শূণ্যতার বসতি
সময় থাকতে আসলে আমরা কাউকে মূল্যায়ন করি না। যতটুকু সম্মান তার প্রাপ্য হয় তার থেকে অনেক বেশী দিয়ে মাথায় নিয়ে মাতামাতি করি আর না হলে প্রাপ্য সম্মানটুকু না দিয়ে অবহেলায় ফেলে রাখি। সমাজে এই ফেলে রাখা মানুষগুলোর সংখ্যাই বেশী। সে যখন তার সমস্ত গুণাবলীগুলো সাথে নিয়ে চলে যায় না ফেরার দেশে তখন আমরা তাকে মরণোত্তর পুরস্কার দেই। তোরণ বানাই, সভা করে কেঁদে কেটে বুক ভাসাই। কবিতা লিখি, গান বানাই, নাটকও লিখে ফেলি। এই আবেগের কতটা আসল আর কতটা মিডিয়ার মাধ্যমে প্রচার পাবার জন্য সে বিষয়ে কথা না বলাই ভালো। সবাই তা জানে। কিন্তু এতে আসলে ক্ষতিটা কার?
আমরা যে সময় পার করে এসেছি – আমাদের শৈশব, কৈশোর, কিংবা তরুণ সময়ে যে ব্যক্তিত্বরা তাদের চমৎকার গুণাবলী দিয়ে আমাদের মুগ্ধ করে রেখেছেন তাদের সবাই কি আমরা ধরে রাখতে পেরেছি? আমি বলতে চাচ্ছি যে, তাদের কর্ম, চিন্তা, তাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার – যা হতে পারতো আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য গোল্ড মাইন – তা কি আমরা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পেরেছি?
নিজের কথাই বলি। নটরডেমের মুখতার স্যারের বাংলা ক্লাস, আজমল স্যারের জীববিজ্ঞান, বিদ্যাসাগর আর গুহ স্যারের কেমিস্ট্রি, কিংবা জওহর লাল স্যারের “অংকটা আমাকে বলে, আমাকে এইভাবে সমাধান কর” – এরকম আরো অসংখ্য শ্রদ্ধেয়, সম্মানিত শিক্ষক তাদের প্রজ্ঞা, জ্ঞান আর সাধনা লব্ধ অভিজ্ঞতার ভান্ডার নিয়ে চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে, আমরা কী তাঁদের এই এক্সপার্টিজ (দুঃখিত সঠিক বাংলাটা মনে পড়লো না এখন) গুলোকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এভেইলেবল করতে পারছি? আমার সন্তানরাই তো উনাদের গল্প শুনে বড় হবে। কিন্তু আফসোস! উনাদের কাছ থেকে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগটা পাবে না।
আমরা আজ পেলে, ম্যারাডোনার ভিডিও দেখে তাদের গ্রেটনেস উপলব্ধি করি। আমরা মেসি, রোনালদোকে প্রতিদিন টিভিতে দেখি – যাদেরকে একসময় আমাদের উত্তরসূরীরা ইউটিউবে দেখবে। কিন্তু কাউকে কোন কিছু শেখানো একটা অন্যধরণের ব্যাপার। এটা খুবই ডিফিকাল্ট একটা আর্ট। আবারো নিজের জীবনে ফিরে যাচ্ছি। আমাদের এনাটমির শিক্ষক ছিলেন – কিবরিয়া স্যার। এত ভালো এনাটমি বুঝাতেন যে আমরা ঘন্টার পর ঘন্টা ক্লাস করেও খুব একটা ক্লান্ত হতাম না। আমার কোন সন্তান যদি ডাক্তারী বিদ্যা অধ্যয়ন করতে যায় আর সে সময় যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে অবশ্যই আমি তাকে স্যারের গল্প শোনাবো। কিন্তু আফসোস আমার সন্তানরা সেই অসাধারণ ক্লাসের অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে না।
অনেকেই হয়তো বলবে যে সে সময় এর চেয়েও ভালো শিক্ষক আসবেন। অমত করছি না। আসতেই পারেন। তাছাড়া একটা যুগ, একটা প্রজন্মের সাথে অন্য যুগ অন্য প্রজন্মের তুলনা আসলে চলে না। কিন্তু ভয়টা হচ্ছে লক্ষণ তো ভালো দেখছি না। শিক্ষার মান কোথায় সেটা যারা অল্প-বিস্তর শিক্ষকতা পেশায় আছেন তারা খুব ভালো মতই জানেন। আর সে কারণেই এই লিজেন্ডেরকে খুব মিস করি। কোনভাবে যদি তাঁদের বিশেষত্বগুলো আমরা সংরক্ষণ করতে পারতাম।
একজন হুমায়ূন আহমেদ চলে গেছেন, সেলিম আল দীন আমাদের মাঝে নেই, হুমায়ূন ফরিদী নেই, বাচ্চু দ্য গিটার বস নেই – কবে আবদুল্লাহ আবু সাইয়িদ স্যার চলে যাবেন। কবে শুনবো ফেরদৌসি রহমান নামের আমাদের ছোট্টবেলার গানের খালামণি চলে গেছেন। আমরা হারিয়ে ফেলবো কাহহার স্যারকে, আবিদ হোসেন মোল্লা স্যারকে। হারিয়ে ফেলবো বায়োকেমিস্ট্রির স্তম্ভ মোজাম্মেল হক স্যারকে।
আমাজন শেষ হয়ে যাচ্ছে, সুন্দরবন হারিয়ে যাচ্ছে, পদ্মা-মেঘনা মরে যাচ্ছে। এসব হারিয়ে যাওয়া চোখে দেখা যায়। মেধা শূণ্যতা, ইন্টেলেকচুয়াল পোভার্টি চোখে দেখা যায় না। এই শূণ্যতা হঠাৎ করে তৈরী হয় না। একটা জাতির অগোচরে এই বিশাল ধ্বস একসময় সমগ্র জাতিটাকে নাড়িয়ে দিয়ে যায়।
বাঙ্গালী নাড়া খাওয়ার আগে কোনদিনই বোঝেনি। এখনো বুঝবে সেই আশা করি না। ব্যক্তি উদ্যোগে কিছু করা যায় কী না সেই ভাবনায় আছি।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua