু তার ভালো হচ্ছে না। যতবার সে মেজাজ খারাপের ব্যাপারটা ভুলে যেতে চাইছে ততবেশি করে বিষয়টা তার মাথার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে। মেজাজ খারাপের কারণ তার হিসাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘটনা গতরাতের হলেও এখনো সে তা ভুলতে পারেনি। গতরাতে চেয়ারম্যানের বাসার সব কাজ শেষ করে ঘরে এসে দেখে তার বউ করিমন বিবি নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। দেখেই মতির মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। সে জানে এখন হাজার চেষ্টা করলেও করিমনের ঘুম ভাঙবে না। চেয়ারম্যানের বাড়ির খুব কাছেই তার ঘর। চেয়ারম্যানের জমির উপরেই। ঘর থেকে একটু দূরেই পুরানো কালি মন্দির। সেই মন্দির লাগোয়া ডোবা থেকে ব্যাঙের ডাক ভেসে আসছে। মতি ভাবে বৃষ্টির উন্মাদনায় ব্যাঙের মত জীবও স্ত্রী মিলনের জন্য ডাকতে ডাকতে পাগল হয়ে যাচ্ছে আর সে মানুষ হয়েও এই বাদলা রাতে ঘুমন্ত বউ এর দিকে তাকিয়ে থেকে রাত পার করছে। মতি মনে মনে বউকে গালি দিয়ে বলে, ‘মাগী ভাতার জাগনা রাইখ্যা ঘুমাইতেছেন’ এরপর সে চুপ করে বউ এর পাশে শুয়ে পরে। রাত অনেক হলেও মতির চোখে ঘুম নেই। তার শরীর জেগে আছে। শরীর জেগে থাকলে কোন প্রাণী ঘুমাতে পারেনা তা সে মানুষ হোক কিংবা ব্যাঙ, পুরুষ হোক বা নারী। মতি ঘুমাতে পারছে না। বউ এর উপর তার প্রচন্ড রাগ হচ্ছে। চোখ বন্ধ করলেই সে দেখতে পাচ্ছে লুনার বৃষ্টি ভেজা শরীর। গায়ের সাথে পরনের কাপড় লেপ্টে আছে। মতি উসখুস করছে। তার শরীর প্রবলভাবে জেগে যাচ্ছে। সে কল্পনা করছে লুনাকে। কোন একদিন সে তার এই কল্পনা বাস্তবে পরিণত করবে। লুনার উপর তার অনেক রাগ। এই মেয়ের জন্য চেয়ারম্যানের কাছে সে অনেক গালমন্দ সহ্য করেছে। জ্বীনে ধরার আগে লুনা এমন ছিল না। কিন্তু জ্বীনে ধরার পর থেকেই সে সবার মনের কথা কীভবে জানি জেনে ফেলে। মতি যে বাজারের টাকা মাঝে মাঝেই এদিক সেদিক করে সেটা এই লুনাই তার বাবাকে বলেছে। মতি লুনাকে প্রচন্ড ভয় করলেও সে তাকে একটা শিক্ষা দেবার কথা আগে থেকেই ভেবেছে। জায়গাও মনে মনে ঠিক করে রাখা আছে। কালী মন্দিরে কাজ সেরে পাশের ডোবার মধ্যে ফেলে দিলেই হল। সবাই জানে জ্বীনে ধরা মাইয়া। ভাবতে ভাবতে মতির তন্দ্রা মত এসেছিল। হঠাৎ সে শুনতে পায় কে যেন তাকে ডাকছে। তার মাথার মধ্যে কে যেন বলছে ‘মতি মিয়া সাবধান। আর কোনদিন আমাকে এই নজরে দেখলে কালী মন্দিরের ডোবায় পুতে ফেলবো’। মতির  শরীর অবশ হয়ে আসছে। বৃষ্টি ভেজা এই শীতের রাতেও তার সারা শরীর দরদর করে ঘামছে। নিজের বুকের ধুকধুক শব্দ সে নিজের কানেই শুনতে পাচ্ছে। কোনরকমে তার জানা সব দোয়া দুরূদ পরে সে বুকে ফুঁ দেয়। শব্দটা যেমন হঠাৎ করেই এসেছিল ঠিক তেমন হঠাৎ করেই চলে গেল। ঠিক তারপরই সে শুনলো লুনার কণ্ঠের খিলখিল হাসি। মতি রাতের বেলা আরও একটা সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কাল যে করেই হোক সে কেরামত ওঝার সাথে দেখা করে একটা শক্ত তাবিজ ধারণ করবে। সে কারণেই এখন সে কেরামতের বাড়িতে এতক্ষণ অপেক্ষা করে আছে। আজ তাকে তাবিজ নিতেই হবে। সকালবেলা অবশ্য সে একটা ভালো খবরও শুনেছে। ইয়াকুব চেয়ারম্যানকে এলাকার এমপি সাহেব ঢাকায় ডেকে পাঠিয়েছেন। খুব জরুরী দরকার। তারমানে প্রায় তিনদিনের জন্য চেয়ারম্যান বাড়ির বাইরে। ঘরে থাকবে মেয়ে দুইটা আর তাদের মা। এতদিনের বিশ্বস্ত বাসার কাজের লোক হিসাবে মতির উপরে চেয়ারম্যানের অগাধ আস্থা। এলাকায় ইয়াকুব চেয়ারম্যানের কোন ক্ষতি কেউ কোনদিন করবে না এটা সবাই খুব ভালো করেই জানে। মতির জন্য এটাই খুব ভালো সুযোগ। চাপা উত্তেজনায় মতির ভিতরটা যেমন টগবগ করে ফুটছে তেমনি ভয় জিনিসটাও কম নেই। তার শুধু একটাই ভয়। জ্বীন যেন তার কাছে আসতে না পারে। এইজন্য কেরামতের কাছ থেকে সে শরীর বন্ধ করার তাবিজ নেবে। এই তাবিজের দাম সে বাজারের টাকা থেকেই সরাবে বলে ঠিক করেছে।

অবশেষে কেরামত ওঝার সময় হল।

-ক্যাডা? মতি মিয়া না?

-হ। কেরামত ভাই। ইট্টু কাম আছিল

-কি কাম? চেয়ারম্যানের মাইয়ারে আবার দেখতে যাওন লাগবো নি? আমি তো কইছিই চান্দের মাসের ১২ তারিখ রাইতের কালে ঝাড়ু পিটা আর শুকনা মরিচের গুড়া নাকে ডলা দেওন ছাড়া ঐ জ্বীন যাইতো না।

-না এর লাইগ্যা আসি নাই কেরামত ভাই। ইট্টু কামডা হইলো আমারে অক্ষন একটা শইল বান্ধন তাবিজ দেওন লাগবো।

-ক্যা? তোমার আবার কি হইছে?

-আর কইয়ো না। কাইল রাইতে খুব খারাব খোয়াব দেখছি। আর তাছাড়া সারাডা দিনতো ঐ বাড়িত্তেই থাকতে হয়। তাই একটা তাবিজ যদি দিতা।

-দিবার পারি তই ৭০ ট্যাকা লাগবো। ২০ ট্যাকা অহন দিবা। বাকিডা পরশু হাটের পর দিয়া তাবিজ নিয়া যাইবা।

-ক্যা? পরশু ক্যা? আইজ দিবার পারবা না?

কথার এই পর্যায়ে কেরামত ওঝা বিরক্ত হয়ে ওঠে। সে অবশ্য ইচ্ছা করলে এখনি মতিকে তাবিজ দিতে পারে। কিন্তু তাহলে মতির কাছে তার দাম কমে যাবে। সেজন্যই সে ভ্রু কুঁচকে মতির দিকে সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করে-

-ক্যারে মতি, ডর বেশী লাগছে নাকি?

ঐ দৃষ্টির সামনে মতি কুকড়ে যায়। সে আমতা আমতা করে বলে, – না আসলে, আইচ্ছা পরশুই নিমু। দুইদিনে আর কি হইবো। এই লও ২০ ট্যাকা।

নিতান্ত অনিচ্ছার একটা ভংগি করে টাকা নেয় কেরামত। তারপর উদাস গলায় বলে – বুঝলানি মতি মিয়া, এইসব তাবিজ দিতে বহুত মেহনত করতে হয়। অনেক কিছু যোগাড়-যন্ত্র কইরা তারপর না তাবিজ বানাই। তুমি পরশু সন্ধ্যা কালে আইসো।

মাথা ঝাকিয়ে মতি আর দাঁড়ায় না। এমনিতেই তার অনেক দেরী হয়ে গেছে। সূর্য্য মাথার উপরে উঠলো বলে। চেয়ারম্যান নিশ্চয় আজ তাকে আবার বকা দেবে। সবথেকে বড় কথা বাজার করে ফিরে কোনভাবেই লুনার মুখোমুখি হওয়া যাবে না। মনের মধ্যে একটা অদ্ভুত আনন্দ নিয়ে মতি বাজারের পথ ধরে।

 

মুনার মন আজকে বেশ খারাপ। শুধু বেশ খারাপে আসলে ঠিক বুঝানো যাবে না। তার মন অসম্ভব খারাপ। আজকে সে মাত্র দুই পিরিয়ড করেই চলে এসেছে। বাসায় এসে নিজের ঘরে ঢুকে বালিশে মাথা গুঁজে ইচ্ছামত কেঁদেছে। গত দুইবছর ধরে মাঝে মাঝেই সে এইভাবে ক্লাস থেকে চলে আসে মন খারাপ করে। তবে আজকের মত এতটা কষ্ট সে এর আগে পায়নি। আজ ক্লাসে খুব বাজে একটা ঘটনা হয়েছে ওর সাথে। চেয়ারম্যানের মেয়ে হিসাবে তাকে কেউ সরাসরি অপমান করতে সাহস পায় না। তবে আঁকারে ইংগিতে তাকে ক্লাসে সবাই জ্বীনের শালী বলে খেপায়। লুনাকে জ্বীনে ধরার খবরটা যখন থেকে গ্রামের সবাই জেনে গেছে তার কিছুদিন পর থেকেই শুরু হয়েছে এই অত্যাচার। সে টিচারদের কাছে নালিশ দিলেও কিছু হয় না কারণ সে ঘটনা প্রমাণ করতে পারেনা। প্রথম দিকে টিচাররা এসে ক্লাশের অন্যান্যদেরকে বকা দিয়ে যেত এখন তাও যায় না। অনেকদিন থেকে চলে আসা এই মানসিক যন্ত্রণা নিয়েই সে ক্লাশ করে। কিন্তু আজকের ব্যাপারটা খুব বিশ্রী পর্যায়ে চলে গেছে। আজ সেকেন্ড পিরিয়ডের পরে টিচার না আসায় ওরা ক্লাসে মজা করছিলো। এমন সময় জেসমিন এসে ওকে একটু দূরে ডেকে নিয়ে গেল। ও যাবার সাথে সাথে আরও তিনজন মেয়ে এসে উপস্থিত। জেসমিন ওকে বললো – ‘মুনা একটা কথা জিজ্ঞেস করবো। তুই কিন্তু কিছু মনে করতে পারবি না’।

-কি কথা?

এই সময় হামিদা একটু ইতস্তত করে বললো, ‘না মানে আমাদের অনেক কৌতুহল লুনা আপাকে নিয়ে। আপা নাকি চোখের দিকে তাকালেই মনের কথা বলে দিতে পারে?’

মুনা আসলে বুঝতে পারছে না ওরা কি জানতে চাচ্ছে। তবুও নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, ‘সবারটা পারে কিনা জানি না। তবে আমাদের বাসার সবারটা পারে’।

ভ্রু কুঁচকে সাবিহা জিজ্ঞেস করলো, ‘উনি কি সবসময় সবার দিকে তাকিয়ে গড়গড় করে মনের কথা বলতে শুরু করেন নাকি? তাহলে তো খুব সমস্যা। উনার যদি কোনদিন বিয়ে হয় তাহলে তো বরকে কিছুই বলতে হবে না। তার আগেই উনি রেডি হয়ে যাবেন’।

এই কথা শোনার সাথে সাথে সবাই মুখ টিপে হাসা শুরু করলো। মুনার চোখ ফেটে কান্না পাচ্ছে। কিন্তু সবাই তাকে ঘিরে রেখেছে বলে সে যেতেও পারছে না। সে মুখ শক্ত করে উত্তর দিল – ‘আপু সবসময় এমন করে না। যখন তার ইচ্ছা হয় তখন করে’।

মুখ বাকিয়ে হামিদা বললো ‘ ও’।

হঠাৎ জেসমিন ওর হাত ধরে বললো, ‘দেখ মুনা আমরা তোর খুব ভালো বান্ধবী তাই না। অনেকদিন থেকেই আমরা একটা কথা শুনেছি আর তোকে জিজ্ঞেস করবো বলেও ভেবেছি। কিন্তু কখনো করিনি। আজকে না করে পারছিই না’।

চোখ সরু করে মুনা জিজ্ঞেস করে, ‘কি শুনেছিস তোরা?’

সাবিহা মিনমিন করে বলে ‘না মানে আমরা বিশ্বাস করি না। তবুও জানতে ইচ্ছা হয় আর কি’।

এবার আর সহ্য হয়না মুনার। কঠিন করে বলে ওঠে ‘তোরা যা জিজ্ঞেস করবি সরাসরি জিজ্ঞেস কর। এত বাঁকা কথা বলার মানে কি?’

জেসমিন আরও মিহি স্বরে গলা একদম খাঁদে নামিয়ে মুনার কানের পাশে মুখ নিয়ে জিজ্ঞেস করে – ‘আমরা তো শুনেছিলাম লুনাপা কে ক্লাশ সেভেনে পড়ার সময় একরাতে যে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না সেটার কারণ নাকি জ্বীন তাকে উঠিয়ে তার দেশে নিয়ে গেছিল। তারপর নাকি তার সাথে ইয়ে করে সকালে ওই কালি মন্দিরের উঠোনে ফেলে রাখে। তা লুনাপা কি তোকে কখনো বলেছে যে মানে জ্বীনের সাথে তার ইয়ে মানে রাত কেমন কেটেছিল?’

মুনার কান লাল হয়ে আগুনের মত হয়ে গেল। নিজের বোন সম্পর্কে এইকথা শোনার পর সে এক চিৎকার দিয়ে ছুটে ক্লাস থেকে বের হয়ে গেল । বের হবার সময় সে পিছনে ওই মেয়েগুলোর হাসির শব্দ শুনতে পাচ্ছে । রাগে, দুঃখে, ক্ষোভে তার দুচোখ পানিতে ভরে যাচ্ছে। এলোমেলো পা ফেলে বাসায় এসে কোন রকমে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে বালিশ মাথায় নিয়ে সে অনেকক্ষন কাঁদল। কান্নার সময়ই সে ভেবে রেখেছে আজ মা কে জিজ্ঞেস করবে সেই রাতে আসলে কি হয়েছিল। নাহ, মা কে না। সে সরাসরি আপুকেই জিজ্ঞেস করবে। যদিও কোনদিন সে এই বিষয়ে লুনাকে কিচ্ছু জিজ্ঞেস করেনি। কিন্তু আজ তাকে করতেই হবে। জেসমিনদের মুখের উপর একটা জবাব না দেয়া পর্যন্ত সে শান্তি পাবেনা। মুনা ঠিক করলো রাতে ঘুমানোর সময় সে লুনাকে জিজ্ঞেস করবে।

 

সকালে ঘুম ভাঙলো বেশ বেলা করে। ঘুম থেকে উঠে এককাপ চা না হলে আমার দিন শুরু করা কষ্ট হয়ে যায়। বিছানাতে শুয়ে শুয়েই চায়ের চিন্তা করছি। মোবাইলে তাকিয়ে দেখি সাড়ে ১১টা। ওরেব্বাস এতটা লম্বা সময় ঘুমালাম কি করে আমি। হঠাৎ মনে পরলো সকালে কাজের বুয়ার এসে নাস্তা বানানোর কথা। সাথে সাথে মনে পরে গেল কাল রাতের ঘটনা। মামুন আজ দুপুরে এসে আমাকে বলবে ওর চন্দ্রাবতীর ইতিহাস। মামুনের জন্য কেমন যেন একটা দুঃখ কাজ করছে আমার মনে। বেচারা এই বিসিএসের চাকরীতে এসে নিজেকে কি এক বাঁধনে যে বেঁধে ফেললো। ভাবতে ভাবতে বিছানা ছেড়ে ফ্রেস হয়ে চেয়ারে বসলাম। অনেকদিন পর সকালটা কেমন যেন চুপচাপ লাগছে। কিছু একটা মিস করছি আমি। কিন্তু কি? ভাবছি আর এলোমেলো ভাবে টেবিলের বইগুলো দেখছি। হঠাৎ চোখ পরলো একটা ডায়রির দিকে। মামুন ডায়রি লেখে জানতাম। আমার এই মূহুর্তে একটা খারাপ কাজ করতে ইচ্ছা করছে। অন্যের ব্যক্তিগত ডায়রি পড়া একেবারেই অনুচিত। কিন্তু প্রবল আগ্রহের কাছে উচিত-অনুচিত বোধ পরাজিত হল। আমি ডায়রি হাতে নিলাম। পড়া শুরু করতে যাবো এমন সময় মাথায় আসলো যে, যে জিনিসটা আমি মিস করছি তা হচ্ছে গাড়ির হর্ন। উত্তরটা পেয়ে বেশ খুশি মনেই ডায়রি খুলে বসলাম।

অর্ধেকটা পড়া যখন শেষ হল তখন দুপুর ২টা বাজে। এই সময়টাতে ডায়রির প্রতিটি পাতায় আমি আমার বন্ধুটিকে খুঁজে পেয়েছি এক অসহায় মানুষ হিসাবে। যে মানুষ প্রবল ভালোবাসা নিয়ে তার কাঙ্ক্ষিত নারীর জন্য অপেক্ষা করে যাচ্ছে অথচ তাকে বলতে পারছে না। যে পুরুষ মাঝে মাঝেই তার অতি আকাঙ্ক্ষিত রমণীর সান্নিধ্য পাচ্ছে কিন্তু তাকে নিজের ভাবতে পারছে না। জীবনের এই দোলাচলে একজন মামুন তার চন্দ্রাবতীর জন্য ডায়রির পাতায় ভালোবাসার কাব্য রচনা করে। কিন্তু সেই কাব্যের ছন্দ মেলানোর জন্য চন্দ্রাবতী আসেনা। কোনদিন আসবে কিনা মামুন নিজেও জানে না। এক অসম, একপক্ষীয় ভালোবাসার উত্তাপে পুড়ে আমার বন্ধুটি প্রতিনিয়ত ছাই হচ্ছে কিন্তু কিছু করতে পারছে না। পুরো ব্যাপারটা এতটা জটিল তা এই ডায়রি না পড়লে আমি বুঝতে পারতাম না। আবেগের ব্যাপারটা আমাকে স্পর্শ করে গেছে বেশ ভালোভাবেই। তবে তারথেকেও আমাকে যে বিষয়টি বেশী ভাবিয়ে তুলেছে তা হল চন্দ্রাবতীর আচরণ, তার ক্ষমতা এবং অতি অবশ্যই তার রহস্যময়তা। কিছু কিছু ঘটনার কথা জেনে আমি প্রচন্ডভাবে অবাক হয়েছি। সেইসাথে বেশ কিছু প্রশ্ন জমা হয়ে আছে মনের মধ্যে। মামুনকে জিজ্ঞেস করে যার উত্তরগুলো জানা খুব জরুরী।

ডায়রি বন্ধ করে জানালা দিয়ে আনমনে বাইরে তাকিয়ে আছি। দূরে বেশ ঘন জঙ্গলে ঢাকা একটা জায়গা দেখা যাচ্ছে। একটু ভালো করে তাকালে সেখানে একটা ভাঙা স্থাপনা দেখা যায়। এটাই হয়তো সেই বহু পুরানো কালী মন্দির। কোন কারণ ছাড়াই মন্দিরটা দেখার একটা আগ্রহ বোধ করছি আমি। জানালার ওপাশে তপ্ত দুপুরের আঁচ। একটা কাক অনেকক্ষন ধরেই একনাগাড়ে চিৎকার করে যাচ্ছে। শহুরে কোলাহলে অভ্যস্ত আমি গ্রামের এই নির্জনতায় বড় বেশী আচ্ছন্ন হয়ে গেছি। ঘোর লাগা দুপুরে শুভপুরে আমার প্রথম দিনে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম মামুনকে এই সমস্যা থেকে বের করে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করে যাবো। সাথে করে নিয়ে আসা শন নিকোলাস এর অসাধারণ বই মাইন্ড রিডিং খুলে বসলাম। নিজেকে একটু গুছিয়ে নিতে হবে। জেনার কার্ডের প্যাকেট টা শক্ত করে ধরে মনে মনে বললাম ‘চন্দ্রাবতী, আমি আসছি’।

 

মতি মিয়া ভয় পেয়েছে। প্রচন্ড ভয়ে তার শরীর কাঁপছে। চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাবার পর থেকেই তার ভয় পাওয়া শুরু হয়েছে। কোন রকমে বাজার নামিয়ে হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে সে এক দৌড়ে নিজের বাসায় এসে বসে আছে। করিমন বিবিও বাসায় নাই। সে গেছে চেয়ারম্যানের বাড়িতে রান্নার কাজে সাহায্য করতে। বাসায় মতি একা। সে প্রাণপনে দোয়া দুরুদের বই খুঁজছে। ঘরে জানালার উপরের তাকে থাকার কথা। সে পড়তে জানেনা। তবুও তার ভরসা দোয়া দুরুদের বই হাতে রাখলে জ্বীন তার কোন ক্ষতি করবে না। সে ঠিক করেছে বিকালের আগে সে আর চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাবে না। ভর দুপুরে জ্বীনেরা বের হয় এইকথা সে শুনেছে কেরামত ওঝার মুখে। দোয়ার বই হাতে নিয়ে মতি বিছানায় উঠে বসে। সে এখন বেশ খানিকটা স্বস্তি পাচ্ছে। উফফ কি ভয়টাই না সে পেয়েছিল। মতি মনে করতে চায় না। তবুও তার মনে পরে যায়। সে বাজার নিয়ে খুশি মনেই আসছিল। আজ বেশ বড় একটা মাছ কিনেছে। দাম পড়েছে ৯০০ টাকা। ঠিক করে রেখেছিল সে বলবে ১১০০ টাকা। ২০০ টাকার ৭০ টাকা কেরামতকে দিলেও তার কাছে আরও ১৩০ টাকা থাকবে। এই আনন্দে সে ভুলেই গিয়েছিল লুনার কথা। বাড়ির কাছাকাছি এসে সে ভেবেছিল এই দুপুর বেলা লুনা নিশ্চয় সামনের উঠানে থাকবে না। তার ইচ্ছা ছিল সামনের উঠোন থেকে করিমনকে ডাক দিয়ে বাজার দিয়ে সে নিশ্চিন্ত হবে। কিন্তু আজ তার ভাগ্যটাই খারাপ। সদর দরজা দিয়ে ঢুকতেই দেখে লুনা উঠোনে দাঁড়িয়ে আছে পূবের দিকে চোখ রেখে। পূব পাশে সেই পুরানো কালী মন্দির। মতি খুব সাবধানে লুনাকে পাশ কাটিয়ে যাবার সময় লুনা তার দিকে ফিরে স্পষ্ট গলায় বললো, ‘২০০ টাকা দিয়া কি করবা মতি মিয়া?’ ভয়ে মতির ভিতরটা শুকিয়ে কাঠ। সে তোতলাতে তোতলাতে বললো, ‘আআআআআফফা, যে ক্কক্ককি কন?’

ঠোঁটের কোণায় একটা বাঁকা হাসি এনে লুনা বললো, ‘কি বলি বুঝনা মতি মিয়া? বুঝবা। তাবিজ নিতেছো? কিচ্ছু হবেনা। তোমার বাঁচন নাই মতি। তুমি আমার শরীরে নজর দিছো। তোমার বাঁচন নাই’।

মতি কোন রকমে ভিতরের রুমে যাবার সময় আড়চোখে দেখলো রাগে লুনার চোখ আগুনের মত জ্বলছে। ওই চোখ দেখে মতি আর একটুও দাড়ায়নি। করিমনের কাছে বাজার রেখে সে চেয়ারম্যানের কাছে হিসাব দিয়েই একছুটে নিজের বাসায় চলে এসেছে। আসার সময় সে শুনতে পাচ্ছিল এই ভর দুপুরে খোলা চুলে উঠোনে দাঁড়িয়ে লুনা খিল খিল করে হাসছে। মতি সিদ্ধান্ত নিল সে আবার কেরামতের কাছে যাবে। দরকার হলে ১০০ টাকা দিয়ে হলেও সে আজই তাবিজ নিয়ে আসবে।

 

ইয়াকুব সাহেব বিষন্ন মনে বারান্দায় বসে আছেন। দুপুর গড়িয়ে এখন প্রায় বিকেল। মতি এখনো আসেনি। আজ বাসায় এত কাজ অথচ হারামজাদা নিজের ঘরে গিয়ে বসে আছে। অবশ্য মতির বউ রান্নার ব্যাপারটা ভালোই সামাল দিচ্ছে। ইয়াকুব সাহেব নিজে বেশীদূর লেখাপড়া করেননি। কোনরকমে টেনে টুনে থার্ড ডিভিশনে ইন্টার পাশ করেছেন। এরপরে লেখাপড়া ছেড়েছেন। তবে শিক্ষা আর শিক্ষিত মানুষের গুনের কদর তিনি সবসময় করে এসেছেন। ডাক্তার মামুনকে তিনি একদিকে যথেষ্ট স্নেহ করেন আবার ডাক্তার হিসাবে সম্মানও করেন। মামুনের কাছেই তিনি শুনেছিলেন তার বন্ধু তানভীরের গল্প। ছেলেটা নাকি বেশ ভালো সাইকোলজিস্ট। তারপর থেকেই তিনি ভেবেছেন একবার শেষ চেষ্টা করবেন লুনার ব্যাপারে। মেয়েটাকে জ্বীনে ধরেছে বিষয়টা তিনি আগেও মানেননি এবং এখনো মানেন না। লুনার ভয়াবহ কোন মানসিক সমস্যা আছে বাবা হিসাবে এটা তার দৃঢ় বিশ্বাস। ইয়াকুব সাহেব ভাবছেন, চেষ্টা তো কম করেননি। ঢাকার নামকরা ডাক্তার দেখিয়েছেন। যে যা বলেছে তাই করেছেন। এমনকি শেষ পর্যন্ত নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে হলেও কেরামতকে ডেকেছেন। কোন লাভ হয়নি। মেয়েটা কেন এমন হয়ে গেল সেটার কারণ তিনি জানেন। সেই রাতের ঘটনা আজো তার চোখের সামনে ভাসে। ইয়াকুব সাহেব চোখ বন্ধ করলেন। ফিরে গেলেন লুনার ১৬ বছর বয়সের সেই সময়টাতে।

বৈশাখের এক অন্ধকার রাত। প্রচন্ড গরম পড়েছিল সে রাতে। রাত সাড়ে ৯টায় বাসায় এসে তিনি শুনলেন লুনা বাড়িতে নেই। ছোট মেয়ে মুনা বললো, ‘আপু তো সন্ধ্যার একটু পরে মর্জিনাদের বাসায় গেছে। চলে আসবে হয়তো এখুনি’। ইয়াকুব সাহেব কিছু না বলে মতিকে পাঠালেন লুনাকে ডেকে আনতে। কিছুক্ষণ পর মতি হাঁপাতে হাঁপাতে দৌড়ে এসে যা বললো তা শুনে ইয়াকুব সাহেব বিচলিত হয়ে উঠলেন। লুনা নাকি অনেকক্ষণ আগেই মর্জিনাদের বাসা থেকে বের হয়ে গেছে। ১৬ বছরের একটা মেয়ে এখনো বাসায় আসেনি। ইয়াকুব সাহেব তার ৬ ব্যাটারির টর্চ নিয়ে লুনাকে খুঁজতে বের হলেন। তন্ন তন্ন করে পুরো গ্রাম খুঁজলেন। একা খুঁজলেন না। পুরো গ্রামের লোকজন খুঁজে বেড়ালো লুনাকে। লুনা নেই। কোথাও নেই। জলজ্যান্ত একটা মেয়ে যেন শুভপুর থেকে হাওয়া হয়ে গেল। থানার ওসি ছুটে আসলেন খবর পেয়ে। সম্ভাব্য সব কিছু করা হল। তবুও লুনাকে পাওয়া গেল না। লুনার মা ভয়ে আর আতঙ্কে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হল। দল বেঁধে অনেকে শুভপুরের বাইরেও গেল লুনাকে খুঁজতে। কিন্তু লুনা নেই। সেই রাতে ইয়াকুব সাহেব সারারাত বারান্দায় আর উঠোনে পায়চারি করলেন। আল্লাহর কাছে কেঁদে কেটে মেয়েকে ফিরে চাইলেন। মসজিদের মাইকে অনেকবার ঘোষণা দেয়া হল। কিন্তু লুনা নেই। কেউ খেয়াল করলো না যে শুধু লুনা না, বেপারি বাড়ির বড় ছেলে বাবলুও নেই। আরেকটা জিনিস কেউ করলো না। সাহস করে কেউ ভাঙ্গা কালী মন্দিরের ভিতরে খোঁজ করে দেখলো না।

 

ভোর না হতেই ইয়াকুব সাহেব আবার ছুটলেন। কিছুক্ষণ পর তার সামনে পরলো নসিমন পাগলী। সে ইয়াকুব সাহেবকে শুধু বললো, ‘চেয়ারম্যান, একবার কালী মন্দিরে যাইয়া দেখো’। বলেই আর দাঁড়ালো না। ইয়াকুব সাহেব মতি আর জনা সাতেক লোক নিয়ে কালী মন্দিরে ছুটলেন। জংলা পেরিয়ে মন্দিরের উঠোনে যেয়ে তার চোখ কপালে উঠলো। লুনা মন্দিরের উঠোনে পড়ে আছে। কপালের ঠিক ডান পাশে একটা কাটা দাগ। পরনের কাপড় ছিন্নভিন্ন। তাতে উরুর কাছে রক্তের দাগ। ইয়াকুব সাহেব ফুঁপিয়ে উঠলেন। থানা-পুলিশ হয়েছে। কিন্তু লুনাকে কেউ ধরে নিয়ে গিয়েছিল তা প্রমাণিত হয়নি। লুনার জ্ঞান ফেরার পর থেকে সে মানুষ দেখলে ভয়ে চিৎকার করে উঠতো। এজন্য তাকে ঠিকমত জিজ্ঞাসাবাদ ও করা যায়নি। ইয়াকুব সাহেব মেয়ে ফিরে পেয়ে জানের সদকা হিসাবে দুটো গরু জবাই করে সবাইকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে মেয়েক নিয়ে ঢাকায় চলে গেলেন চিকিৎসার জন্য। তিনটি মাস ঢাকায় থেকেও লুনার উন্নতি হল না। ডাক্তাররা শুধু জানালেন লুনা কোনভাবে একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা তাকে মানসিকভাবে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দিয়েছে। কি সেই অভিজ্ঞতা তা আজ পর্যন্ত তিনি জানতে পারেননি। গ্রামে ফিরে খুব ধীরে ধীরে লুনা পরিবারের মানুষদের সহ্য করতে শুরু করে। অনেকদিন চুপ থাকার পর একটু একটু কথা বলতে শুরু করে তার মায়ের সাথে। আস্তে আস্তে তার সাথে। মেয়ে স্বাভাবিক হয়ে যাচ্ছে ধরে নিয়ে ইয়াকুব সাহেব যখন একটু স্বস্তি বোধ করছেন ঠিক তখনি, আজ থেকে বছর দুই আগে মেয়ের মধ্যে অস্বাভাবিক শক্তির একটা আভাস তিনি পেতে শুরু করলেন। চোখের দিকে তাকিয়েই লুনা মনের কথা বলে দিতে শুরু করলো। ঘটনাটা প্রথম ঘটলো খাবার টেবিলে।

সে রাতে ইয়াকুব সাহেব খেতে বসেছেন মেয়েদেরকে নিয়ে। লুনার মা খাবার বেড়ে দিচ্ছে। ফুলকপি দিয়ে রুইমাছ ইয়াকুব সাহেবের খুব পছন্দের তরকারি। মাছের মাথাটা লুনার মা তার পাতে তুলে দিতে যাবার সময় লুনা বেশ গম্ভীর হয়ে বলে উঠলো ‘মা মাথাটা বাবাকে দিও না। মুনার খুব ইচ্ছা আজকে মাথাটা সে খাবে’। ইয়াকুব সাহেব ভ্রু কুঁচকে মেয়ের দিকে তাকালেন। তারপর হেসে ফেলে বললেন, ‘তাই নাকি? তাহলে ও লুনার মা মাথাটা মুনাকেই দাও’। মুনা খাওয়া বন্ধ করে তার বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। লুনা নির্বিকার ভাবে খেয়ে যাচ্ছে। ইয়াকুব সাহেব আবার জিজ্ঞেস করলেন, ‘মুনা কি তোমাকে এই কথা বলেছে আম্মু?’ লুনা তার চোখের দিকে তাকিয়ে বললো, ‘না বাবা, মুনা আমাকে বলেনি। আমি বুঝে নিয়েছি। ওর চোখের দিকে তাকিয়েই আমি সব বুঝে গেছি’।

ইয়াকুব সাহেব এটাকে লুনার ছেলেমানুষী মনে করে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আচ্ছা আচ্ছা। তুমি চোখ দেখেই বুঝেছো’। তার মুখের হাসির স্থায়িত্ব হল মাত্র ৩০ সেকেন্ডের মত। তাকে স্তব্ধ করে দিয়ে লুনা তার চোখের দিকে তাকিয়ে দৃঢ় গলায় বললো, ‘বাবা তুমি ভাবছো এটা ছেলেমানুষি। কিন্তু না। আমি সব বুঝতে পারি। যেভাবে আমি এখন বুঝতে পারছি তুমি হাসতে হাসতে খাওয়া দাওয়া করলেও রিলিফের ৫ বস্তা গম হিসাবে কম পরায় তুমি একটু চিন্তার মধ্যে আছো’।

ইয়াকুব সাহেব হা করে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। এই কথা তিনি জেনেছেন সন্ধ্যার একটু পরে। কাউকে তিনি একথা বলেননি। অথচ লুনা এই কথা বলে দিচ্ছে। তিনি প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে লুনার মায়ের দিকে তাকালেন। তার মুখ সাদা হয়ে গেছে। মুনা অবিশ্বাসী চোখে তার বোনের দিকে তাকিয়ে আছে। ইয়াকুব সাহেব ঘামছেন। তিনি স্পষ্ট বুঝতে পারছেন তার বড় মেয়ের সমস্যা কমেনি বরং সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা দিকে মোড় নিয়েছে। সেই রাতে রুই মাছের মাথাটা কেউ ছুয়েও দেখেনি।

মতি যখন কেরামত ওঝার বাড়ির কাছাকাছি তখন সূর্য ডুবু ডুবু করছে। দূর থেকে আযানের শব্দ শুনে মতি চলার গতি আরও বাড়িয়ে দিল। তার মনে ভয় ঢুকে গেছে। তাবিজ না নেয়া পর্যন্ত এই ভয় তার যাবে না। সে জামার পকেটে হাত দিয়ে টাকাটা শক্ত করে ধরে কেরামতের বাড়িতে ঢুকে পরলো। কেরামত বাড়ির উঠোনেই ছিল। মতিকে আসতে দেখে একটু অবাক হয়েই সে বললো –‘কি গো মতি, তোমার না পরশু আওনের কথা’।

-কেরামত ভাই, পরশু পারুম না। তুমি অক্ষন আমারে তাবিজ দেও। দরকার হইলে ট্যাকা কয়ডা বেশী লও। আমার ডর করতাছে ভাই। আইজক্যা ভর দুপুরে আমারে কয় আমারে নাহি কালী বাড়ির পুস্কনিতে ডুবায় মারবো’।

ভ্রু কুঁচকে কেরামত ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করছে। তবে সে খুব ভালো ভাবেই বুঝতে পারছে যে, যে কোন কারণেই হোক মতি ভয় পেয়েছে। তার মুখে একটা সুক্ষ হাসি খেলেই মিলিয়ে গেল। একটু ইতস্তত ভাব করে সে বললো, ‘আইচ্ছা বও দেহি কি করবার পারি’।

মতিকে বারান্দায় বসিয়ে কেরামত ঘরে গেল। মতি ভয়ার্ত চোখে দূরের আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যা বেশ গাঢ় হয়ে নেমেছে আজকে। সে ভাবছে আজ চেয়ারম্যান সাহেব তাকে খুনই করে ফেলবে। কিন্তু চেয়ারম্যানের ভয়ের চেয়ে এই অশরীরী জ্বীনের ভয় তার অনেক বেশী। কোন রকমে একবার তাবিজটা হাতে বাঁধতে পারলে হয়। তারপর লুনার সামনে বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে সে কথা বলবে। আর তারও পরে চেয়ারম্যান ঢাকা গেল সেই আকাঙ্খিত প্রতিশোধ। মতি দোয়া পড়ে বুকে ফুঁ দিয়ে বসে থাকে।

 

মামুনের ডায়রি পড়ে সেই যে ঝিম মেরে শুয়ে আছি আর ওঠা উঠি নেই। সিদ্ধান্ত তো নিলাম বন্ধুকে সাহায্য করার। কিন্তু কীভাবে? শুয়ে শুয়ে ভাবছি কীভাবে আগানো যায়। নিজেকে একজন ডিটেকটিভ বলে মনে হচ্ছে। তার থেকেও বেশী করে মনে পড়ছে মিসির আলীর কথা। আচ্ছা মিসির আলী এমন একটা অবস্থায় থাকলে কি করতেন? আমি কল্পনা করছি। মিসির আলী ইয়াকুব চেয়ারম্যানের বাসায় চলে যেতেন। ইতস্তত করে উঁকিঝুঁকি দিয়ে কাউকে ডাকার চেষ্টা করতেন। হয়তো ইয়াকুব সাহেব নিজেই এসে দরজা খুলে দিয়ে জিজ্ঞেস করতেন ‘কাকে চাই?’

-আমি মিসির আলী। আপনার বড় কন্যা সংক্রান্ত একটা ব্যাপারে আপনার সাথে কিছু কথা বলার ছিল।

চেয়ারম্যান ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করতেন – ‘আপনি কি সাংবাদিক নাকি? আমার বড় মেয়ের ব্যাপারে কি কথা? আপনি কি তাকে চেনেন?’

-জ্বী না। আমি তাকে চিনি না। আর আমি সাংবাদিকও নই। আমি আমার এক পরিচিত ডাক্তারের কাছে তার কথা শুনেছি। সে আমাকে অনুরোধ করেছে আপনার মেয়ের ব্যাপারে আপনার সাথে কথা বলতে’।

চেয়ারম্যান সাহেবের ভ্রু তখনো সোজা হয়নি। সে ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করবে – ‘আপনি কি ডাক্তার?’

-জ্বী না। আমি একজন শিক্ষক।

এই কথা বলে সে একটা দুমড়ানো কার্ড পকেট থেকে বের করে ইয়াকুব সাহেবের হাতে দেবেন। ইয়াকুব সাহেব কার্ডটা পড়ে কি করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। তিনি একবার কার্ডের দিকে একবার মিসির আলীর দিকে তাকাবেন। হঠাৎ তার চোখ বড় বড় হয়ে যাবে। ভারী নিঃশ্বাস টেনে বিষন্ন মনে তিনি মিসির আলীকে বলবেন – ‘আসুন, ভিতরে আসুন মিসির আলী সাহেব’।

মিসির আলী তার পিছনে পিছনে যেতে যেতে বলবেন, -‘ কিছু মনে না করলে একটা কথা বলতে পারি?’

-জ্বী বলুন

-আমাকে বাসায় ঢুকতে দেবেন কিনা এটা নিয়ে আপনি সন্দিহান ছিলেন। আপনার সেই সন্দেহ কি আপনার বড় মেয়ে দূর করেছে?

ইয়াকুব সাহেব প্রচন্ড অবাক হয়ে থমকে যেয়ে মিসির আলীর দিকে তাকিয়ে বলবেন, – আপনি কীভাবে জানলেন?আপনিও কি ওর মত……

-না, ইয়াকুব সাহেব। আমি আপনার কন্যার মত মাইন্ড রিডিং পারিনা। আমি আমার পর্যবেক্ষন আর লজিক মিলিয়ে সিদ্ধান্তে আসি। আমার ধারণা আপনার মেয়ে মানুষকে অবাক করে দিতে ভালোবাসে। সে আমাকে তার ক্ষমতার একটা নমুনা দেখালো। তার এই মানুষকে অবাক করে দেবার প্রতি যে ভালোবাসা আমি সেটাকে কাজে লাগিয়েই তার চিকিৎসা করতে চাই।

 

হঠাৎ আমি ইউরেকা বলে চেঁচিয়ে উঠলাম। আমি পেয়ে গেছি। চন্দ্রাবতীর সাথে আমাকে অবাক-অবাক খেলা খেলতে হবে। তার মানসিক শক্তির উৎস সম্পর্কে জানার একটাই উপায়। আর তা হল তাকে তার শক্তি দেখানোর ক্ষেত্র প্রস্তুত করে দেয়া। দূরের আকাশে তখন বেলা শেষের শেষ আভা। কেমন বিষন্ন একটা লাল রঙের চাঁদর গায়ে দিয়ে দিনের আলো আত্মসমর্পণ করছে রাতের কোলে। হালকা শব্দে ভেসে আসছে মাগরিবের আযান। ঠিক তখনি আমার মনে হল মামুনের তো সেই দুপুরে আসার কথা ছিল। এখনো ও আসছে না কেন? ডিউটি শেষ হয়েছে দুপুর দুটোয়। এতক্ষণ তো হাসপাতালে থাকার কথা না ওর। ভাবতে ভাবতেই মামুনের ফোন। শালা বাঁচবে বহুদিন বলে ফোন ধরে হ্যালো বলতেই মামুন হরবর করে বলে গেলো, ‘তানভীর একটু হাসপাতালে আসতে পারবি এখুনি। নসিমন পাগলীটাকে সেই দুপুর থেকেই কোনভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। প্রচন্ড ভায়োলেন্ট আচরণ করছে’।

খুব দ্রুত কাপড় পরে বের হতে যাবো এমন সময় সারা গায়ে শিরশির করে কাঁটা দিয়ে উঠলো। আবার সেই কণ্ঠ। মাথার মধ্যে কে যেন ফিসফিস করে বলে গেল, ‘এটা আপনার প্রথম পরীক্ষা ডাক্তার তানভীর। গুড লাক’।

 

মতি বুকে এক হাতি পরিমাণ বল পেয়েছে। কেরামত তাকে শরীর বন্ধের তাবিজ দিয়েছে। তাবিজ তামার হবে নাকি রূপার প্রলেপ দেয়া তামা হবে এটা ঠিক করতে অবশ্য কিছু সময় লেগেছে। শেষমেশ ২০টাকা বেশি লাগলেও মতি রূপার প্রলেপ দেয়া তাবিজের খোলটাই নিয়েছে। কেরামত বারবার সাবধান করে দিয়েছে যেন আজকেই তাবিজ ধারণ করা হয়। তাবিজ খুব তমিজের সাথে পাক-পবিত্র হয়ে ডান হাতের কনুই থেকে ৫ আঙ্গুল উপরে কালো সূতা দিয়ে বাঁধতে হবে। মতি জানে সে এখন নাপাক। এজন্য মতিকে আবার বাসায় যেতে হচ্ছে। সন্ধ্যা হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল। মতি বড় রাস্তা ধরে তার বাসায় ফিরে যাচ্ছে। এখন আর তার কোন ভয় নাই। জ্বীন-ভূত কিছুই এখন তার কোন ক্ষতি করতে পারবেনা। কেরামতের বাসা হাটের কাছে। সেখান থেকে বড় রাস্তা হয়ে মতির বাসায় যেতে বেশ সময় লাগে। এজন্য মতি হাইস্কুলের পাশের কাঁচা রাস্তা ধরে এগোচ্ছে। অন্যসময় হলে সে দিনের বেলাতেও এই রাস্তায় আসেনা। এই রাস্তা কালী মন্দিরের পিছন দিক দিয়ে ঘুরে ডোবার কাছে গিয়ে শেষ হয়েছে। ডোবা থেকে মতির বাড়ী মিনিট পনের হাঁটা পথ। কালী মন্দির আর তার ডোবা নিয়ে অনেক ভয়াবহ কাহিনী সে ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছে। নিজের চোখেও দেখেছে। প্রথম দেখেছিল দুই বছর আগে। বেপারী বাড়ির বড় ছেলে বাবলুর লাশ পাওয়া গেল ডোবার ধারে। লাশের চেহারা আর চেনার উপায় ছিলনা। মতি অবশ্য খুব বেশি সময় দেখতে পারেনি। পুলিশ এসে লাশ সদরে নিয়ে যাবার আগে একনজর দেখেছিল। সারা শরীরে কাঁদায় মাখামাখি। কিন্তু গায়ের কোথাও কোন কাটাকুটি নাই। শুধু দুই রানের দুইপাশে রক্ত জমাট বেঁধে ছিল। মতি লোকমুখে শুনেছে বাবলুর পুরুষাঙ্গ নাকি কাঁটা ছিল। গ্রামের সবার ধারণা বাবলুকে মেরেছে কোন মেয়ে জ্বীন। ভাবতে ভাবতে মতি দেখে সে মন্দিরের কাছে চলে এসেছে। তাবিজ হাতে থাকা স্বত্তেও সে এখন বেশ ভয় পাচ্ছে। আকাশে কালো মেঘ। একরত্তি চাঁদের আলো নেই কোথাও। মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বয়ে যাচ্ছে। মতি হেঁটে যাচ্ছে সাবধানে। তার ডান পাশে ভাঙ্গা মন্দির। ঝোপ ঝাড়ে ঢাকা। মতির বুক ধুকধুক করছে। মন বলছে এখান থেকে ছুটে ফিরে যেতে। কিন্তু সে ফিরবে না। তাকে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে তাবিজ ধারণ করতে হবে। আরও একটা কারণে সে এই পথে এসেছে। কেরামতের তাবিজের কেরামতি সে দেখতে চায়। এই পথে এসে সে আবার সেই কণ্ঠ শুনতে পায় কিনা এটা দেখাও তার একটা উদ্দেশ্য। মতি একটা সিগারেট ধরালো। আগুন দেখে জ্বীন ভয় পায় এটা জানা কথা। গ্রামের মৌলভি একদিন বলছিলেন জ্বীন হল আগুনের তৈরী। কথাটা মতি ভোলেনি।

 

ইয়াকুব সাহেব মতিকে খুঁজতে হাসমতকে পাঠিয়েছেন। রাত আটটা বাজে এখনো মতির খবর নেই। এটা তার জন্য বড়ই চিন্তার বিষয়। মতি বিয়ে করে নিজের ঘরে যাবা অব্দি এমন কাজ কোনদিন করেনি। নিশ্চয়ই মতির কোন সমস্যা হয়েছে। করিমনও কিছু বুঝতে পারছে না। মানুষটা সেই ভরদুপুরে বাজার রেখে সেই যে গেল আর কোন খবর নাই। এদিকে বাসায় মেহমান আসার সময় হয়ে যাচ্ছে। করিমনের মনে মতির জন্য চিন্তা হচ্ছে। দুপুরবেলা মানুষটাকে খুব বিচলিত মনে হচ্ছিল। তার খুব ইচ্ছা করছে সে একবার বাড়ি গিয়ে মতির খোঁজ নেয়। কিন্তু সে গেলে ঘরের কাজ হবেনা ঠিকমত। এজন্য সে যেতেও পারছে না। শেষপর্যন্ত হাসমত গেছে শুনে একটু স্বস্তি পেয়েছে। ইয়াকুব সাহেব খাবারের আয়োজন দেখে খুশী। এখন তিনি অপেক্ষা করছেন মামুন আর তার বন্ধু তানভীরের জন্য। ওদেরও অবশ্য এরই মধ্যে চলে আসার কথা। কিন্তু তারাও আসছেনা। ইয়াকুব সাহেব বুঝতে পারছেন না আজ সবকিছু এমন উলট পালট হচ্ছে কেন?

 

মুনার মন ভালো হয়ে গেছে। শুধু ভাল বললে ভুল হবে। মুনার মন এখন অসম্ভব ভালো। মন ভালো হওয়া শুরু হয়েছে বিকেল থেকে। স্কুল থেকে ফিরে সে কান্নাকাটি করে কখন ঘুমিয়ে পরেছিল নিজেও জানে না। ঘুম থেকে উঠে বাবা-মার ঘরে গিয়ে সে আজকে মেহমান আসার কারণটা জেনে এসেছে। কয়েকদিন থেকেই সে শুনছিল মামুন ভাই এর কোন এক বন্ধু আসবে শুভপুর বেড়াতে। ঢাকা থেকে মামুন ভাইয়ের বন্ধু আসলে যে তাকে একবেলা দাওয়াত করে এখানে খাওয়ানো হবে সেটা মুনাকে কেউ না বললেও সে বুঝতে পারে। তবে এখন সে জানে যে শুধু দাওয়াত না এর পিছনে লুনাপার চিকিৎসা সংক্রান্ত ব্যাপারও আছে। মামুন ভাই এর বন্ধু ডাক্তার তানভীর নাকি অনেক ভাল সাইক্রিয়াট্রিস্ট। মুনা মনে মনে আল্লাহর কাছে খুব করে চাইছে তার লুনাপা ভালো হয়ে যাক। লুনার জন্য তার অনেক কষ্ট হয়। এত সুন্দর দেখতে লুনাপা কিন্তু কি এক আশ্চর্য্য কারণে সে এমন হয়ে গেছে। মুনা জানে না লুনা কে সত্যি জ্বীনে ধরেছে না কি এটা তার মনের অসুখ। তবে সে জানে লুনা যদি চায় তাহলে সে মানুষের চোখের দিকে তাকিয়ে মনের কথা সব বলে দিতে পারে। মুনা খুব করে চাইছে এইবার যেন তার লুনাপা ভালো হয়ে যায়। লুনাপা ভালো হয়ে গেলেই সে বাবাকে বলবে মামুন ভাইয়ের সাথে লুনাপার বিয়ে দিয়ে দিতে। বাসার আর কেউ না বুঝুক মুনা ঠিকই বোঝে যে মামুন ভাই তাকে অংক আর ইংরেজী দেখিয়ে দিতে এসে কেন আড়চোখে লুনার রুমের দিকে বারবার তাকায়। সে বোঝে কেন লুনাপা কে দেখলে মামুন ভাইয়ের চোখ-মুখ লাল হয়ে সে নার্ভাস হয়ে যায়। মুনাও চায় মামুন ভাইয়ের সাথে লুনাপার বিয়ে হোক। লুনাপা সবার মনের কথা জানে আর মামুন ভাইয়ের এই কথাটা জানে না এটা মুনা বিশ্বাস করেনা। সে বোঝে লুনাপা সব জেনেও কেন চুপ করে থাকে। কেন সে মামুন ভাইকে এড়িয়ে চলে। এর একমাত্র কারণ তার অসুখ। জানাল দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মুনা মনে মনে বলে, ‘আল্লাহ এইবার যেন আমার লুনাপা ভালো হয়ে যায়’।

 

হাসপাতালে যখন পৌছালাম তখন সন্ধ্যের আভা দূর আকাশে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছে। অনেকটা যেন আমার মত। আমি যেমন মামুনের এই সমস্যাটার সমাধান অনেকটা হারিয়ে খুঁজছি তেমন আর কি। মামুনের কোয়ার্টার থেকে পায়ে হেঁটে মিনিট পাঁচেক এর পথ। হাসপাতালের গেটে কাউকে দেখলাম না। ঠিক কোন জায়গায় মামুন আমাকে যেতে বলেছে তাও বুঝতে পারছি না। গেটের ভিতরে ঢুকে মামুনকে ফোন দিলাম।

-দোস্ত, কই তুই? আমি হাসপাতালের কম্পাউন্ডে

-আচ্ছা তুই দাড়া। আমি লোক পাঠাচ্ছি।

কথা শেষ করে চারিদিকে চোখ বুলাচ্ছি এমন সময় ঠিক পিছন থেকে লম্বা একটা সালাম দিয়ে কে যেন বলে উঠলো, ‘ আসসালামু আলাইকুম স্যার। আমি মকবুল। হাসপাতালের বয়। লন আমার লগে। মামুন স্যার মহিলা ওয়ার্ডেই আছে। পাগলীডা যে যন্ত্রণা দিতাছে না আর কি কমু’।

হঠাৎ কানের কাছে এমন লম্বা সালামে ভয়ই পেয়ে গিয়েছিলাম। ঘুরে দেখি মাঝ বয়সী একজন লোক। একটা আধ ময়লা নীল শার্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে। চোখে মুখে স্পষ্ট বিরক্তি। বিরক্তিটা আমাকে ডাকতে আসার জন্য নাকি ঐ পাগলীটার জন্য সে কথা জানতেই হেঁটে যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলাম, ‘পাগলীটা খুব জ্বালাচ্ছে মনে হয়?’

কথা শেষ হতে দেরী, মকবুল নিজের উৎসাহে বলে গেল, ‘আর কইয়েন না স্যার, গত পরশু রাইতে ইদ্রিস আর আফজল রাস্তার থন ধইরা নিয়া আইছে। আনোনের কালে তো হুশ আছিল না। তখন মুখ দিয়া কতা বাইর হয় নাই। আর হুশ হওনের পর থিইক্যা যে কতা শুরু করছে গো স্যার আর কি কমু। মহিলা ওয়ার্ডে ছাড়া ওরে রাখুম কই কন? কিন্তুক ওর জ্বালায় রোগীরা যাইতাছে গা। কাইল সারা রাইত গাইল পাড়ছে। আইজ দুপুর থন পাগলামী শুরু করছে। আমারে মারইতে আইছে কত্তবার। মামুন স্যার সেই দুপুর থন চেষ্টা করতাছেন কিন্তুক শান্ত হইতেছে না’।

আমি কিছু না বলে মকবুলের সাথে আগাচ্ছি। এই লোকের যে স্বভাব দেখছি তাতে মনে হচ্ছে আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করতে হবেনা। সে নিজে থেকেই সব বলে যাবে।

মকবুল লম্বা একটা করিডোরে উঠে আবার কথা শুরু করলো। ‘কি আর কমু ওর কথা। বাপে আছিল ব্যবসায়ী মানুষ। ডাকাইতরা ধইরা নিয়া গিয়া মাইরা ফালাইছে। পরে আবার ওরেও নিয়া গেছিল উডায়া। শুনছিলাম ওরে কালী মন্দিরে রাইখ্যা অত্যাচার করছে। কয়েকদিন পর যহন ফেরত দিছে তহন আর ওরে চেনোন যায় না। কি সুন্দর মাইয়াডা তারপর থন কথা বার্তা বন্ধ কইরা দিন-রাইত ঐ মন্দিরের আশে পাশে ঘুর ঘুর করতো আর খালি হাসতো। সেই যে মাথা নষ্ট হইলো আর ঠিক হইলো না’।

আমরা হাঁটতে হাঁটতে করিডোরের শেষ মাথায় এসে পৌছালাম। ভিতরে ঢুকতে যাব এমন সময় মকবুল বললো, ‘স্যার, মনে কিছু নিয়েন না একটা কথা কইতাম’।

আমি কিছুটা আন্দাজ করতে পারছি এমন একটা ভাব নিয়ে বললাম, ‘কি কথা মকবুল? নসিমনকে জ্বীনে ধরছে ওর কাছ থেকে একটু সাবধানে থাকবো এই তো?’

আমার দিকে কেমন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে মকবুল যা বললো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। গলার স্বরে প্রবল মমতা মাখিয়ে, আর্দ্র কণ্ঠে সে বললো, ‘স্যার, আমি মামুন স্যারের কাছে আপনার কতা অনেক শুনছি। এই পাগলীডার লাগি পরানডা পুরায় স্যার। আমার বাড়ির লগে ওগো বাড়ি। মাইয়াডারে ছুডু কালে কত কোলে নিয়া ভাত খাওয়াইছি। কিছু করবার পারলে কইরেন স্যার’। শেষ কথাটা বলার সময় সে মাথাটা নিচু করে চোখ মুছে নিল।

আমি অবাক হয়ে ৩৫ বছর বয়স হবে এমন একজন ওয়ার্ড বয়ের মানুষের প্রতি মমতা দেখছি। চোখের কোণাটা কেমন যেন ভারী হয়ে যাচ্ছে। কে বলে আমাদের দেশের মানুষের মনে মায়া-দয়া নাই। আমি মকবুল ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বললাম, ‘মকবুল ভাই, আমি জানি না মামুন আপনাকে আমার সম্পর্কে কি বলেছে। তবে আমি যতটুকু পারি নসিমনের জন্য চেষ্টা করবো’।

ওয়ার্ডে ঢুকে একটু কেমন কেমন লাগছিলো। সবাই খুব কৌতুহল নিয়ে আমাকে দেখছে। মামুন এখানকার সবাইকে কি বলেছে কে জানে। ওয়ার্ডের এক কোণায় পর্দা দিয়ে ঘেরা একটা বেড। কিছু মানুষের জটলা দেখতে পেলাম ওখানে। সেখানে পুরুষ মানুষের সংখ্যাটা বেশি। মহিলা ওয়ার্ডে এত পুরুষ কেন? ভাবতে ভাবতেই দেখলাম দুজন সিস্টারকে সবাইকে সরে যাবার জন্য বলছে। তবে তাতে খুব একটা লাভ হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। সবার কাছে ব্যাপারটা একটা তামাশার মত হয়ে গেছে বোধহয়। আমি যেতেই লোকগুলো জায়গা করে দিল। মামুনকে দেখলাম উবু হয়ে ইনজেকশন দেবার চেষ্টা করছে। বিছানায় হাত-পা ছুড়ে নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে একজন তরুণী। গায়ে ওটি ড্রেস। বেডের রোগীর গায়ে ওটি ড্রেস কেন বুঝলাম না। গায়ে একটা পাতলা চাঁদরও আছে। রোগীর এলো চুল সব মুখের উপরে বলে চেহারা দেখা যাচ্ছে না। সে ক্রমাগত হাত-পা ছুড়ছে। দুজন লোক বেশ শক্ত করে তাকে ধরে রেখেছে বলে সে নিজেকে মুক্ত করতে পারছে না। এই হাত-পা ছোড়াছুড়ির মধ্যেই ওটি ড্রেসের ফাঁক গলে তার উন্নত বুকের ওঠানামা সবার চোখে পরছে। ঠিক তখনি বুঝলাম মহিলা ওয়ার্ডে এত পুরুষ এই একটা বেডের চারপাশে কেন। দেখেই মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। মামুন যে কি করে মাথা ঠান্ডা করে রেখেছে তাই ভাবছি। মামুনের পাশে দাঁড়াতেই ও ম্লান হেসে বললো, ‘এসেছিস। উফফ সেই কখন থেকে সেডিল দেবার চেষ্টা করছি। কিছুতেই দিতে পারছি না। রোগী কিছুতেই স্থির হচ্ছে না’।

আমি একটু জোরের সাথেই বললাম, ‘রোগী স্থির হবে কীভাবে? চারপাশে এত ভীড় থাকলে একটা মানসিক রুগী কি স্থির থাকতে পারে?’

মামুন বেশ অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘আমি বলেছি কিন্তু এরা এখান থেকে নড়বেই না। দেখ তুই যদি বলে কিছু করতে পারিস’।

আমি ভীড় করা মুখগুলোর দিকে তাকালাম। সবার চোখ চকচক করছে। পুরুষের এই দৃষ্টি আমার খুব ভালো মত চেনা। কারো মধ্যে এই জায়গা ছেড়ে যাবার কোন ইচ্ছা আছে বলে মনে হচ্ছে না। বুঝতে পারলাম মামুনের মত নরম মানুষের পক্ষে এদের কোন শক্ত কথা বলাও সম্ভব না। আমি সবার দিকে একবার করে তাকিয়ে একটু মুরুব্বী গোছের একজনকে উদ্দেশ্য করে খুব ঠান্ডা গলায় বললাম ‘চাচা মিয়া, এই রোগী কি আপনার কিছু হয়?’

সে একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, ‘জ্বে না’।

এইবার বেশ ধমকের সুরে বললাম ‘তাইলে চাচা একটা মহিলা রোগীর বিছানার কাছে শুধু শুধু দাঁড়ায় আছেন কেন বলেন দেখি? তার উপর দেখতেছেন যে রোগীর গায়ে জামা কাপড়ের কোন ঠিক ঠিকানা নাই। যুবতী মাইয়ার শরীর দেখা যাইতেছে। এইখানে ভীড় কইরা কি আখেরাতের পাপ বাড়ানোর কোন দরকার আছে?’ এরপর একজন মহিলা রোগীর বয়স্ক মহিলা এটেন্ডেন্ট কে খুব মোলায়েম স্বরে বললাম ‘কি চাচী আম্মা, কথা কি মিছা কইলাম?’

একজন অপরিচিত কিন্তু ইন করা শার্ট-প্যান্ট পরা লোক যে কিনা আবার ডাক্তারের কিছু একটা, তাকে চাচী আম্মা বলে সম্বোধন করছে – ব্যাপারটা মহিলার জন্য বেশ সম্মানের বলে কি না জানি না উনি বেশ উঁচু গলায় বললেন, ‘কি রে মিনসের দল, মাইয়া মানুষ দেহোস নাই কুনু দিন? মাইয়াগো ঘরে তোরা কি কামে আইছোস? এক্ষন সবডি বাইর হ। নাইলে কিন্তু চেয়ারম্যানের কাছে যাইতাছি আমি’।

মহিলার কথাতেই হোক আর চেয়ারম্যানের ভয়েই হোক- এই কথার পর লোকগুলো একজন একজন করে সরে যেতে আরম্ভ করলো। এই পুরো ঘটনার মধ্যে মামুন আর মকবুল আমার দিকে হা করে তাকিয়ে ছিল। আমি বেডের কাছে ফিরে যেতেই মামুন বললো, ‘এই কাজ আমাকে দিয়ে জীবনেও হত না রে তানভীর’।

আমি মামুনকে উত্তর দিতে যাবো এমন সময় আমার চোখ পরলো নসিমনের দিকে। চোখ বড় বড় করে মেয়েটা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। গভীর চোখদুটো তে রাজ্যের ক্লান্তি। গায়ের আসল রং এখন আর বোঝার উপায় নেই। মুখের বামপাশে একটা লম্বা কাঁটা দাগ। তবে চেহারা আর শারীরিক গড়ণ তাকে সাধারণের কাছে লোভনীয় হিসাবেই উপস্থাপন করেছে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমি মামুনকে বললাম, ‘এজন্যই ওকে আলাদা কেবিনে রাখার সাহস পাচ্ছিস না তাই না?’

মামুন শুকনো হেসে বললো, ‘আমি এসেছি ৬ মাস হল। এর মধ্যে একবার ওর এম আর করতে হয়েছে। বেশীরভাগ সময় রাস্তায় না হলে ঐ কালী মন্দিরে ঘুমিয়ে কাটায়। মানুষ সর্বনাশ করতে ছাড়ে না’।

পাশে দাঁড়ানো মকবুল বলে উঠলো, ‘ওরে কারো জিম্মায় রাইখাও শান্তি নাই স্যার’। আইজকাল মানুষ খুব খারাপ হইয়া গেছে’।

নসিমন মকবুলের কথা শেষ হবার আগেই হা হা হা করে হেসে উঠে আবার হাত-পা ছোড়া শুরু করেছে। যারা এতক্ষন ওকে ধরে রেখেছিল তারা চলে গেছে। মামুন দুজন নার্সকে বললো ওকে ধরে রাখতে। আমি মানা করলাম। নসিমন ভারী অবাক হল। সবাইকে অগ্রাহ্য করে আমি নসিমনের মাথার কাছে দাঁড়িয়ে খুব নিচু গলায় বললাম, ‘নসিমন, কই যাবা? রাস্তায় নামলেই ঐ কুত্তারা আবার তোমারে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাবে। তারচেয়ে এইখানে কয়টা দিন আরাম কর। একটা ওষুধ দিব যাতে রাতে ভালো ঘুম হয়। শান্ত হয়ে চুপচাপ শুয়ে থাকো। নড়াচড়া করলেও ওষুধ দিব না করলেও দিব। বরং নড়াচড়া করলে কষ্ট বেশী পাবা। লক্ষী বইন, একদম চুপ করে শুয়া থাকো’।

মামুন কিছু না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। নার্স দুজন আর মকবুল একবার আমার দিকে আর একবার নসিমনের দিকে তাকাচ্ছে। আমি মামুনের হাত থেকে ইঞ্জেকশন নিয়ে আবার বললাম, ‘নসিমন তুমিই বল কোন হাতে দিব?’ সবাইকে অবাক করে দিয়ে নসিমন তার বাম হাত এগিয়ে দিল। আমি নার্সকে বললাম ‘সিস্টার ইঞ্জেকশন দেন। ও এখন আর মানা করবে না’।

অবিশ্বাসী চোখে নার্স একবার ইতস্তত করলো। আমি আবার বললাম, ‘দিদি, ভয় নেই। ও এখন কিছু বলবে না’।

নার্স ইঞ্জেকশন দিলো বিনা বাঁধায়। শেষ হলে নসিমনের বেড পর্দা দিয়ে ঘিরে বের হয়ে আমি আর মামুন বের হয়ে আসতে যাবার সময় হঠাৎ নসিমন আমার হাত টেনে ধরলো। ইশারায় বুঝালো সে আমার কানে কানে কিছু বলতে চায়। প্রবল আগ্রহ নিয়ে আমি ওর দিকে মাথা নিচু করলাম। ফিসফিস করে নসিমন বললো, ‘তানভীর, প্রথম পরীক্ষায় আপনি পাশ। তাড়াতাড়ি বাসায় আসেন। সবাই আপনার জন্য অপেক্ষা করছে। বিশেষ করে আমি’।

আমার প্রবল আগ্রহ তখন প্রচন্ড আতঙ্কে রূপ নিয়েছে। শিরদাড়া বেয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে যাচ্ছে অনুভব করছি। এটা সেই একই কণ্ঠ যে কণ্ঠ আমি শুভপুরে পা রাখার সাথে সাথেই শুনতে পেয়েছিলাম। হঠাৎ বুঝতে পারলাম প্রচন্ড মানসিক ক্ষমতাসম্পন্ন কোন এক মেয়ের মুখোমুখি হতে যাচ্ছি আমি আজ রাতেই। যে কিনা আমার ধারণা মতে শুধু থট রিডিং না, টেলিপ্যাথিও জানে এবং তার টেলিপ্যাথির ক্ষমতা বোধকরি আমি এখনো পুরোটা দেখিনি। সেই সাথে এটা আমার কাছে দিনের আলোর মত পরিস্কার হয়ে গেল যে এই ক্ষমতার মালিক আর কেউ নয় মামুনের চন্দ্রাবতী।

একটা ঘোর লাগা মনে আমি ওয়ার্ড থেকে বের হলাম। মামুনের জিজ্ঞাসা ‘তেমন কিছু না’ বলে এড়িয়ে গেলাম। শুধু মনে মনে বললাম, ‘আমি আসছি চন্দ্রাবতী। মামুনের জন্য হলেও এর শেষ আমাকে দেখতে হবে’।

আবার শিরশির করা অনুভূতির সাথে মাথার মধ্যে চন্দ্রাবতী বলে গেল –‘আমিও তাই চাই’।

 

 

মুনার মন আবার খারাপ হওয়া শুরু হয়েছে। রাত সাড়ে আটটা বাজে অথচ মামুন ভাই আর তার বন্ধুর আসার কোন লক্ষণই নেই। তাদের সন্ধ্যায় এসে নাস্তা করার কথা। এই নাস্তার একটা আইটেম মুনা নিজে হাতে বানিয়েছে। সে রান্না-বান্না খুব একটা পারে না। শেখার ব্যাপারেও আগ্রহ কম। তবুও মামুন ভাইয়ের জন্য একটা আইটেম সে শিখেছে। মামুন ভাই ঝালমুড়ি খেতে পছন্দ করেন। সে খুব যত্ন করে শসা আর টমেটো মেখে তুলে রেখেছে। এক বাটিতে চানাচুর আর ছোলা রাখা আছে। শুধু মামুন ভাইরা এলেই মাখিয়ে দেয়া হবে। যদিও মুনার ধারণা অন্যদিনের মত আজকেও লবনটা বেশী হয়ে গেছে। আকাশে জমতে শুরু করেছে মেঘ আর মুনার চোখে জল। মামুন ভাইয়ের বন্ধু না এলে লুনাপা ভালো হবেনা- চোখের জলের কারণ এটা কিনা তা নিয়ে মুনার নিজেরই সন্দেহ আছে। নিজের চোখের জলকে মুনা অসম্ভব ভয় পায়। কিন্তু সেই জল কেন জমছে মুনা জানে না। এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতেও সে ভয় পাচ্ছে।

হাসমত একবার আকাশের দিকে আর একবার দরজার দিকে তাকাচ্ছে। প্রতিবার দরজার দিকে তাকানোর সময় তার ভ্রু কুঁচকে যাচ্ছে। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ। হারিকেনের আবছা আলো চোখে পরছে। কিন্তু মতির কোন সাড়াশব্দ নেই। সে বেশ কয়েকবার মতি, মতি বলে ডেকেছে কিন্তু কেউ উত্তর দেয়নি। আকাশে বেশ ভালোই মেঘ জমেছে। বৃষ্টি নামবে যেকোন সময়। এই অবস্থায় বেশীক্ষন অপেক্ষাও করা যাচ্ছে না। হাসমত একবার চিন্তা করছে ফিরে যায়। আবার চিন্তা করছে মতির বিপদ হলো কিনা। বৃষ্টির ফোঁটা পরা শুরু হয়েছে। হাসমত মতির ঘরের বারান্দায় উঠে আসে। শেষ চেষ্টা হিসাবে হাসমত দরজায় ধাক্কা দিবে ভেবে হাত বাড়ায়। ঠিক সেই সময় মতি দরজা খুলে বেড়িয়ে আসে।

-কি মতি মিয়া ঘুমাইছিলা নি?

-হ। মানে শইলডা ভালা না।

কথাটা বলার সময় মতির গলা কেঁপে যায়। সে চোখ নামিয়ে ফেলে। তাবিজের কথা সে কাউকে বলতে চায় না। অন্যসময় যে কেউ তার চোখ দেখলেই বুঝতে পারতো সে কিছু একটা লুকাচ্ছে। এখন অন্ধকার। অন্ধকারকে মানুষ পছন্দ করেনা। কিন্তু এই অন্ধকারই মানুষকে অনেক সুবিধা দেয়। মতি ভাবে মানুষ বড়ই অকৃতজ্ঞ।

-তা চেয়ারম্যানের বাড়িত যাইবা না? চেয়ারম্যান আমারে পাঠাইলো তোমার খোঁজ নেওয়ার লাগি।

নিতান্ত অনিচ্ছার সাথে যাচ্ছে এমন একটা ভাব করে মতি বলে, ‘না, শইলে জুইত পায় না। তয় তুমি যহন আইছো, লও যাই।

হাসপাতাল থেকে যে ঘোর নিয়ে বের হয়েছিলাম সেই ঘোরের মধ্যেই এখনো আছি। ঘোর জিনিসটা ভালো না। চিন্তা শক্তি এলোমেলো করে দেয়। আমারও সবকিছু কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেছে। এলোমেলো অবস্থায় কারো বাসায় প্রথমবারের মত বিশেষ উদ্দেশ্যে যাওয়া উচিত না। কিন্তু এই অনুচিত কাজটাই আজ আমাকে করতে হয়েছে। আমাদের কথা ছিল সন্ধ্যায় যাবার। ঝামেলার কারনে রাত ৮টার পরে যখন বাসা থেকে বের হলাম তখন টিপটিপ বৃষ্টি পরছে। মামুন কেন যেন বেশ নার্ভাস ভাবে আমার হাতে ধরা জেনার কার্ডের প্যাকেটটার দিকে তাকাচ্ছে। বুঝতে পারছি জেনার কার্ডের ব্যাপারে ওর আপত্তি আছে কিন্তু বলতে পারছে না। শেষমেশ ওর অস্বস্তি দূর করার জন্য আমি নিজেই ওকে জিজ্ঞেস করলাম।

-তুই মনে হয় জেনার কার্ড নিয়েছি বলে মন খারাপ করেছিস?

একটু অপ্রস্তুত হয়েও নিজেকে সামলে নিয়ে মামুন বললো, ‘না মানে যদি সে জেনার কার্ডের পরীক্ষা দিতে না চায়?

-না চাইলে না চাইবে। জোরাজুরি তো আর করবো না।

এই কথার পরে আর কোন কথা থাকে না। মোটামুটি আস্বস্ত হয়ে মামুন আমাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললো।

আমি এখন বসে আছি চেয়ারম্যানের বাসার ড্রইং রুমে। খুব যত্ন করে গোছানো ঘর। যে বাড়িতে তরুণী মেয়ে থাকে সে বাড়ির ঘর দেখলেই বোঝা যায়। তরুণীরা সারাজীবন গুছিয়েই যায়। বিয়ের আগে বাবার ঘর আর বিয়ের পরে স্বামীর। আমি কৌতুহল নিয়ে ঘর দেখছি। মামুন ইয়াকুব সাহেবের সাথে দাবা খেলছে। পঞ্চাশোর্ধ মানুষটা খুব মনোযোগের সাথে দাবার বোর্ডের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটা সময় দাবাটা আমার নেশার মত ছিল। এখনো সেই চর্চা টুকটাক আছে। খুব ইচ্ছা করছে ওদের খেলা দেখতে। মামুন মনে হয় কোন একটা চালে আটকে গেছে। মামুনের মত সরল ছেলেরা সারা জীবন আটকেই যায়। কখনো দাবার চালে, কখনো জীবনের চালে।

বুক শেলফের বই দেখছি। বেশীরভাগই উপন্যাস। দাবার উপরে বইও আছে কয়েকটা। বৃষ্টি শুরু হয়েছে বেশ ভালোভাবেই। হালকা একটা মিস্টি গন্ধ নাকে ভেসে আসছে। বডি স্প্রে না ফুল ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। আমি বোঝার চেষ্টা করছি। এমন সময় মধ্যবয়সী একজন লোকের সাথে ঘরে ঢুকলো সদ্য কৈশোর পেরুনো মিস্টি চেহারার একটা মেয়ে। তাদের হাতে খাবারের ট্রে। মনে মনে ভাবলাম এই মেয়েটা বোধহয় মামুনের ছাত্রী। টেবিলের উপরে ট্রে রাখার শব্দে ইয়াকুব সাহেব চোখ তুলে তাকালেন।

ড্রইং রুমে বসে আছি। রুমের দরজার পর্দা মৃদু কাঁপছে। আমার সমস্ত অস্তিত্ব বলছে পর্দার ওপাশে কেউ আছে। সেই কেউটা কে তা নিয়ে একটু দ্বিধায় আছি। কে আছে পর্দার ওপাশে? মামুন নির্বিকারভাবে মুড়ি মাখানো খাচ্ছে। ওর সমস্ত মনোযোগ দাবার বোর্ডে। ইয়াকুব সাহেব মনে হয় খুব শক্ত একটা চাল চেলেছেন। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। টিনের চালে বৃষ্টি পড়ার শব্দ যে এত সুন্দর হতে পারে তা আমি জানতাম না। আমি বসেছি জানালার কাছে। বৃষ্টির পানির ছিটা আমার গায়ে একটা অদ্ভুত ভালোলাগার জন্ম দিচ্ছে। এতকিছুর পরও আমার সবটুকু মনোযোগ পর্দার ওপাশে। আমি বুঝতে পারছি কোন এক চন্দ্র-রজনী তে জন্ম নেয়া পর্দার ওপাশের মানুষটা আমাকে তার কাছে টানছে। প্রবল আকর্ষনের জোয়ারে আমি ভেসে যাচ্ছি। নিজেকে সমর্পিত মানুষের মত মনে হচ্ছে। চেতনা লুপ্ত হচ্ছে, আমি ঘোরের মধ্যে চলে যাচ্ছি। আচ্ছন্ন মনে আমি চন্দ্রাবতীকে অনুভব করছি প্রতিটি নিঃশ্বাসে। আমি সবকিছু ভুলে যাচ্ছি। এখানে আসার উদ্দেশ্য ভুলে যাচ্ছি, আমার সাইকোলজির জ্ঞান আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। চোখের সামনে শুধু মামুনের মুখটা দেখতে পাচ্ছি। একটা সময় সেই মুখটাও আবছা হয়ে মিলিয়ে গেল দূরে। আমি হেরে যাচ্ছি। প্রচন্ড মানসিক শক্তির কাছে আমি হেরে যাচ্ছি। আমি অস্ফুস্টে বলে উঠলাম, ‘মামুন আমি হেরে যাচ্ছি, আমি হেরে যাচ্ছি’।

latest video

news via inbox

Nulla turp dis cursus. Integer liberos  euismod pretium faucibua

Leave A Comment