অপ্সরী আর ভীতুর ডিম
এই মুহূর্তে আমি কি করবো ঠিক বুঝে উঠতে পারছিনা। মাথার উপরে ফুল স্পিডে ফ্যান ঘুরছে তারপরও আমি কুলকুল করে ঘামছি। বুকের ভেতর একটা অদ্ভুত শূন্যতা। কেমন যেন দম বন্ধ করা কষ্ট। আর একটা চাপা উত্তেজনা। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। অন্যসময় হলে কখন নেমে যেতাম ভিজতে। কিন্তু এখন কিছুই ভালো লাগছে না। বাইরের বৃষ্টির মত মনের আকাশেও শ্রাবনের ঢল। মাথায় চিন্তার সমুদ্র। বুকে ছাই চাপা দুঃখের আগুন। সব মিলিয়ে রোমান্টিক সিনেমার নায়কের ছ্যাকা পরবর্তী দৃশ্যের বাস্তব সংস্করণ। আসলেই কি তাই? কি জানি। হয়তো সৌরভের কথায় ঠিক। ও একদিন কেন যেন হুট করে বলেছিল, ‘তানভীর, তুই চাইলেই পেতে পারতি তোর অপ্সরীকে। কিন্তু তোর অবহেলা আর ভয়ের কারনে তুই ওকে হারাতে যাচ্ছিস’। সৌরভের কথাটা মনে হতেই মনের সেলুলয়েডে একে একে ভেসে উঠতে লাগলো গত ৪ বছরের সব ঘটনা।
অদ্ভুত মায়ায় জড়ানো তীক্ষ্ণ চোখ আর দৃঢ় ব্যক্তিত্ব সম্পন্ন কিন্তু স্নিগ্ধতা মাখা একটি মুখ। প্রথমবার যাকে দেখে আমি গরম চায়ে মুখ পুড়িয়ে বলেছিলাম, ‘এতো অপ্সরী’। সেই থেকে দুটো ঘটনা আমার ভার্সিটি জীবনের সঙ্গী হয়ে গেলো।
প্রথমটার কথা মনে হলে নিজের উপর খুব রাগ হয় আবার হাসিও পায়। ঘটনাটা হলো আমার অপ্সরীকে দেখলে আমার ভিতরে কি যেন হয়ে যায়। আমি আর আমি থাকিনা। বন্ধুদের ভাষায় তখন নাকি আমাকে ভেড়ার মত লাগে। আর তখন আমার গলা থেকে নাকি ভেড়ার ডাক বের হয়। কিন্তু তারা তো আর জানে না তখন আমার সবকিছু এলোমেলো হয়ে যায়। এইতো সেদিনের কথা। আমি, সৌরভ, রাফি আর নীলা বসে আড্ডা দিচ্ছিলাম ক্যান্টিনে। আমি বসেছিলাম দরজার উলটা দিকে যাতে সে আসলেই আমার চোখ পড়ে। এমনিতেই তার সাথে দেখা হলে একটা না একটা অঘটন ঘটে তারপরও তাকে দেখার তৃষ্ণা যায়না আমার। যাইহোক তুমুল আড্ডাবাজি চলছে। লুল সম্প্রদায়ের ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তা, গবেষনা করছিলাম আমরা। কিভাবে জনগনের মাঝে লুল ভাবনা জাগ্রত করা যায় সেটাই তখন আমাদের আলোচ্য বিষয়। চা আর সিঙ্গাড়ার অর্ডার দেওয়া ছিল। মাত্রই তখন খাবার আসলো। গরম সিঙ্গাড়াটা কেবল হাতে নিয়েছি এমন সময় কেন যেন চোখ চলে গেল দরজায়। আমার সমস্ত অস্তিত্ব নাড়া দিয়ে উঠলো তাকে দেখে। হাত থেকে গরম সিঙ্গাড়াটা পরে যাচ্ছে বুঝতে পেরে ওটাকে ধরার একটা শেষ চেষ্টা করলাম। ফল হলো ভয়াবহ। আমার হাতে বাড়ি লেগে পড়ে গেলো গরম চা ভর্তি কাপ। পড়লো গিয়ে রাফির কোলে। আর কাপ মেঝেতে। গ্লাস ভাঙার ঝনঝন শব্দে পুরো ক্যান্টিন আমার দিকে ঘুরে তাকালো। রাফি ‘উফ্ উফ্ আহ্’ বলে তিনটা চিৎকার দিয়ে বাথরুমের দিকে দৌড় দিলো। ঘটনার বিহবলতায় হতবাক হয়ে আমি শুধু বলতে থাকলাম, ‘কি হলো? এটা কি হলো? রাফির কি হলো?’ নীলা আর সৌরভ আমার বিস্ফোরিত চোখ থেকে ওদের দৃষ্টি নিয়ে গেলো দরজার দিকে। বলা বাহুল্য আমিও ওদিকেই তাকিয়ে ছিলাম। সে খুব অবাক হয়ে পুরো ব্যাপারটা দেখলো। মুচকি একটা হাসি দিয়ে আমাদের দিকে আসতে থাকলো। আমার হাত-পা তখন অকারনেই কাঁপছে। কোন ভাবেই ভিতরের কাপাকাপি বন্ধ করতে পারছিনা। সে এসে বসলো নীলার পাশে। আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কি ব্যাপার? আইনস্ট্যাইন সাহেবের কি সমস্যা? চোখের পাওয়ার কমে গেছে নাকি? তো চশমা চেঞ্জ করলেই তো পারেন’। সৌরভ আর নীলা হাসছে। আমি নিশ্চুপ। জানি এখন মুখ খুললেই বিপদ বাড়বে। আমি ওর সামনে কখনো স্বাভাবিক ভাবে কথা বলতে পারিনা। ক্লাশে যে ছেলেটা টিচারদের প্রশ্নের উত্তর অবলীলায় দিয়ে যায়, ডিবেটের মঞ্চ কাপিয়ে বেড়ায়, সেই কিনা একরত্তি একটা মেয়ের খুব হাস্যকর প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছেনা। আমার এরকম হতবুদ্ধি অবস্থার অনেক কাহিনীর সাক্ষী সৌরভ, রাফি, নীলা আর আশিক। সেদিনের ঘটনটা আবার মনে হতেই নিজের অজান্তেই হেসে ফেললাম।
২য় যে ব্যাপারটা আমার ভার্সিটি জীবনের গত ৪টি বছরের নিত্য সঙ্গী তাহলো আমার দেওয়া নামটা। সেদিনের ঐ অস্ফুটে বলে ফেলা ‘অপ্সরী’ নামটা আমার বন্ধু মহলে খুবই জনপ্রিয় একটা অস্ত্র আমাকে পচানোর জন্য। অবশ্য আমার খুব কাছের বন্ধুরা মানে নীলা, রাফি, সৌরভ আর আশিক ছাড়া আর কেউ জানে না এই নামের রহস্য। তবে আমাকে দেওয়া ওর আইনস্ট্যাইন নামটা ক্লাশের সবাই জানে।
অপ্সরী, হ্যাঁ অপ্সরী। গত ৪টি বছর ধরে এই নামেই ওকে আমি মনে মনে ডেকে চলেছি। মনে হয় এইতো সেদিনের কথা। ক্লাস শুরুর ৩য় দিন অফ পিরিয়ডে ওকে দেখলাম। সেই শুরু। এরপর পার হয়ে গেছে কত দিন, কত রাত। কত সুখের ছোয়া আর হারানোর কষ্ট একসাথে আসতো আমার স্বপ্নে, আমার ভাবনায়, আমার কামনায়। কিন্তু কোনদিন ওকে আমি বলতে পারিনি আমার ভালোবাসার কথা। ক্লাশে বন্ধু হিসাবে যে সম্পর্ক তার বাইরে যেতে পারিনি কখনো। বন্ধুরা কত বলেছে ওকে সরাসরি বলতে অথবা আমার পক্ষ থেকে বলে দেবে বলেও বলেছে। কিন্তু আমি সবসময় না করেছি। ভাব নিয়ে বলেছি, ‘আরে না। সেরকম কিছু হলে আমিই বলবো’’। সেরকম কিছুতো কবেই হয়ে গিয়েছে কিন্তু আজো তাকে বলা হয়নি ভালোবাসি। এপর্যন্ত নিজে নিজে ২ বার চেষ্টা করেছি।
প্রথমবার ডিপার্টমেন্টের পিকনিকে। আমরা গিয়েছিলাম কুমিল্লার ময়নামতিতে। যাবার আগের দিন রাত থেকেই মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম যে এবার ঘটনা ঘটাতেই হবে। যেভাবেই হোক, যাই হোক বলতেই হবে। এতটা মানসিক কষ্ট নিয়ে থাকা যায়না। পিকনিকে গেলাম। খাওয়া দাওয়ার পরে সবাই টিচারদের খেলা নিয়ে ব্যস্ত। আমি দেখলাম ও একা একা বসে আছে কিছুটা দূরে একটা গাছের ছায়ায়। খুব সাহস করে যেতে থাকলাম। দূর থেকে ওর মুখের একটা পাশ কেবল দেখা যাচ্ছে। একদৃষ্টিতে আমি ঐ মুখের একটা পাশের দিকেই তাকিয়ে হাটছি। যতই কাছে যাচ্ছি আমার হৃৎপিন্ডটা তত জোরে লাফাচ্ছে। হাত-পা কাঁপছে। শীতের শেষ বেলাতেও কপাল ঘামছে। আমি অনেক কষ্টে ওর পাশে গিয়ে দাড়ালাম। ও ঝট করে ফিরে চাইলো। ওর চাহুনি দেখে মুখ-গলা শুকিয়ে কাঠ। ভিতরে ভিতরে ভয়াবহ কাঁপুনি। ও মিষ্টি হেসে বললো,
-‘কি তানভীর? কিছু বলবে?’
-‘না মানে আসলে’। আমার কথা শেষ হবার আগেই ও বলে উঠলো
-‘বিকালটা খুব সুন্দর, তাইনা?’
মনে মনে বললাম তোমার চেয়ে না।
-‘কি ব্যাপার? কথা বলছো না কেন?’
মনে মনে আল্লাহ্র নাম নিয়ে ভাবলাম যা আছে কপালে বলেই ফেলি। সব সাহস একসাথে করে যেই কিছু বলতে যাবো অমনি দেখি চোখ মুখ কুঁচকে ও বলছে,
-‘এ্যা মা!, তানভীর, তোমার জুতা, প্যান্ট তো গোবরে মাখামাখি। তুমি খেয়াল করো নাই?’
হতভম্ব হয়ে পায়ের দিকে তাকালাম। ডানপায়ে একগাদা গোবর লেগে আছে। দেখে নিজেরই গা গুলিয়ে উঠলো। কোন কথা না বলে সোজা হাটা দিলাম কলের দিকে। মনে মনে চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করলাম গোবরের। আজো এই ঘটনার কথা জানে না কেউ।
২য় বার তো বিশাল একটা চিঠিই লিখে ফেললাম। বিশালতো বটেই। দেড় পৃষ্ঠার চিঠি। জীবনে পরীক্ষার খাতা আর বির্তকের স্ক্রিপ্ট ছাড়া নিজের মেধা কোথাও খরচ করি নাই। অনেক কষ্ট হলো লিখতে। প্রথমে একটা খসড়া লিখলাম। পরে সেটাকে আবার সময় নিয়ে নতুন করে লিখলাম। রেখে দিলাম ড্রয়ারে। ঘটনার দিন সকাল বেলা খুব সুন্দর করে মাঞ্জা মারলাম। আজ আর কোন ভুল হওয়া চলবে না। ফাইনাল পরীক্ষার আর মাত্র ৪ মাস বাকি আছে। এরপর যে যার মত চলে যাবে। তাই যা করার এখনই করতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। সকালে ড্রয়ার থেকে চিঠিটা নিলাম। না খুলেই পকেটে রাখলাম। ভার্সিটিতে গিয়ে নীলাকে জিজ্ঞেস করলাম ওর কথা। মুচকি হেসে বললো, ‘ও লাইব্রেরিতে’। কথা বাড়ালাম না। বীর দর্পে এগিয়ে গেলাম লাইব্রেরির দিকে। নিজেকে বুঝালাম জুলিয়েটের জন্য যদি রোমিও নিজের জীবন উৎসর্গ করতে পারে, আলেকজান্ডার যদি এত অল্প বয়সে অর্ধেক পৃথিবী জয় করতে পারে তবে আমি এই বয়সে এসে প্রেমের একটা চিঠি দিয়ে আসতে পারবনা? অবশ্যই পারবো। প্যান্টের পকেটে চিঠিটা আছে কিনা দেখে নিলাম। লাইব্রেরিতে ও কোথায় থাকবে জানাই ছিল। ওর সামনে চেয়ারটা টেনে নিয়ে বসলাম। মুখ তুলে তাকিয়ে সেই হাসিটা দিলো। আবার সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেলো আমার। নিজেকে কষে একটা ধমক লাগালাম। চিঠিটা বের করে কাপাকাপা হাতে ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-‘এটা কি?’
-‘খুলেই দেখো’। বলেই উঠে পড়লাম।
বুঝতে পারছি খুব অবাক হয়েছে। পিছনে ফিরে আর তাকালাম না। সোজা ক্লাশে চলে গেলাম।
ক্লাশ শেষে দেখি ও আমাকে ডাকছে। মনে মনে আসন্ন ঝড়ের সব প্রস্তুতি নিয়ে নিলাম। ওর চেহারা দেখেই মনে হল ও খুব বিরক্ত। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। বুঝলাম কাজটা ভালো হয়নি। সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে ওর সামনে গিয়ে দাড়ালাম।
-‘কি ব্যাপার? তুমি লাইব্রেরিতে আমাকে এটা কি দিয়েছো?’ তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আছে সে আমার দিকে।
-‘না মানে, কেনো কি হয়েছে?’ আমি আর কথা খুঁজে পেলাম না।
-‘আরে আজব। মিড টার্মের প্রশ্ন দিয়ে আমি কি করবো? এটাতো আমার কাছে আছে’।
এবার আমি পুরাই বেকুব হয়ে গেলাম। চোখ বড়বড় হয়ে গেলো। কোন মতে বললাম, ‘প্রশ্ন মানে?’এবার ওর চেহারা দেখে মনে হল ও আকাশ থেকে পড়েছে। ভ্রু কুঁচকে আমার দিকে কাগজটা বাড়িয়ে দিয়ে বললো, ‘নিজেই দেখো’।আমি অবাক হয়ে দেখলাম ওর হাতে মিডটার্মের প্রশ্ন।
সেদিন কোনমতে ওর সামনে থেকে ছুটে পালিয়ে এসেছিলাম। বাসায় এসে ড্রয়ার খুলে আবার একটা ধাক্কা খেলাম। চিঠিটা তো নাই। তাহলে?? কিছুই বুঝতে পারলাম না। আঁতিপাঁতি করে খুজলাম। নাহ্ চিঠি নেই। নিজের কাছে খুবই অবাক লাগলো। কিন্তু কোন ভাবেই বুঝতে পারলাম না কি হলো।
সেদিনের পর থেকে লজ্জায় ওকে এড়িয়ে চলি। গতকাল ফাইনাল শেষ হলো আমাদের। আজ ক্লাশের সবার একসাথে বসার কথা ছিলো। কিন্তু আমি রেডি হয়েও শেষ পর্যন্ত যাইনি। কাল থেকে আমার অপ্সরীকে আর দেখবো না ভাবতেই মনটা অসম্ভব কষ্টে ভরে যাচ্ছে। ও আজই চলে যাবে জানি। রাত ১১.৩০টায় ট্রেন। প্রতিবার পরীক্ষা শেষে ও তাই করে। আর কখনো দেখা হবে কিনা কে জানে। গত ৪টা বছর যা বলতে পারিনি তা আর বলা হবে কিনা জানি না। বিকাল থেকেই সৌরভ অনবরত ফোন দিচ্ছে। আশিক যাবার জন্য মেসেজ দিয়েছে। না পেরে মোবাইল বন্ধ করে বসে আছি। বসে বসে পুরানো ঘটনা মনে করছি।
এখন রাত ১০টা। আর কিছুক্ষন পরেই অপ্সরী ঢাকা ছাড়বে। চোখে ভাসছে ওর মায়াবি মুখ। চাদের স্নিগ্ধতাকে ম্লান করে দেওয়া সেই হাসি। বারবার মনে হচ্ছে যেয়ে একবার বলি, ‘হে মানবী, আমি জানি না তুমি কোন আকাশের তারা, আমি জানি না কোন স্বর্গে তোমার বাস, আমি শুধু জানি আমার পৃথিবীতে তুমি সেই সুখের সূর্য্য যার আলোতে আমি বড় করেছি আমার অনাবিল আবেগের স্বপ্ন-বাগান’।
-‘কি রে? কি হয়েছে তোর? ব্যাপার কি? মোবাইল অফ্ কেন?’ আশিকের কথায় চমকে তাকিয়ে দেখি আশিক আর সৌরভ এসেছে।
ম্লান মুখে ওদের দিকে তাকালাম। আমার চোখে এমন কিছু ছিলো যা ওদের কে বিষ্মিত করেছে। সৌরভ ব্যস্ত হয়ে বললো, ‘তানভীর, কি হয়েছে রে?? কি হয়েছে দোস্ত?’
-‘কিছুনা’। ধরা গলায় বললাম। ওরা আমার পাশে এসে বসলো। আশিক যখন আমার কাঁধে হাত রাখলো আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। ওর হাতটা ধরে ছলছল চোখে বললাম-‘আমি ওকে হারাতে চাইনা দোস্ত’।
-‘ওকে বললেই পারিস’।
-‘হুমম। কিন্তু ও কি রাজি হবে?’
-‘বলে দ্যাখ না ব্যাটা’। সৌরভ সাহস দিলো।
-‘কিন্তু ও যে আজকেই চলে যাবে’।
-‘তুই ফোন কর ওকে। সমস্যা কি?’
মোবাইলটা হাতে নিলাম। ওর নাম্বারটা অপ্সরী নামেই সেভ করা আছে। ডায়াল করলাম। রিং হচ্ছে কিন্তু কেউ ধরছে না। আবার ফোন করলাম। আবারো একি অবস্থা। আবার ফোন দিলাম। আবার কেউ ধরলোনা। বুকের মধ্যে অস্থিরতা বাড়ছে। তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে বৃষ্টি। আমি ঘরে পায়চারি শুরু করলাম। আমার টেনশনে ওরাও চিন্তিত। শেষে সৌরভ বললো, ‘এখন ধরছে না ঠিক আছে। তুই মেসেজ দিয়ে রাখ’।
-‘আরে নাহ্। এসব কথা মেসেজে বলা যায়না। তাও আবার চলে যাবার দিনে’। আশিক প্রতিবাদ করলো।
আমিও ওকে সমর্থন করলাম। আমার কানে ভাসতে লাগলো আশিকের কথার শেষ ৩টা শব্দ, ‘চলে যাবার দিনে’। আমার যেনো কি হয়ে গেলো। আমি খুব ছটফট করতে করতে বললাম, ‘যা বলার আমি আজকেই বলবো। ও ঢাকা ছাড়ার আগেই বলবো’।
-‘যে কথা ৪ বছরে বলতে পারো নাই সে কথা তোমার আজকেই বলতে হবে তাও যখন সেই মানুষ এখন ঢাকা ছাড়ার পথে। আসছেন আমার প্রেমিক পুরুষ’। সৌরভের কন্ঠে শ্লেষ মেশানো ব্যঙ্গ।
আমার মাথায় আগুন ধরে গেলো। আমি খুব ঠান্ডা কিন্তু দৃঢ় গলায় আগের কথা টাই আবার বললাম।
নিজেও জানি না আমি কেন এমন করছি। শুধু মনে হচ্ছে খুব মূল্যবান কিছু একটা আমি হারিয়ে ফেলছি সময়ের সাথে সাথে। আমার আজকেই পেতে হবে সেই ঐশ্বর্য্য। আমি ওদের দুজনের দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি স্টেশনে যাব। তোরা কেউ কি আসবি আমার সাথে?’
ওরা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালো। আশিক একবার বাইরের দিকে তাকিয়ে বৃষ্টি দেখলো। কিছুক্ষন মাথা নিচু করে কি যেন ভাবলো। সৌরভ ঘড়ি দেখে বিড়বিড় করে বললো, ‘অলরেডি ১০.৪০। ওর ট্রেনতো ১১.৩০ এ’। তারপর দুজন প্রায় একসাথেই বললো, ‘তোর এখান থেকে যেতে তো প্রায় ১ ঘন্টা লাগবে। সময়ের আগে কি আমরা পৌছাতে পারবো?’
-‘তারপরেও আমি যাবো। তোরা চাইলে আসতে পারিস’। আমি দরজার দিকে পা বাড়ালাম।
আমার মাথায় যেন কিসের ভূত চেপে বসেছে। নিজেকেই আমি এখন চিনতে পারছিনা। ভালোবাসার শক্তিটা উপলব্ধি করতে পারছি কেবল। যতই বুঝতে পারছি ততই অবাক হচ্ছি। এ এমন এক শক্তি যা রাত কি দিন বোঝে না, ঝড়বৃষ্টি মানে না। বের হবার আগে রাফিকে ফোন দিতে যাবো হঠাৎ খেয়াল হলো ইনবক্সে একটা মেসেজ দেখাচ্ছে। এতক্ষন খেয়াল করিনি। মেসেজটা ওপেন করে খুবই অবাক হলাম। গত ৪ বছরের মধ্যে এই প্রথম অপ্সরীর নাম্বার থেকে কোন মেসেজ আসলো। সময় দেখলাম ৬.৪৫। তারমানে সন্ধ্যায় পাঠিয়েছে। আশিককে বললাম রাফিকে ফোন দিয়ে বাইকটা নিয়ে আসতে। আমি মেসেজ পড়া শুরু করলাম। ‘ তানভীর, আজকের প্রোগ্রামে আসলে না কেন? আমি চলে যাচ্ছি রাতে তাতো জানোই। আবার কবে আসবো জানি না। যাবার আগে দেখা হলে অনেক ভালো লাগতো’। আমার হাত কাঁপছে। ওকে ফোন দিলাম। মনে মনে বলছি, প্লিজ ফোনটা ধরো। কিন্তু কেউ ফোন ধরলো না। মেসেজ দিয়ে রাখলাম, ‘তুমি এই মেসেজটা পাবার সাথে সাথে যেখানেই থাকো আমাকে ফোন দিবা’। আমি এত রাতে বাইরে যাচ্ছি দেখে আম্মু অবাক হলো। জিজ্ঞেস করলে শুধু বললাম, ‘আজকে রাতে রাফিদের ওখানে থাকবো’।
ঝুম বৃষ্টির মধ্যে তিনজন বের হলাম। বাসার ২ টা ছাতার ১টা নিয়ে এসেছি। রাফির নিয়ে আসার কথা ওর বাইক। হাটছি আর ভিজছি। চশমার কাচ ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তাতে চোখের দীপ্তি কমছে না। রাত ১১ টায় আজিমপুরের রাস্তায় তিনটা ছেলে একটা ছাতার নিচে হাটছে। রাস্তার নিয়ন বাতির আলোতে বৃষ্টির ফোটা গুলো কেমন অদ্ভুত দেখাচ্ছে। আমার ভিতরে এক অন্যরকম আনন্দ মিশ্রিত উদ্বেগ। সময়মত যেতে পারবো তো? এর মাঝে আমাদের কারো একবারের জন্যও মনে হয়নি যে সময়মত যেতে পারলেও এত বড় ট্রেনে ওকে কোথায় খুঁজবো? ও কোন বগিতে থাকবে তাইতো জানি না। মনটা আবার খারাপ হয়ে গেল এই কথাটা মনে হতেই। সৌরভ কে বলতেই ও বললো, ‘দ্যাখ, জীবনে আজ প্রথম এরকম একটা কাজে যাচ্ছি। এত কিছু ভাবতে পারছিনা। ওখানে যাই পরে দেখা যাবে কপালে কি আছে। তুই মোবাইলে চেষ্টা করতে থাক’।
ছাতার মাঝখানে এসে কোন রকমে মোবাইলে ফোন দিচ্ছি। কিন্তু সেই একি অবস্থা। কেউ ধরছেনা। দমকা বাতাসের বেগ বেড়েছে। ছাতা ধরে রাখাই মুশকিল। মনে হচ্ছে ছাতাটা উড়েই যাবে। আর মনে হচ্ছে আমার আশার প্রদীপটাও এভাবেই নিভে যাবে। এমন সময় রাফিকে দেখা গেলো। ভিজে চুপচুপা হয়ে গেছে। ঠিক হলো আমি, রাফি আর আশিক বাইকে যাবো। সৌরভ বাসে আসার চেষ্টা করবে। বাইকে উঠলাম। রাফিকে খুব ছোট করে বললাম, ‘স্বর্গের অপ্সরী দাঁড়িয়ে আছে সময় ট্রেনের প্ল্যাটফরমে। আমায় ফেরাতে হবে তাকে। সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে কমলাপুরে চল। মাত্র ৩০ মিনিট বাকি’।
রাফি চালাচ্ছে ওর সাধ্যমত। বৃষ্টির রাত বলেই রাস্তা ফাঁকা। দেখতে দেখতে আমরা পল্টনে চলে এলাম। এরপরে একটা ছোট্ট জ্যাম। মাত্র ৫ মিনিট লাগলো জ্যামটা শেষ হতে। আমার মনে হচ্ছিল অনন্ত যুগ। চোখের সামনে চশমার কাচ ঝাপসা। কিন্তু আমার চোখে অপ্সরীর মুখটা ঠিকই উজ্জ্বল। বৃষ্টির মধ্যে তিনবার মোবাইল বের করেছিলাম। না, কোন ফোন আসেনি। ৪র্থ বার বের করে যেই ফোন করতে যাবো অমনি মোবাইল অফ হয়ে গেলো। বৃষ্টির পানিতে না চার্জ শেষ বুঝলাম না। মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পৌছালাম স্টেশনে। দেয়ালের বড় ঘড়িতে তখন ১১.২০। বাইক থেকে নেমে দৌড় দিলাম। জানি না তূর্ণা নিশিথা কোন প্ল্যাটফরমে। জানি না সে কোন বগিতে। কিছুই জানি না। শুধু জানি এই বৃষ্টি ভেজা রাতে আমার খুঁজে পেতে হবেই তাকে। বলতেই হবে তাকে মনের না বলা কথা। আমাদের দুই পাশে ২টা ট্রেন দাঁড়ানো। কিন্তু কোনটাতেই কিছু লেখা দেখলাম না। এর মধ্যে আশিক এসে পাশে দাঁড়ালো। রাফি ওর বাইকের কাছে। কিছু বুঝতে পারছি না। বুকটা খালি খালি লাগছে। এদিক ওদিক তাকাচ্ছি। চুল বেয়ে টুপটাপ করে পানি পড়ছে। বুঝতে পারছি সবাই অবাক হয়ে আমাদের দিকে তাকাচ্ছে। আমার চোখ শুধু খুঁজে বেড়াচ্ছে সেই মায়াবী মুখ খানি। না সে নেই। এত বড় স্টেশনে এত লোকের ভীড়ে তাকে পাচ্ছিনা। এর মধ্যেই মাইকে শুনলাম কিছুক্ষনের মধ্যেই ট্রেন ৪ নাম্বার প্ল্যাটফরম থেকে ছাড়বে। একজনকে জিজ্ঞেস করতেই ট্রেন দেখিয়ে দিলো। বিশাল ট্রেনের প্রায় মাঝখানে আমরা। আমি আশিককে বললাম ‘তুই সামনে যা আমি একবার পিছনটা দেখে আসি’। দুজন দুদিকে চলে গেলাম। প্রতিটা কামড়ায় ব্যাকুল চোখে খুঁজে যাচ্ছি। যদি একবার তাকে দেখতে পাই। অল্প সময় পরেই গার্ড এর হুইসেল শুনতে পেলাম। আস্তে আস্তে ট্রেন এর চাকা ঘুরতে শুরু করলো। আমার সামনে দিয়ে আমার অপ্সরীকে নিয়ে ট্রেনটা চলে যাচ্ছে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না। চোখ ফেটে কান্না আসছে। ঝাপসা চোখে দেখলাম ট্রেনটা চলে গেল। আমি দুহাতে মুখ ঢেকে ফেললাম। আশিক এসে আমার পাশে দাঁড়ালো। হাত ধরে বললো, ‘চল’। আমি আর আশিক হাটা দিলাম।
স্টেশন থেকে বের হয়ে রাফির বাইকের কাছে আসলাম। রাফি সুন্দর একখান হাসি দিয়ে বললো, ‘কি রে কি হলো? পেলি না তাইনা?’ বিষন্ন চোখে ওর দিকে তাকালাম। ও আবার একটু হেসে বললো, ‘দোস্ত খুব ক্ষুধা লেগেছে। রাতে না খেয়ে বের হয়েছি। চল বিরতিতে যাই। কাচ্চি খাবো’। ওর কথাটা শুনেই মেজাজটা খারাপ হয়ে গেলো। মুখটা গোমড়া করে বললাম, ‘আমি এত কষ্ট পাচ্ছি আর তুমি শালা এই সময় কাচ্চির গন্ধ পাচ্ছো?’ ও শুধু মুচকি হেসে বললো, ‘এত কষ্ট করে তোদের নিয়ে আসলাম আর আমার জন্য এটুকু করতে পারবি না? যাহ্ আজকের বিল আমার’। এরপর আর কথা বাড়ানোর কোন সুযোগ দিলো না ও। আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে চললো দোতলার বিরতি রেস্টুরেন্টে।
তিনজন ভেজা কাকের চেহারা নিয়ে বিরতিতে ঢুকলাম। টেবিলে বসে আছি মাথা নিচু করে। খুব কষ্ট হচ্ছে। বারবার মনে হচ্ছে ৪ বছরের মধ্যে একটা দিন যদি আজকের মত সাহস করতাম তাহলে আজ এত কষ্ট পেতে হতোনা। চশমাটা খুলে টেবিলে রাখলাম। এমনিতেই চশমা ছাড়া আমি কানা বগির ছা। ২ হাত দূরের জিনিসও ভালো দেখিনা। তারউপর আবার চোখ ভরে আছে পানিতে। সবকিছু খুব ঝাপসা আমার সামনে। হঠাৎ নাকে একটা মিষ্টি পারফিউমের গন্ধ আসলো। ডান দিকে তাকাতেই খুব ঝাপসা ভাবে দেখলাম নীল ড্রেস পড়া কেউ একজন আমার দিকে এগিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতে সে যে মেয়ে এটা বুঝতে পারলাম। কিন্তু মুখটা এখনো ভালো মত বুঝতে পারছিনা। চোখটা দুহাতে ডলে যখন চশমাটা নিতে যাবো তখন দেখি সেই মেয়েটা চশমাটা তুলে ওড়নাতে মুছে আস্তে করে আমার চোখে দিয়ে দিলো। সাথে সাথেই প্রচন্ড অবাক হয়ে দেখলাম অপ্সরী দাঁড়িয়ে আছে। আমি ভূত দেখার মত চমকে বললাম, ‘তু-তু-তুমি এখানে? তুমি যাওনি?’
-‘না, সে যায়নি না। সে যেতে পারেনি’। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখি নীলা পিছনে দাঁড়িয়ে মিটিমিটি হাসছে। এবার রাফির দিকে তাকালাম। ওর মুখেও হাসি। সাথে সাথেই ওর কাচ্চি খাবার ইচ্ছার রহস্য বুঝতে পারলাম। আমার সাথে সাথে আশিকও অবাক। হাততালি দিয়ে বললো, ‘লুল রে লুল’।
নীলার মুখে ঘটনা শুনলাম। অপ্সরী রাতে যাবে বলে নীলাকে বলে রেখেছিলো ওকে স্টেশনে নামিয়ে দিতে। ওর ফোন সাইলেন্ট করা ছিলো বলে ও ফোন ধরতে পারেনি। ভেবেছিলো ট্রেনে উঠে সবাইকে ফোন দিয়ে বাই বলবে। আমি আর আশিক প্ল্যাটফরমে ঢোকার পরমুহূর্তেই ওরা স্টেশনে আসে। এসে বাইকে বসা রাফিকে দেখে অবাক হয়। ওরা রাফিকে জিজ্ঞেস করে সব জানতে পারে। পরে তিনজন মিলে এই বুদ্ধি করে।
এরপর আমার সাহস যেন অনেক বেড়ে গেল। আমি রাফিকে বললাম, ‘তোরা খেয়ে নে। আমাদেরটা প্যাকেট করে নিয়ে যাস। আমরা যাচ্ছি’।
অপ্সরীর দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘বাইরে চলো’। ও অবাক হয়ে বললো। ‘এই বৃষ্টিতে?’ আমি ওর হাতটা ধরে টানতে টানতে রাস্তায় নামলাম। একটা রিকশা ভাড়া করলাম ওর হোস্টেলের গন্তব্যে। হুড খুলে বৃষ্টির অবিরত বর্ষনে ভিজে যাচ্ছি দুজন। এখনো ওর হাতটা আমার হাতে ধরা। একবারের জন্যও ছাড়তে ইচ্ছা করছে না। যেন ছাড়লেই ও আবার গিয়ে ট্রেনে উঠবে। যেন হাত ছেড়ে দিলেই আমার এই স্বপ্নের মৃত্যু ঘটবে। আমিই প্রথম কথা শুরু করলাম।
-‘তুমি না গিয়ে থেকে গেলে কেন?’
-‘একজন ভীতুর ডিম মানুষের অতি বড় বীর পুরুষ হবার কাহিনী দেখার লোভ সামলাতে পারলাম না’। ওর কন্ঠে কৌতুক।
-‘মানে?’
-‘মানে, আমি সেদিন লাইব্রেরিতে তোমার চিঠিই পেয়েছিলাম। তুমি যেটা দিয়েছিলে সেটা চিঠিই ছিলো। আমিই তোমাকে মিথ্যা বলেছিলাম। আমি চাচ্ছিলাম তুমি সাহস করে নিজে থেকেই সরাসরি আমাকে বলো। কিন্তু আজ পর্যন্ত তুমি তা পারলে না। তাই ভেবেছিলাম আজ বিকালে তোমার সাথে দেখা হলে আমি নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করবো। কিন্তু তুমি তো এলেনা। তোমার ফোন ও অফ পেলাম’।
হঠাৎ বাইকের হর্ন শুনতে পেলাম। পাশে তাকিয়ে দেখি রাফি আর আশিক। রাফি উদাস গলায় বললো, ‘এত রাতে ঢাকা শহরে দুজনকে একা ছাড়া ঠিক মনে হয় নাই। তাই গার্ড অব অনার দিতে চলে এলাম’।
আমি হেসে শুধু বললাম, ‘লুল রে লুল’।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua