এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স এবং আমাদের ভুল ধারণা
এন্টিবায়োটিক রেজিস্টেন্স ব্যাপারটা নিয়ে কিছু বলাটা আমার জন্য ভীষণ কষ্টের। বাবার যখন এস্পিরেশন নিউমোনিয়া হয় তখন যে দুটো ব্যাকটেরিয়া ফুসফুসে বাসা বেঁধে ছিল তারা হল সিডোমোনাস আর ক্লেবশিয়েলা এবং শুধুমাত্র কোলেস্টিন ছাড়া আর সমস্ত এন্টিবায়োটিকেই তারা রেজিস্ট্যান্ট ছিল। আইসিইউ কন্সাল্টেন্ট বলেছিলেন “তানভীর এটা নজোকোমিয়াল ইনফেকশন। সম্ভবত কোন সাকার মেশিন বা অক্সিজেন ভেন্টিলেশন থেকে হয়েছে”। খুবই সম্ভব কারণ আব্বু তার আগে বেশকিছু দিন হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। এই একই সিডোমোনাস দেখেছি আরও দুটো পেশেন্টের বেলায়। একজনের ল্যারিঞ্জিয়াল কার্সিনোমা ছিল। অপারেশন করার পর ইনফেকশন হয়েছে এবং যথারীতি সব এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট। ঢাকার বড় বড় হাসপাতালগুলোর সাকার মেশিন, অক্সিজেনের পাইপ পরীক্ষা করলে এই সিডোমোন্যাস পাওয়া যাবে এটা আমি অন্তত নিশ্চিত।
যে কারণে এই লেখা সেটা বলি। কারণটা হল এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট এই শব্দ দুটো নিয়ে আমাদের অনেকের ভুল ধারণা আছে। আমরা অনেকেই মনে করি এই রেজিস্ট্যান্ট তৈরী হয় মানুষের শরীরে প্রতি এবং রেজিস্ট্যান্ট তৈরী হওয়া মানে কোন এন্টিবায়োটিক আর তার উপর কাজ করবে না।
ভুল! একেবারেই ভুল! তাহলে সঠিকটা কী? আসেন দেখি।
১. এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট বা রেজিস্ট্যান্স এখানে শব্দ দুটি। কয়টি শব্দ? দুটি শব্দ। প্রথমটা এন্টিবায়োটিক। পরেরটা রেজিস্ট্যান্ট বা রেজিস্ট্যান্স যেটা বলেন।
২. এন্টিবায়োটিক মানে হল একটা ওষুধ যেটা জীবানুর উপর কাজ করবে। কার উপর কাজ করবে? জীবানুর উপর। মানুষের উপর কী কাজ করবে? উত্তর না। মানুষ এই ওষুধ খাবে। খেলে তার শরীরে ওষুধ প্রবেশ করে জীবানুদের উপর কাজ করে হয় তাঁদের মারবে না হয় তাঁদের বংশবৃদ্ধি রোধ করবে। ভালো করে খেয়াল করেন কথাটা। আবার বলি – এই গ্রুপের ওষুধ আপনি খাচ্ছেন নিজের শরীরে ঢোকা জীবানুদের খতম করতে। কি? ক্লিয়ার তো? সামনে আগাই।
৩. রেজিস্ট্যান্স মানে প্রতিরোধ। আর রেজিস্ট্যান্ট হল প্রতিরোধের ক্ষমতা। বোঝার সুবিধার জন্য আমরা প্রতিরোধের ক্ষমতা নিয়েই কথা বলি। আচ্ছা বলেন দেখি এই যে প্রতিরোধের ক্ষমতা – এই প্রতিরোধ করার ব্যাপারটা কার জন্য প্রযোজ্য? আমি আপনাকে অপশন দেই।
ক) আপনি প্রতিরোধ করবেন
খ) জীবানুরা প্রতিরোধ করবে
আর অপশন নাই। কারণ এখানে পক্ষ আছেই দুইটা। এক আপনি, দুই আপনার ভিতরে প্রবেশ করা জীবানু।
তাহলে উত্তর কী দাঁড়াচ্ছে? উত্তর হল যেহেতু এন্টিবায়োটিক নামক ওষুধগুলো কাজ করবে জীবানুদের বিরুদ্ধে কাজেই এটা সহজ কথা যে এই প্রতিরোধ অর্থাৎ এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরী করবে জীবানুরাই। আপনি কেন শুধু শুধু জীবন বাঁচানো ওষুদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরী করতে যাবেন? আপনার কী চুলকায়?
৪. না। আমাদের চুলকায় না। তাহলে এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ তৈরী হচ্ছে জীবানুদের ভিতর। তারা এন্টিবায়োটিকের প্রতি সহনশীল হয়ে যাচ্ছে। বিষয়টা আরও ভালোভাবে ব্যাখ্যা করি।
ধরেন আপনার এলাকায় একদল মাস্তান ঢুকেছে। আপনি এলাকার সিকিউরিটি গার্ডদের বললেন চোখ-কান খোলা রাখতে। আপনি মাস্তানের দলটাকে শায়েস্তা করার জন্য ১০ জন গার্ড পাঠালেন। তারা শায়েস্তা করে আসলো। কিছুদিন পর আবার সেই মাস্তানের দল এলাকায় ঢুকলো। আপনি আবার গার্ড পাঠালেন। কিন্তু এবার আপনার ভুলেই হোক অথবা গাফিলতির কারণেই হোক গার্ডের সংখ্যা কম হয়ে গেল। তারা গিয়ে শায়েস্তা করতে পারলো না। এবার মাস্তানদল বুঝে গেল গার্ডদের বিরুদ্ধে কীভাবে যুদ্ধ করতে হয়। তারা এই গার্ডদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরী করলো। এখন আপনি যতই গার্ড পাঠান কোন কাজই হয়না।
৫. এবার গার্ডের জায়গায় এন্টিবায়োটিক আর মাস্তানের দলের জায়গায় জীবানু বসান। ব্যস আপনি এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট কী বুঝে গেলেন। তাহলে মোদ্দাকথা কী দাঁড়ালো? মোদ্দাকথা হল রেজিস্ট্যান্স বা প্রতিরোধ জীবানুদের তৈরী করা ক্ষমতা।
৬. কখন জীবানুরা এই ক্ষমতা অর্জন করে? আরে ভাই! এই সুন্দর পৃথিবীতে বেঁচে থাকতে কে না চায় বলেন? জীবানুরা ছোট বলে তাঁদের কি বেঁচে থাকার আকুতি নেই চৌধুরী সাহেব? অবশ্যই আছে। সেই আকুতি থেকে তারা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করে যাচ্ছে কীভাবে আমাদের এন্টিবায়োটিক নামক অস্ত্রের হাত থেকে তারা রক্ষা পেতে পারে। সেই চেষ্টা অনেক সময় শুধু আমাদের কারণেই সফল হয়। আমরাই জীবানুদের সাহায্য করি। কীভাবে? ঐ যে গল্পের মত কম গার্ড পাঠিয়ে। অর্থাৎ ডাক্তার বললো আপনি ওষুধ খাবেন গুনে গুনে সাতদিন। আপনি খেলেন তিনদিন। শরীরটা যেই একটু ভালো লাগলো অমনি “ডাক্তার কী ছাই জানে অথবা ডাক্তার শালা ব্যবসায়ী। ৩ দিনেই যে কাজ হয় তার জন্য ৭ দিন খেতে বলেছে” – বলে এন্টিবায়োটিক খাওয়া বন্ধ করে দিলেন। জীবানুরা তিনদিন অনেকগুলোই মারা গিয়েছিল কিন্তু পুরোপুরি মরেনি। যারা বেঁচে ছিল তারাও মারা যেত যদি ঠিক ৭ দিন ওষুধ খেতেন। এখন এই বেঁচে যাওয়া জীবানুরা প্রতিশোধ নেবে। কঠিন প্রতিশোধ। এরা আপনার ব্যবহার করা এন্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলবে। হয়ে যাবে সেই এন্টিবায়টিকের বিরুদ্ধে রেজিস্টান্ট।
৭. কাহিনী কিন্তু এখানেই শেষ না। পিকচার আভী বাকি হ্যায় মেরে দোস্ত। যে ক্ষমতা তারা অর্জন করবে, যে বিদ্যা তারা লাভ করবে সেই বিদ্যা তারা দিয়ে যাবে তাঁদের পরবর্তী বংশধরদের। এভাবেই তৈরী হবে এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্ট জীবানুর দল। হারিয়ে যাবে একসময়ে আমাদের প্রিয় কোন অস্ত্র। যেভাবে হারিয়ে গেছে এম্পিসিলিন, প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে এমোক্সিসিলিন। আমরা নষ্ট করে ফেলছি সিপ্রোফ্লক্সাসিন, এজিথ্রোমাইসিনের মত অব্যর্থ সব জীবানুবিরোধী মারণাস্ত্র।
এখনো সময় আছে। প্লিজ একটু বোঝার চেষ্টা করুন। আমরা কী ভয়ংকর বিপদ ডেকে আনছি নিজেদের অজান্তে, অবহেলায় আর অজ্ঞতায়। প্লিজ নিজের ভালো না বুঝতে চাইলেও সন্তানের ভালোটা বুঝুন। এখনো সময় আছে। যে কটা শেষ অস্ত্র আমাদের হাতে আছে সেগুলোকেও নষ্ট হতে দেবেন না। মনে রাখবেন –
১. জ্বর মানেই এন্টিবায়োটিক খাওয়া নয়। সিজনাল জ্বরগুলো ৯০ ভাগ ক্ষেত্রে ভাইরাল। ভাইরাসের উপর এন্টিব্যাকটেরিয়াল বা মোটা দাগে পরিচিত এন্টিবায়োটিকের কোন ভূমিকা নেই।
২. ফার্মেসিওয়ালা ডাক্তার নয়। এন্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স বিষয়ে তার জ্ঞান আছে এটা নাও হতে পারে। সে ব্যবসাটা ভালো বোঝে। এন্টিবায়োটিক বিক্রিতে লাভ বেশী। কাজেই সে যেকোন সাধারণ ঠান্ডা-জ্বরেও এন্টিবায়োটিক খেতে বলতে পারে।
৩. কালচার-সেন্সিটিভিটি টেস্ট না করে এন্টিবায়োটিক খাওয়া উচিৎ নয়। একটু ধৈর্য্য ধরে টেস্ট করিয়ে নিশ্চিত হয়ে নিন। আমরা আজ ধৈর্য্য না ধরলে পরবর্তী প্রজন্ম ভয়াবহ বিপদে পড়বে। আপনার সন্তানের অমঙ্গল নিশ্চয়ই আপনার কাম্য নয়।
৪. ৭ দিন মানে ৭ দিন। ১৪ দিন মানে ১৪ দিন। কোর্স কমপ্লিট করুন। প্লিজ কোর্স কমপ্লিট করুন।
আমরা মানুষ। নিজেকে নিয়ে তো অনেক ভাবলাম এবার একটু সন্তানের কথা ভাবি।
editor's pick
latest video
news via inbox
Nulla turp dis cursus. Integer liberos euismod pretium faucibua